গৌরীপুর রাজবাড়ির সমসাময়িক কালীপুর জমিদারবাড়ি পর্ব-১
জমিদার শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায়চৌধুরীর উদ্ধৃতি থেকে জানা যায়, ‘‘শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর দ্বিতীয় বণিতার গর্ভসম্ভূত গঙ্গানারায়ণ চৌধুরী জফরসাহীর অন্তর্গত মহীরামকোল নামক গ্রামে বাস করিতেছিলেন তাহা পূর্বে উল্লিখিত হইয়াছে। গঙ্গানারায়ণ চৌধুরী বড়ই স্বাধীন প্রকৃতির লোক ছিলেন। তাহার পত্নী চাঁপাদেবীর গর্ভে বলরাম, রামরাম, প্রাণকৃষ্ণ, শিবকৃষ্ণ ও ভবানিচরণ নামে পাঁচ পুত্র ও গৌরীদেবী নাম্নী এক কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। কালক্রমে পাঁচ পুত্রই অকালে কালগ্রাসে পতিত হওয়ায় গঙ্গানারায়ণ চৌধুরী শোকসাগরে পতিত হইলেন। তিনি বংশরক্ষার্থে রুদ্রনারায়ণ চৌধুরী নামে এক বালককে দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করেন, কিন্তু বিধাতার বিধান অনুসারে গৃহীত দত্তক অতি অল্পকাল মধ্যেই কালগ্রাসে পতিত হইলেন। গঙ্গানারায়ণ চৌধুরী নিজের অদৃষ্ট চিন্তা করিয়া জলপিণ্ডের সংস্থানের জন্য হরনাথ চৌধুরী নামে এক বালককে দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করেন। হরনাথ চৌধুরীই গঙ্গানারায়ণ চৌধুরীর ত্যক্ত সম্পত্তির অধিকারী হইয়াছিলেন।’’
লেখকের কথা আলোচনা করতে গিয়ে বলতে হয় – রামগোপালপুরের জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায় চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থে জামালপুর জেলার নামটি কোথাও উল্লেখ নেই। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, শত বছর আগে জামালপুর জেলার চেয়ে জাফরশাহী, সিংজানী, মালাঞ্চ, ইত্যাদি স্থান বিখ্যাত ছিল। এসব উদাহরণ থেকে বুঝা যায়, রেনেলের অংকিত মানচিত্র ছাড়া ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ বইটি পড়লে, প্রাচীন নামগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান পাঠক সহজে জানতে পারবেন না। এমনকী অনেকেই ভুল ইতিহাস জেনেছেন বা অনুমান করেছেন যে, জাফরশাহী পরগনা গৌরীপুর উপজেলা অথবা মোমেনসিং পরগনার সীমানা ঘেষে অবস্থানে ছিল। কিন্তু প্রাচীন মানচিত্র ঘাটলে দেখা যায় যে দুই পরগনার মাঝখানে কয়েকটি পরগনা রয়েছে। যেমন দুটি পরগনার দুরত্বের ব্যবধান ময়মনসিংহের গৌরীপুর থেকে জামালপুর জেলা।
গঙ্গানারায়ণ চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে গৌরীদেবী জামালপুরের মহিরামকুল গ্রামে বাস করতেন:
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর দ্বিতীয় তরফের সন্তান গঙ্গানারায়ণ চৌধুরী অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলার শিবনিবাস গ্রামের কৃষ্ণকান্ত লাহিড়ির সঙ্গে অতি সমারোহে তার একমাত্র মেয়ে গৌরী দেবীর বিয়ে দেন। উল্লেখ্য, জাফরশাহী ও মোমেনসিং পরগনার চার ভাগের এক ভাগ অংশের স্বত্বাধিকারী ও এই পৃথক অংশের জমিদারির নতুন নামকরণ হিসেবে কালীপুরের জমিদার গঙ্গানারায়ণ চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে গৌরী দেবী জামালপুর জেলার মেলান্দহের মহিরামকুল গ্রামে অর্থাৎ বাবার বাড়ির কাছে কেন বসবাস করতেন, তা রামগোপালপুরের জমিদার শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায়চৌধুরীর উদ্ধৃতি থেকে জানা যায়, ‘‘কৃষ্ণকান্ত লাহিড়ি রোহিলা পটিভুক্ত ছিলেন, এই কন্যা সম্প্রদানবশত গঙ্গানারায়ণ চৌধুরিও রোহিলা পটিভুক্ত হইলেন। নিরাবিল পটি ত্যাগ করিয়া অন্য পটির আশ্রয় গ্রহণ কার্যে তাহার জ্ঞাতিগণের সম্মতি ছিল না, সুতরাং এই পট্যন্তর পরিগ্রহণের জন্য জ্ঞাতিগণের সহিত তাহার সামাজিক সংস্রব রহিত হইল। গঙ্গানারায়ণ চৌধুরির জামাতা ও কন্যাকে যথেষ্ট তালুক প্রদান করিয়া তাহার বাটির সংলগ্ন স্থানে একটি সুন্দর বাসভবন নির্মাণ করিয়া দিলেন। তদনুসারে গৌরীদেবী মহীরামকোলেই বাস করিতে লাগিলেন।’’
হরনাথ চৌধুরীর মহিরামকুল রাজবাড়ি থেকে কালীপুরে আগমন:
