ইবলিশ শয়তান: কিয়ামতে পরিণতি
Iblish। The devil। Jin । Human being। World। Muslim। Islam। Allah। Shoytan। Quran । Hadis। Hadith।
হযরত আদম (আঃ)-কে সৃষ্টির পূর্বে এই পৃথিবীতে জীবজন্তু, পশুপক্ষী বা কীটপতঙ্গ কিছুই ছিল না। শুধু জিন জাতি বাস করতো সমস্ত পৃথিবীজুড়ে। ঐ সময়ের জিনদের এক বাদশাহর নাম ছিলো হামুচ। হামুচের ছেলে খবিচের ঔরসে ইবলিশের জন্ম হয় । ইবলিশ শয়তান জন্মের পরে অন্যান্য জিনদের মতো খারাপ কাজে লিপ্ত হয়নি। সে খোদার ইবাদাতে মশগুল হয়ে থাকতো।
ইবলিশ শয়তান জন্মের পর থেকেই আল্লাহর ইবাদাতে নিজেকে ডুবিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে আল্লাহর প্রিয় বান্দাতে পরিণত হতে থাকে। প্রথম আসমান তার দ্বিতীয় আসমান এভাবে আল্লাহ তায়ালা ইবলিশকে শেষ অবধি বেহেশতে নিয়ে যান তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে। তবুও শয়তানের চিন্তা চেতনায় কোনই পরিবর্তন নেই। সে কেবলই আল্লাহর ইবাদাতেই মশগুল থাকতো। অবশেষে আল্লাহ পাক তার উপর অতিশয় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে জান্নাতের কোষাধ্যক্ষ এমনকি ফেরেশতাদের সরদারের দায়িত্ব প্রদান করেন।
কিন্তু বিষ্ময়কর ব্যপার হলো, ইবলিশ শয়তান আল্লাহর এতো প্রিয় বান্দা হওয়া সত্বেও কিভাবে অভিশপ্ত ইবলিশে পরিণত হলো। এই ইবলীস কিভাবে আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দাতে পরিণত হয়েছিলো আর পরে কেনোইবা সে অভিশপ্ত শয়তানে পরিণত হলো, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি আজ আমরা বিস্তারিতভাবে জানতে যাচ্ছি। আর এই জানার মধ্যে আছে আমাদের জন্য এক মহা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
মানব সৃষ্টির পর থেকেই শয়তানের সঙ্গে তার শত্রুতা শুরু। পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু শয়তান। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অবশ্যই শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৫) সবচেয়ে সমস্যা হলো, শয়তান মানুষের ধরাছোঁয়া, স্পর্শ ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া কোনো মানুষের পক্ষে তার প্রতারণা থেকে আত্মরক্ষা করা সম্ভব নয়।
শয়তানের পরিচয় ( Identity)
শয়তান অর্থ বিতাড়িত, বিদূরিত, বঞ্চিত ইত্যাদি। শয়তান হক থেকে বিদূরিত এবং কল্যাণ থেকে বঞ্চিত বলে তাকে শয়তান বলা হয়। এ ছাড়া তার আরো নাম আছে। শয়তানের খাদ্য হলো, হাড়, গোবর ইত্যাদির ঘ্রাণ ও বিসমিল্লাহবর্জিত খাদ্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে খাবার গ্রহণের সময় বিসমিল্লাহ পড়া হয় না, শয়তান তা নিজের জন্য বৈধ মনে করে।’ তার পানীয় হলো মদ, শিকারের ফাঁদ হলো নারী, বার্তাবাহক হলো গণক, কিতাব হলো অশ্লীল কল্পিত গ্রন্থাবলি, কথা হলো মিথ্যা, মুয়াজ্জিন হলো বাঁশি, বাদ্যযন্ত্র, উপাসনালয় হলো বাজার। মহানবী (সা.) বলেন, জিন তিন ভাগে বিভক্ত। এক দল পাখাবিশিষ্ট, বাতাসে উড়ে বেড়ায়। আরেক দল সাপ ও কুকুর (উভয় প্রাণী আদিতে শয়তানের সহায়ক শক্তি ছিল), অপর দল পৃথিবীতে বিচরণ করে। (মুসতাদরিকে হাকিম, হাদিস : ৩৭০২; সহিহ আলবানি, হাদিস : ৩১১৪)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘ইবলিসের নাম ছিল আজাজিল। সে ছিল ফেরেশতাদের মধ্যেও সম্মানী। তার চারটি পাখা।’ তিনি অপর বর্ণনায় বলেন, ‘ইবলিস ছিল ফেরেশতাদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তাআলার নাফরমানি করার কারণে তাঁর ক্রোধে পড়ে শয়তান হয়ে যায়।’ আবু জায়েদ, হাসান, কাতাদাহ প্রমুখ বলেন, ইবলিস জিন জাতির আদি পিতা, যেমন—আদম (আ.) মানবজাতির আদি পিতা। তবে সে ফেরেশতা নয়। গ্রিক ভাষায় তার নাম আজাজিল, আর আরবি ভাষায় হারিস। (তাফসিরে কুরতুবি : ১/২৩৬)