জামালপুরের মহিরামকুল রাজবাড়িতে গঙ্গানারায়ণ চৌধুরী বাংলা ১১৮৩ ( ইংরেজি ১৭৭৭) সালে মৃত্যু হলে তার দত্তক ছেলে হরনাথ চৌধুরী চার আনা (৮০ গন্ডা) সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন। মহিরামকুলে গৌরীদেবীর লাহিড়ী পরিবার এবং বোকাইনগরের বাসাবাড়ি ও মেলান্দহ উপজেলার মালাঞ্চ কাছারিতে বসবাসকারী চৌধুরী পরিবারের বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে মহীরামকুলে বসবাস করা তার পক্ষে অসুবিধার হয়ে উঠল। গৌরীপুর রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা যুগলকিশোর রায়চৌধুরীর পরিকল্পনা ও পরামর্শে এবং ময়মনসিংহের জ্ঞাতিদের কাছে অবস্থান করতে সঙ্গত বোধ করে তিনি গৌরীপুরের কালীপুর এসে আবাস স্থাপন করেন।
শ্যামচন্দ্র চৌধুরী কর্তৃক হরনাথের দত্তক অসিদ্ধের চেষ্টা ও তৎসম্বন্ধে রটন সাহেবের রিপোর্ট :
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর দ্বিতীয় তরফের সন্তান ও গঙ্গানারায়ণ চৌধুরীর সহোদর ভাই লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরী মোমেনসিং পরগনার বোকাইনগর বাসাবাড়ি জমিদার ও জাফরশাহী পরগনার অন্তর্গত মালাঞ্চ কাছারির স্বত্বাধিকারী ছিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরীর তিন ছেলের মধ্যে শ্যামচন্দ্র চৌধুরী বেশিরভাগ থাকতেন জাফরশাহী পরগনায়। সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সময় ইংরেজ সরকারকে পদাতিক ও লাঠিয়াল দিয়ে শ্যামচন্দ্র অনেক সময় সাহায্য করতেন। শ্যামচন্দ্র বিলাসপ্রিয় হলেও তেজী পুরুষ ছিলেন। ঘোড়া চালানোয় তিনি পারদর্শী ছিলেন। ‘শ্যমচাঁদ বাহাদুর’ নামে তাকে ডাকা হতো। এ প্রসঙ্গে কেদারনাথ মুজমদার বলেন, ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে সন্ন্যাসীদের উলঙ্গ অত্যাচার প্রবাহিত হতে থাকে এবং জাফরশাহীর মালাঞ্চ কাছারী লুন্ঠন করে। জমিদারগণ পলায়ন করে মোমেনসিং পরগনার বাসাবাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। দত্তক পুত্র হরনাথ চৌধুরীই গঙ্গানারায়ণ চৌধুরীর সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন।
বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর চার ভাগের এক ভাগ অংশ হলো কালীপুর জমিদারি। এই জমিদারির মোট সম্পদের পরিমাপ ছিল ৮০ গন্ডা। পর্যায়ক্রমে কালীপুর জমিদারি হতে মোট পাঁচটি জমিদারবাড়ি উৎপত্তি হয়েছিল। জরিপ ও ইতিহাস গবেষণা করে পর্যায়ক্রমে পাঁচটি জমিদারবাড়ি উৎপত্তির ইতিহাস বিভিন্ন পর্বে প্রকাশিত হবে।
শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায়চৌধুরীর উদ্ধৃতি থেকে জানা যায় যে, ” হরনাথ অতি অল্প বয়সেই দত্তকরূপে গৃহীত হন। তিনি প্রথমে লক্ষ্মীনারায়ণের পুত্র শ্যামচন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণে প্রতিপালিত হইতে থাকেন। ইতিমধ্যে শ্যামচন্দ্র হরনাথকে অসিদ্ধ দত্তক প্রতিপন্ন করিতে চাহেন। হরনাথ ভয় পাইয়া যুগল রায়ের আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সম্পত্তি সুবন্দোবস্তে আনেন। এই গোলযোগ লক্ষ্য করিয়া তদানীন্তন কালেক্টর রটন সাহেব লিখিয়াছিলেন—This Mahal is the property of Haranath the adopted son of Ganganarayan who was the second son of Sreekishan. This Young man is the principle cause of the present disputes. Formerly put himself under the protection of Shyamchand and their two shares were managed together as
were those of Jugal Roy. Rattan Malla and Narayani and both parties were disaffected from similar causes. The tender years of Haranath fabricated sto-ries of his not being properly adopted, induced Shyamchand to usurp such an authority as made him justly fearful of being deprived of his right. I shall only add, Haranath is now about 22 years of age well disposed and of promising abilities.”
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর জমিদারি (১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে) চার আনা করে চার ভাগে বিভক্ত:
তরফ করৈ শেলবর্ষ পরগনা (বগুড়া), ছিন্দাবাজু পরগনা (বগুড়া), জাফরশাহী পরগনা (জামালপুর), মোমেনসিং পরগনা (পূর্ব ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ) এই চার পরগনার জমিদার ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী। গৌরীপুরের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারদের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী বগুড়ার কড়ই রাজবাড়িতে দুই বিয়ে করেছিলেন। আদমদিঘি উপজেলার কড়ই রাজবাড়িতে তার প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানরা আগে থেকেই পৃথকভাবে বসবাস করতেন। তারা পৃথক বাড়িতে থাকলেও শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর মৃত্যুর পর বিষয় সম্পত্তি অবিভক্ত ছিল। জমিদারির শাসন, সংরক্ষণ, তদারকি একযোগে হতো। জমিদারির দাপ্তরিক কাজও একত্রেই হতো। পরে ভাইদের মধ্যে বিরোধ ও আত্মকলহে এই পরিবারের বন্ধন পৃথক হয়ে যায়।
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর মৃত্যুর পর কৃষ্ণকিশোর, কৃষ্ণগোপাল, গঙ্গানারায়ণ ও লক্ষীনারায়ণ এই চার ভাই সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হন। চার ভাইয়ের মধ্যে দু’টি তরফ গঠিত হয়েছিল – প্রথম তরফ রায়চৌধুরী হিস্যা ও দ্বিতীয় তরফ চৌধুরী হিস্যা।
তখন দিনাজপুর ও বগুড়া জেলায় অত্যাচারী ব্রিটিশ কোম্পানি, জমিদার বা পুতুল নবাবদের বিরুদ্ধে লড়াকু নেতা ফকির মজনু শাহ-এর কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র ছিল। ১৭৫৯-৬০ এর মধ্যে ইংরেজ ও পুতুল নবাবদের বিরুদ্ধে লড়াকু নেতা ফকির মজনু শাহ-এর প্রভাবে ও ভয় পেয়ে তরফ রায়চৌধুরী ও তরফ চৌধুরী উভয় দলই আত্মকলহের পরিবর্তে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালাতে লাগেন। তারা তখন বগুড়ার আদমদিঘি উপজেলার কড়ই গ্রাম ছেড়ে জাফরশাহী পরগনায় কৃষ্ণপুর গ্রামে এসে (বর্তমান জামালপুর জেলা শহর) প্রথম তরফ রায়চৌধুরীর রাজপরিবার এবং মেলান্দ উপজেলার মালঞ্চ গ্রামে এসে দ্বিতীয় তরফ চৌধুরীর রাজপরিবার বসবাস শুরু করেন।
ঢাকাস্থিত তৎকালীন প্রাদেশিক শাসনকর্তা মুহাম্মদ রেজা খানের কাছে আবেদন করার পর শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর সমস্ত সম্পত্তি সমান দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে একাংশ তরফ রায়চৌধুরী হিস্যা ও অপরাংশ তরফ চৌধুরী হিস্যা প্রাপ্ত হলেন। এর মধ্যদিয়ে বহুদিনের আত্নবিরোধ শেষ হয়। প্রযাত কৃষ্ণগোপালের দত্তকপুত্র জমিদার যুগলকিশোর রায় চৌধুরী জাফরশাহী পরগনা অর্থাৎ জামালপুরের কৃষ্ণপুর হতে (ইংরেজি ১৭৬৫ সাল হতে ১৭৭০ সাল পর্যন্ত) জমিদারি করে আসছিলেন। ১৭৭০ সালের মহামারী অর্থাৎ বাংলা ছিয়াত্তরের মন্বন্তরর ফলে তিনি জাফরশাহী পরগনা ছেড়ে মোমেনসিং পরগায় এসে গৌরীপুর নাম দিয়ে একটি নতুন শহর বা বন্দর প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে (১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের পর) প্রথম তরফ রায়চৌধুরী হিস্যার সম্পত্তি সমান দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে একাংশ গৌরীপুর রাজবাড়ি ও অপরাংশ রামগোপালপুর জমিদারবাড়ি সৃষ্টি হয়। একইভাবে দ্বিতীয় তরফ চৌধুরী হিস্যার সম্পত্তি সমান দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে একাংশ কালীপুর জমিদারবাড়ি ও অপরাংশ বোকাইনগর বাসাবাড়ি জমিদারি সৃষ্টি হয়।
গৌরীপুর এস্টেট বা জমিদারির মালিক ছিলেন যুগলকিশোর রায় চৌধুরী, রামগোপালপুর এস্টেট বা জমিদারির মালিক ছিলেন প্রয়াত কৃষ্ণকিশোর রায় চৌধুরীর দুই বিধবা স্ত্রী রত্নমালা ও নারায়নী দেবী, কালীপুর এস্টেট বা জমিদারির মালিক ছিলেন গঙ্গানারায়ণ চৌধুরী এবং বোকাইনগর বাসাবাড়ি এস্টেট বা জমিদারির মালিক ছিলেন লক্ষীনারায়ণ চৌধুরীর তিন ছেলে।
গৌরীপুর ও কালীপুরের নামকরণঃ
ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্বর্ণখনি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলা। বাংলা ১১৭৬ ও ইংরেজি ১৭৭০ সালে বোকাইনগরের কাছে গৌরীপুর নামে একটি শহর বা বন্দর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। গৌরীপুরের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারদের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী, তার দত্তক নাতনী (শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর প্রথম তরফের সন্তান কৃঞ্চগোপালের দত্তক পুত্র) ও নবাব সিরাজের অপর স্ত্রী আলেয়া (হীরা বা মাধুবী) এবং তাঁর গর্ভে জন্ম নেওয়া পুত্র সন্তান এবং গৌরীপুর রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা জমিদার যুগল কিশোর রায় চৌধুরী মোমেনসিং পরগনার এজমালি সম্পত্তি থেকে গৌরীপুর শহর বা বন্দর পত্তন করেন। তৎকালে বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ হতে বালুয়া নদী প্রবাহিত হওয়ার সময়ে গৌরীপুর শহর একটি দ্বীপ আকৃতির ভূখণ্ড ছিল। আজ থেকে আড়াইশ বছর আগে বালুয়া নদীর একটি শাখানদী বা গাঙ বর্তমান পাটবাজার মোড় হয়ে মাঝিপাড়ার দিকে প্রবাহিত হয়েছিল। তখন গাঙের উত্তরপাশে ছিল গৌরীপুর এবং দক্ষিণ পাশে ছিল কালীপুর।
এখনও দু’এক জন বৃদ্ধ জীবিত আছেন যারা ৭০/৮০ বছর আগে গাঙের কঙ্কাল বা খাল দেখেছেন। শতবছর আগের লেখা থেকে জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায় চৌধুরীর উদ্ধৃতি থেকে জানা যায়, ‘আড়াই শত বৎসর পূর্বে বিখ্যাত ব্রহ্মপুত্র নদ বোকাইনগরের পশ্চিমদিক দিয়া প্রবাহিত হইত।’
ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, হিন্দুদের গৌরী দেবীর নাম অনুসারে গৌরীপুর ও কালী দেবীর নাম অনুসারে কালীপুর এই দুইটি স্থানের নাম রাখা হয়েছে। গৌরীপুর রাজবাড়ির পঞ্চম জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর আমলে গৌরীপুর রেলওয়ে জংশন ও ১৯২৭ সালে গৌরীপুর পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে গৌরীপুর এস্টেট সদর মহকুমার একটি প্রসিদ্ধ স্থান লাভ করে।
ইতিহাসের থেকে পেছনে ফিরলে দেখা যায়, জামালপুরের মহিরামকুল রাজবাড়িতে গঙ্গানারায়ণ চৌধুরী ১৭৭৭ সালে মৃত্যু হলে তার দত্তক ছেলে হরনাথ চৌধুরী চার আনা (৮০ গন্ডা) সম্পত্তির অধিকারী হয়ে কালীপুরে চলে আসেন। কেউ কেউ বলেন, গঙ্গানারায়ণ চৌধুরীই কালীপুরে প্রথম আসেন এবং একটি কাছারি প্রতিষ্ঠা করে আবার মহিরামকুলে চলে যান। ধারণা করা হয় ১৭৭০ সালের মহামারি অর্থাৎ বাংলা ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে গৌরীপুর রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা জমিদার যুগলকিশোর রায়চৌধুরীর নৌবহরে পরিবারসহ গঙ্গানারায়ণ চৌধুরী চলে এসেছিলেন।
হরনাথ চৌধুরীর বিয়ে, মৃত্যু ও দত্তকের অনুমতি:
কালীপুরের জমিদার হরনাথ চৌধুরী পাবনা জেলার পাকুড়িয়া গ্রামের গঙ্গাময়ী দেবীকে জীবনসঙ্গী করেছিলেন। জীবনের নানা সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় বিয়ের পর সুখী দাম্পত্য জীবন। নিয়তি নিষ্ঠুর। অল্পদিনের মধ্যেই হরনাথ চৌধুরী জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ইংরেজি ১৭৯৩ সালে এবং বাংলা ১১৯৯ সালের চৈত্র মাসে ইহলোক ত্যাগ করেন। স্বামীকে হারিয়ে তিনি অনুধাবন করেন, জীবনে সঙ্গীর প্রয়োজন কতটুকু ছিল। মৃত্যুর আগে সন্তানহীনা সহধর্মিনী গঙ্গাদেবীকে, গৌরীপুর রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা জমিদার যুগল কিশোর রায়চৌধুরীর পুত্র শিবকিশোরকে দত্তক নিয়ে পিতৃলোকের শ্রাদ্ধ-তর্পণ করার জন্য অনুমতি দিয়ে যান।
গঙ্গাদেবীর দত্তক গ্রহণ ও দত্তক ছেলে শিবকিশোরের অকাল মৃত্যু :
পিতৃলোকের জলপিণ্ডের সংস্থান করতে স্বামীর আদেশ অনুসারে গঙ্গাদেবী গৌরীপুরের জমিদার যুগল কিশোর রায় চৌধুরীর ছোট ছেলে শিবকিশোরকে বেদ-বিহিত যাগযজ্ঞ করে দত্তক নেন। এই শিবকিশোরও ১৫-১৬ বছর বয়সে বাংলা ১২১৩ ( ইংরেজি ১৮০৭) সালে মারা যায়।
গঙ্গাদেবীর মৃত্যু ও কৃষ্ণনাথকে দত্তক নেওয়া:
দত্তক ছেলে শিবকিশোরের মৃত্যুর পর গঙ্গাদেবী সমস্ত সম্পত্তির অধিকার লাভ করলেন। তিনি নদীর ঘাটে গঙ্গাস্নান উৎসব উপলক্ষে বাংলা ১২২৭ ( ইংরেজি ১৮২১) সালে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত দেবীপুর গ্রামে গমন করেন। সেখানে ২৫ চৈত্র হঠাৎ কলেরা বা ওলাউঠা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি শয্যাশায়ী হন। চিকিৎসকের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হতে থাকে। ওই দিনই গঙ্গাদেবীর মৃত্যু হয়। কথিত আছে, স্বামীর সাধারণ আদেশ অনুসারে মৃত্যুর আগের দিন বালক কৃষ্ণনাথ চৌধুরীকে দত্তক নেন। স্বামী-সন্তান ছাড়া গঙ্গাদেবীর সম্পত্তির পরিণাম চিন্তায় তার বোন যমুনা দেবীর উদ্বেগ ও চতুর্দিকে অশান্তি সৃষ্টি হয়। উত্তরাধিকারের অভাবে এই সম্পত্তি জামালপুরের লাহিড়ীরা দখল করবে, এটা তার পক্ষে অসহ্য বোধ হতে থাকলো।
জমিদার শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায়চৌধুরীর উদ্ধৃতি থেকে জানা যায় যে, “কূটনীতি নিপুণ কর্মচারীগণ ও যমুনা দেবী গভীর চিন্তার পর এক অভিনব উপায় আবিষ্কার করিলেন। সমস্ত কর্মচারী, গুরু ও পুরোহিতের অনুমোদন ক্রমে এই উদ্ভাবিত উপায় অবলম্বিত হইল। গঙ্গাদেবীর মৃত্যুর সংবাদ গোপন করিয়া তাহার পীড়ার সংবাদই বাহিরে প্রচারিত হইল। এদিকে গঙ্গাতীরে যমুনা দেবী তাঁবু উঠাইয়া কৃষ্ণনাথ চৌধুরি নামক বালককে আনাইয়া যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠানপূর্বক গঙ্গাদেবীর দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করাইলেন। গঙ্গাদেবী পীড়িতাবস্থায় এই দত্তক গ্রহণ করিতেছেন ইহাই জনসাধারণে প্রচারিত হইল। কথিত আছে ঐ স্থানে গঙ্গাদেবীর মৃতদেহ বস্তু আচ্ছাদনে রাখিয়া দত্তক গ্রহণ করা হইয়াছিল। দত্তক গ্রহণের অনুষ্ঠান উৎসব শেষ হইলে, গঙ্গাদেবীর মৃত্যু সংবাদ প্রকাশিত হইল এবং মহাসমারোহে তাহার শবদেহ গঙ্গাতীরে দগ্ধ করা হইল। কৃষ্ণনাথ দত্তক পুত্ররূপে গঙ্গাদেবীর শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া সম্পন্ন করিলেন। কূটনীতিজ্ঞের কূট মন্ত্রণা এইরূপে প্রথমাবস্থায় সিদ্ধিলাভ করিল।”
কালীপুরের তিনটি তরফের প্রতিষ্ঠাতা লাহিড়িদের কৃষ্ণনাথকে অসিদ্ধ দত্তক প্রমাণে মামলা:
হরনাথ চৌধুরীর তিন ভাগ্নে উমাকান্ত লাহিড়িরা মামার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী ও কৃষ্ণনাথ অসিদ্ধ দত্তক বলে মামলা করলেন। কৃষ্ণনাথ মামলায় পরাজিত ও অসিদ্ধ দত্তক বলে প্রমাণিত হলেন। মামলা লাহিড়িদের পক্ষেই নিষ্পত্তি হলো।
শত বছর আগের লেখা থেকে জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায় চৌধুরীর উদ্ধৃতি থেকে জানা যায় যে, “বিশেষ প্রমাণার্থ শ্যামাচরণ সরকার মহাশয়ের ব্যবস্থাদর্পণ নামক পুস্তক হইতে উল্লিখিত মোকদ্দমা সংক্রান্ত সদর দেওয়ানি আদালতের নজির নিম্নে প্রদত্ত হইল— অপ্রাপ্ত ব্যবহার কৃষ্ণনাথ চৌধুরি ওসী পরমানন্দ ভট্টাচার্য আপীলেন্ট—বনাম–উমাকান্ত লাহিড়ি প্রভৃতি রেস্পন্ডেন্ট। ৫১৬, ৫১৭ ও ৫১৯ সংখ্যক ব্যবস্থা বিষয়ক :
নজির—“বাংলা ১১৮৩ সালে গঙ্গানারায়ণ চৌধুরি জমিদার হরনাথ চৌধুরি নামে এক পুত্রকে এবং রেস্পন্ডেন্টদিগের মাতা গৌরীদেবী নামক এক দুহিতাকে রাখিয়া লোকান্তর গত হলেন। বাংলা ১১৯৯ সালের ৩রা চৈত্রে হরনাথ নিঃসন্তান মরেন, কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে নিজ পত্নী গঙ্গাদেবীর প্রতি দুই দলিল লিখিয়া দেন ও তাহাতে এক দত্তক পুত্র গ্রহণের সঙ্কুচিত অনুমতি দান করেন। তন্মধ্যে প্রথম দলিল অনুমতি পত্র তাহার মজ্মূল যথা—‘শ্রীমতি গঙ্গাদেবী প্রতি লিখিত মিদং—আমি এমত কাহিল যে আমার জীবন সংশয় এবং আমার পুত্র নাই, তন্নিমিত্তে আমি অনুমতি দিতেছি ঈশ্বর না করেন যদি আমি গত হই, তবে তুমি যুগলকিশোর রায়ের দ্বিতীয় পুত্র শিবকিশোর শর্মাকে দত্তক গ্রহণ করিবে, সেই আমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করিবে ও বিষয়াধিকারী হইবে। আমি এ বিষয়ে যুগলকিশোরকে লিখিয়াছি ; কিন্তু তিনি যদি সম্মতি দিতে অস্বীকার করেন তবে তুমি অন্য কোন ব্রাহ্মণের পুত্রকে দত্তক গ্রহণ করিবে, তদবস্থায় ঐ গৃহীত দত্তক পুত্র আমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করিবে এবং আমার বিষয়াধিকারী হইবে।’ দস্তখতের নিচে এই লিখিত ছিল যে— ‘আমি তোমাকে দত্তক গ্রহণ করিতে ক্ষমতা দিলাম।’————-
১২২৭ সালে গঙ্গাময়ী দেবী মুর্শিদাবাদে গঙ্গাস্নানার্থে গমন করেন ও তথায় ২৫ চৈত্র তারিখে অকস্মাৎ ওলাউঠা রোগে মরেন। কথিত হইয়াছে যে পতির দত্ত সাধারণ অনুমত্যানুসারে মরণের পূর্ব দিবসে তিনি কৃষ্ণনাথ চৌধুরিকে দত্তক গ্রহণ করেন। কালেক্টর সাহেব এবং রেভিনিউ বোর্ড তাহার দত্তকতা স্বীকার করিলেন। রেস্পন্ডেন্টেরা ওই দত্তকতা অসিদ্ধ করিবার নিমিত্তে ঢাকার প্রবিস্যাল কোর্টে কৃষ্ণনাথ চৌধুরি ও তাহার প্ররোচক কালীমোহন ঠাকুর, রমানাথ মুনসী ও শিবনাথ মুনসীর নামে নালিশ করিল। তাহারা হরনাথের স্বাভাবিক উত্তরাধিকারী বলিয়া বিষয় দাওয়া করে। ১৮২৫ সালের ১৫ মার্চ তারিখে প্রবিন্স্যাল কোর্টের চতুর্থ জজ সি ডবলিউ, ইস্টিয়র সাহেব এই মোকদ্দমা নিষ্পত্তি করিলেন। তিনি বিবেচনা করিলেন যে, ওই বিধবা দত্তক গ্রহণ করিতে যোগ্যা ছিল না, কারণ ঐ অনুমতিপত্রে বিশেষ দত্তক গ্রহণে তাহার ক্ষমতা ছিল মাত্র, ঐ বিশেষ দত্তক গৃহীত না হইলে ঐ ক্ষমতা সাধারণ হইত। —— এই নিষ্পত্তিতে অসম্মত হইয়া কৃষ্ণনাথ সদর দেওয়ানি আদালতে আপিল করিলেন এবং ১৮ নভেম্বর তারিখে ঐ মোকদ্দমা আর এইচ, রাষ্ট্রে সাহেবের নিকট দরপেশ হইল। তাহার রায় এই হইল যে, “কৃষ্ণনাথের দত্তকতা সাব্যস্ত হয় নাই, । এই সকল কারণে মিঃ রাষ্ট্রে প্রবিনস্যাল কোর্টের ডিক্রি বাহাল রাখিয়া রেসপন্ডেন্টদিগকে বিষয় দখল দিলেন। ১৮ নভেম্বর ১৮২৮ সাল। সঃ দেঃ আঃ রি, বা, ৪, পৃঃ ৩১৮, ৩১৯।”
কালীপুরে গঙ্গাদেবীর কীর্তি ঃ
গঙ্গাদেবী সৎকর্ম ও দান-দক্ষিণায় খুব অনুরাগী ছিলেন। তিনি মোমেনসিং পরগনার কালীপুরের প্রসিদ্ধ সিদ্ধি কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিয়মিত ভোগ সেবাদানের জন্য সুব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। তার প্রবর্তিত নিয়ম জমিদার আমল পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। প্রতিদিন পথিকরা এই সিদ্ধি কালীবাড়িতে আশ্রয় পেয়ে তার পুণ্য বৃদ্ধি করছিলেন। গঙ্গাসাগর নামে একটি বৃহৎ সরোবর বা পদ্মাদিযুক্ত বড় পুকুর খনন করে স্থায়ী নিদর্শন রেখে গিয়েছিলেন। আরও একটি কীর্তি স্থাপনের জন্য গঙ্গাদেবীর খুব আগ্রহ ছিল কিন্তু সময়ের অভাবে সম্পূর্ণভাবে সফলতা লাভ করতে পারেনি। স্বামীর নামের সঙ্গে নিজের নাম সংযুক্ত করে ‘হরগঙ্গেশ্বর’ নামে দুইটি বৃহৎ শিবলিঙ্গ স্থাপনের উদ্দেশ্যে কালীপুরে তিনি দুইটি সুন্দর মন্দির স্থাপন করে গিয়েছিলেন। দুইটি শিবলিঙ্গ আনা হয়েছিল কিন্তু এগুলো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই গঙ্গাদেবী ইহলোক ত্যাগ করেন।
শত বছর আগের লেখা থেকে জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায় চৌধুরীর উদ্ধৃতি থেকে জানা যায় যে, “এই বিগ্রহদ্বয় এখনও কালীপুরে গঙ্গাদেবীর প্রতিষ্ঠিত দুইটি মন্দিরে আছেন, কিন্তু অদ্যাপি তাহাদের প্রতিষ্ঠা হয় নাই। ওই শিব-মন্দির দুইটিতে আশ্চর্যজনক দুইটি উৎস ছিল। ইহার জল কিভাবে কোথা হইতে আসিত তাহা কেহই বলিতে পারিত না। উভয় মন্দিরে দুইটি করিয়া লোহার নল মাটিতে প্রোথিত ছিল। বৃষ্টি হইলে মন্দিরের মধ্যস্থিত উৎসের জল ঐ দুইটি নল হইতে উঠিয়া শিবলিঙ্গদ্বয়ের উপরিভাগে ক্রমান্বয়ে পড়িতে থাকিত। আজ প্রায় পনের বৎসর হইল ঐ উৎস দুইটি নষ্ট হইয়া গিয়াছে। গঙ্গাদেবীর প্রতিষ্ঠিত আরও অনেক বিগ্রহ এখনও পূজা সেবা পাইয়া সেই কীর্তিময়ীর পুণ্য প্রতিষ্ঠা বৃদ্ধি করিতেছে। “
২০২৩ সালে গৌরীপুরের ঐতিহাসিক কালীপুর এলাকায় জরিপের সময় এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে গঙ্গাসাগর দীঘি এবং ‘হরগঙ্গেশ্বর’ নামে দুইটি বৃহৎ শিবলিঙ্গ স্থাপনের মন্দির বিষয়ে কথা হয়। গৌরীপুর সরকারি কলেজে পিছনে কৃষ্ণপুর এলাকার বাসিন্দা ৭৩ বছর বয়সি দেবব্রত সরকার (ভানু বাবু) জানান, সাড়ে পাঁচশ একর জয়গায় নিয়ে গঙ্গাসাগর নামে একটি বড় পুকুর খনন করা হয়েছিল। বর্তমান পুকুরটি ভরাট করে জায়গা বিক্রি করা হচ্ছে।
স্থানীয় সাংবাদিক দিলীপ কুমার দাস বলেন, ৭০ ও ৮০ দশকে গঙ্গাসাগরের জলের ওপর ফুটে থাকা হাজার হাজার শাপলা, পদ্ম, শালুক ছিল চোখে পড়ার মতো। গঙ্গাসাগরে পাড়ে ছিল দুটি বিশাল তেঁতুল গাছ। ১০-১২ জন ছাড়া এখানে কেউ ভয়ে একা স্নান করতো না।
গৌরীপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পিছনের জায়গায় ‘হরগঙ্গেশ্বর’ মন্দির নিয়ে গৌরীপুরের ধান মহাল এলাকার বাসিন্দা অরুণ ঘোষ (রনু বাবু) বলেন, কালীপুরের কচি-কাঁচায় অবস্থিত হরগঙ্গেশ্বর মন্দিরে কালো পাথরের পাঁচ ফুট উচু এবং তিন ফুট চওড়া আকৃতির বৃহৎ শিবলিঙ্গ দেখেছিলেন। দেশ ভাগের পর তার শৈশবে অর্থাৎ ষাটের দশকে কালীপুরের মন্দির হতে শিবলিঙ্গটি গরুর গাড়ি করে গৌরীপুর জংশনের জাগরাণীর মাঠে মালবাহী বগিতে তুলতে দেখেছেন। তখন জমিদার দ্বারা বৃহৎ শিবলিঙ্গ দুটো গৌরীপুর হতে ট্রেনে কলকাতায় নেওয়া হয়েছিল।
কালীপুর জমিদারির ৮ বছর পর অসিদ্ধ-দত্তক কৃষ্ণনাথের শেষ পরিণতি :
প্রয়াত গঙ্গাদেবীর বোন যমুনাদেবী যে ভয়টা পেয়েছিলেন, তা শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়। আট বছর পর মামলায় হেরে অসিদ্ধ-দত্তক কৃষ্ণনাথ চৌধুরী কালীপুর ত্যাগ করে নিজ বাড়ি মুর্শিদাবাদে যাত্রা করেন। কৃষ্ণনাথ প্রতিভাশালী ব্যক্তি ছিলেন। সঙ্গীত, সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে তার দক্ষতা ছিল। তার নিজ প্রতিভায় সমাজে তিনি যে সম্মান লাভ করেছিলেন, অনেকের ভাগ্যে তা ঘটে না।
কালীপুরের জমিদার কৃষ্ণনাথ চৌধুরী কি নবাব সিরাজউদ্দৌলা’র বংশধর?
হিন্দু জমিদার পরিবারে ব্রাহ্মণ পরিচয়ে বেড়ে ওঠা নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার ঔরসজাত সন্তান, মোমেনসিং পরগনা থেকে ময়মনসিংহ জেলা নামকরণের প্রধান উদ্যোক্তা এবং গৌরীপুর রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা জমিদার যুগলকিশোর রায় চৌধুরীর সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু যেটা বলার, সেটা হচ্ছে – তিনি ছিলেন বৃহত্তর ময়মনসিংহের প্রতাপশালী জমিদার এবং বাংলা, বিহার ও উরিষার নবাব সিরাজউদ্দৌলা’র একমাত্র সন্তান। তার প্রথম স্ত্রী রুদ্রাণী দেবী; তার গর্ভে হরকিশোর ও শিবকিশোর নামে তার দুই পুত্র এবং অন্নদা, বরদা, মোক্ষদা ও মুক্তিদা নামে চার কন্যার জন্ম হয়। দ্বিতীয় স্ত্রী যমুনাদেবীর গর্ভে প্রাণকৃষ্ণনাথ (প্রাণকিশোর) নামে এক ছেলের জন্ম হয়।
একটু পিছন ফিরে দেখা যাক। ১৮১১ বা ১৮১২ সালের কোন এক সময়ে যুগল কিশোরের ৬১ বা ৬২ বছর বয়সে মৃত্যু হয়। কেউ কেউ সন্দেহ করেন কালীপুরের প্রয়াত হরনাথ চৌধুরীর স্ত্রী গঙ্গাদেবীর বোন যমুনাদেবীর আসল পরিচয় কি? তিনি কি যুগল কিশোরের দ্বিতীয় স্ত্রী? কেননা, কালীপুরের জমিদার হরনাথ চৌধুরী পাবনা জেলার অন্তর্গত পাকুড়িয়া গ্রামের গঙ্গাদেবীকে বিয়ে করেন। আবার যুগল কিশোর দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন পাবনা জেলার যমুনাদেবীকে। গঙ্গাদেবী এবং যমুনাদেবীর বাবার বাড়ি একই জেলায় অবস্থিত। ইংরেজি ১৮২১ সালে গঙ্গাস্নান উৎসব উপলক্ষে উভয় বোন বিধবা অবস্থায় ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায় গমন করেন। সেখানে ওলাউঠা রোগে আক্রান্ত হয়ে গঙ্গাদেবীর মৃত্যু শয্যায় থাকা অবস্থায় হঠাৎ কেন যমুনাদেবী খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন? এই ‘নাটক’ কেন করেছিলেন?
আবার কেউ কেউ মনে করেন কৃষ্ণনাথের আসল পরিচয় যুগল কিশোরের দ্বিতীয় তরফের সন্তান প্রাণকৃষ্ণনাথ। কিশোরী বয়সে প্রাণকৃষ্ণনাথ গঙ্গাদেবীর দত্তক পুত্র হয়ে কালীপুরের জমিদারি দাবি করেন এবং সাথে ছিলেন তার মা যমুনাদেবী। আট বছর ধরে কালীপুরের জমিদারি পরিচালনা করেছিলেন। সিলেটে যুগল কিশোরের মৃত্যুর আগে তার জীবন বৃত্তান্ত ও শেষ ইচ্ছার কথা দ্বিতীয় স্ত্রী যমুনাদেবী ও ছেলে প্রাণকৃষ্ণনাথের কাছে বলে যান। যুগল কিশোরের ও নিজের প্রকৃত বংশ পরিচয় জানতে পেরে প্রাণকৃষ্ণ বিস্মিত হন এবং মুর্শিদাবাদে একটি বাড়ি তৈরি করেন।
ব্রিটিশ শাসনকালে এই তথ্য গোপনীয়তা বজায় রাখা সর্ম্পকে তিনি বিশেষভাবে সচেতন ছিলেন। ইতিহাস বইয়ের লেখক জমিদার শৌরীন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী তাঁর ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থে সদ্য প্রয়াত গঙ্গাদেবীর দত্তক পুত্র কৃষ্ণনাথ চৌধুরী ও ভগ্নি যমুনাদেবী সম্পর্কে দুটি বিশেষ ভূমিকার কথা জানাচ্ছেন, “একটি প্রবাদ আছে যে, পতিপুত্রহীনা গঙ্গাদেবীর সম্পত্তির পরিণাম চিন্তায় তাহার ভগ্নী যমুনা দেবীর উদ্বেগ অশান্তির সীমা রহিল না। উত্তরাধিকারী অভাবে এই বৃহৎ সম্পত্তি পর হস্তগত হইবে, ইহা তাহার পক্ষে অসহ্য বোধ হইল। কূটনীতি নিপুণ কর্মচারীগণ ও যমুনা দেবী গভীর চিন্তার পর এক অভিনব উপায় আবিষ্কার করিলেন। সমস্ত কর্মচারী, গুরু ও পুরোহিতের অনুমোদন ক্রমে এই উদ্ভাবিত উপায় অবলম্বিত হইল। গঙ্গাদেবীর মৃত্যুর সংবাদ গোপন করিয়া তাহার পীড়ার সংবাদই বাহিরে প্রচারিত হইল।”
ইংরেজি ১৮০৭ সালে যুগল কিশোর রায় চৌধুরীর প্রথম তরফের ছোট ছেলে এবং কালীপুরের দত্তক পুত্র শিবকিশোরের মৃত্যুর পর গঙ্গাদেবী সমস্ত সম্পত্তির অধিকার লাভ করলেন। আবার কেউ কেউ সন্দেহ বা মনে করতে পারেন, জীবনের বাকী সময় ১৪ বছরের মধ্যে জলপিণ্ডের সংস্থান করবার জন্য গঙ্গাদেবী কেন দ্বিতীয় বার দত্তক নেয়নি? তিনি কি আগে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার জমিদারির উত্তরাধিকার হবে বোনের ছেলে প্রাণকৃষ্ণনাথ? অন্যদিকে গঙ্গাদেবীর জীবিতকালে হরনাথ চৌধুরীর কনিষ্ঠ ভাগ্নে উমাকান্ত লাহিড়ি কালীপুরে থাকে জমি ও খাজানার হিসাবরক্ষক ছিলেন। উমাকান্ত নিজেও দত্তক হওযার একজন প্রার্থী ছিলেন। তবে গঙ্গাদেবী ও হরনাথ চৌধুরী পারিবারিক কারণে আগে থেকেই জামালপুরের মহিরামকুলে বসবাসকারী গৌরীদেবীর তিন ছেলেকে পছন্দ করতেন না। গঙ্গাদেবীর মৃত্যুর পর উমাকান্ত লাহিড়ি বাদী হয়ে হরনাথ চৌধুরীর তিন ভাগ্নে মামার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী ও কৃষ্ণনাথ অসিদ্ধ দত্তক বলে মামলা করেন। ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন না হলে হয়তো যুগলকিশোর রায় চৌধুরীই হতেন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব। ময়ময়সিংহের ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে গেলেন সিরাজ-উদ-দৌলার পুত্র যুগলকিশোর।
কালীপুর জমিদারি হতে পাঁচটি জমিদারবাড়ি উৎপত্তিঃ
বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর চার ভাগের এক ভাগ অংশ হলো কালীপুর জমিদারি। এই জমিদারির মোট সম্পদের পরিমাপ ছিল ৮০ গন্ডা। পর্যায়ক্রমে কালীপুর জমিদারি হতে মোট পাঁচটি জমিদারবাড়ি উৎপত্তি হয়েছিল। জরিপ ও ইতিহাস গবেষণা করে পর্যায়ক্রমে পাঁচটি জমিদারবাড়ি উৎপত্তির ইতিহাস বিভিন্ন পর্বে প্রকাশিত হবে।
[পর্ব-২: ময়মনসিংহের গৌরীপুরে কালীপুর বড় তরফ জমিদারবাড়ির ইতিবৃত্ত; পর্ব-৩: ময়মনসিংহের গৌরীপুরে কালীপুর মধ্যম তরফ জমিদারবাড়ির ইতিবৃত্ত; পর্ব-৪: ময়মনসিংহের গৌরীপুরে কালীপুর ছোট তরফ জমিদারবাড়ির ইতিবৃত্ত; পর্ব-৫: কালীপুর ছোট তরফ জমিদারবাড়ি হতে গৌরীপুরের ভালুকা জমিদারবাড়ি উৎপত্তির ইতিবৃত্ত; পর্ব-৬: কালীপুর ছোট তরফ জমিদারবাড়ি হতে গৌরীপুরের ডি কে লাহিড়ির জমিদারবাড়ি উৎপত্তির ইতিবৃত্ত।]
তথ্যসূত্র:
১. ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার— শ্রী শৌরীন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী (রামগোপালপুর এস্টেট এর জমিদার ও রাজা যোগেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর ৩য় পুত্র)
২. ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ময়মনসিংহের বিবরণ— শ্রী কেদারনাথ মজুমদার
৩. ময়মনসিংহের জমিদারি ও ভূমিস্বত্ব— মো. হাফিজুর রহমান ভূঞা
৪. ব্রিটিশ ভূবিদ মেজর জেমস রেনেলের অংকিত কয়েকটি মানচিত্র
৫. সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে— ভারত উপমহাদেশের অন্যতম কৃতী ইতিহাসবিদ ও প্রফেসর ড. অমলেন্দু দে
৬. নেত্রকোণা জেলার ইতিহাস— আলী আহম্মদ খান আইয়োব
৭. উইকিপিডিয়ার উল্লেখিত শিরোনামগুলো থেকে (ক) গৌরীপুর উপজেলা – উইকিপিডিয়া (খ) কলকাতা – উইকিপিডিয়া (৮) বাংলাপিডিয়া
(৯) ম্যাগাজিন: পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স-২০২০, পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স-২০২১ ও ২০২২ (১০) ইতিহাস অনুসন্ধানী সংগঠন কর্তৃক প্রতিবেদন (এসিক এসোসিয়েশন, ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন ও দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স ) (১১) ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহাসিক নিদর্শন – দরজি আবদুল ওয়াহাব (১২) ময়মনসিংহের রাজপরিবার – আবদুর রশীদ। (13) A Description Of The Roads In Bengal And Bahar and A General Map of the Roads in Bengal (14) The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760- Richard M. Eaton (15) The History of British India- James Mill (16) The history of two forts in Gouripur, Mymensingh ( An article published in the New Nation). (17) David Rumsey Historical Map Collection. (18) New York Historical Society.
মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার:
সাংবাদিক, গবেষক ও ইতিহাস সন্ধানী