শয়তানের অপরাধ ( Crimes)
শয়তানের প্রথম ও প্রধান অপরাধ আদম (আ.)-কে সিজদা না করা। আদম (আ.)-কে সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই সে হিংসা করে আসছে এবং মানবজাতির ধ্বংস কামনা করত। (তাফসিরে কুরতুবি : ১/২২৬) পৃথিবীতে মানবজাতির আগমনের পরও তার হিংসা ক্রোধে পরিণত হয় এবং মানুষকে বিপথগামী করাই তার একমাত্র কাজ।
শয়তানের আবেদন ( Application)
আল্লাহ যখন শয়তানকে জান্নাত থেকে বের করে দেন তখন সে চারটি বিষয়ের আবেদন করে। তা হলো, ১. আমাকে কিয়ামত পর্যন্ত জীবন লাভ। আল্লাহ তার এ প্রার্থনা কবুল করেন। আল্লাহর বাণী, ‘ইবলিস বলল, আমাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত সুযোগ দিন, আল্লাহ তাআলা বললেন, তুমি সুযোগপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৫)
২. আমার জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। এ আবেদনও কবুল করা হয়।
৩. আমাকে মানুষের দৃষ্টিশক্তির অন্তরাল হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এটিও কবুল করা হয়।
৪. আমি যেন মানবদেহের শিরা-উপশিরায় চলাচল করতে পারি। এ দোয়াও কবুল করা হয়।
মহানবী (সা.) বলেন, ‘অবশ্যই শয়তান আদমসন্তানের শিরা-উপশিরায় বিচরণ করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১২৮৮; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২১৭৪)
শয়তানের চ্যালেঞ্জ ( Challenge)
শয়তান মানুষকে পথভ্রষ্ট করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সে (ইবলিস) বলল, হে আমার পালনকর্তা, আপনি যেমন আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, আমিও তাদের সবাইকে পৃথিবীতে নানা সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করব এবং তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করে দেব। আপনার মনোনীত বান্দারা ছাড়া (তাদের কোনো ক্ষতি আমি করতে পারব না)।’ (সুরা : হিজর, আয়াত : ৩৯-৪০)
আল্লাহ ইবলিসকে বলেন, ‘অবশ্যই যারা আমার বান্দা, তাদের ওপর তোমার কোনো ক্ষমতা নেই; কিন্তু পথভ্রান্তদের মধ্য থেকে যারা তোমার পথে চলে, তাদের সবার নির্ধারিত স্থান হচ্ছে জাহান্নাম।’ (সুরা : হিজর, আয়াত : ৪৩-৪৪)
শয়তানের ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায়
শয়তানের ক্ষতি থেকে বাঁচার বিভিন্ন ধরনের আমল কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। যেমন—
এক. আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা : আল্লাহ বলেন, ‘যখন কোরআন পাঠ করো তখন বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করো (আউজুবিল্লাহ পাঠ করো)।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৯৮)
অনুরূপ সুবহানাল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ, লা হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা ইল্লা-বিল্লাহ, আল্লাহ আকবার, আয়াতুল কুরসি ইত্যাদি পাঠের কথাও এসেছে।
দুই. কাজেকর্মে সতর্কতা : মহানবী (সা.) বলেন, ‘সূর্যাস্তের পর আধাঘণ্টা পর্যন্ত ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখবে এবং বাচ্চাদের ঘরের বাইরে যেতে দেবে না। কারণ এ সময় শয়তান চলাচল করে। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখলে শয়তান প্রবেশ করতে পারে না।’ (সহিহ বুখারি)
তিন. ভালো প্রবণতাকে প্রাধান্য দেওয়া : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আদমসন্তানের ওপর শয়তানের একটি প্রভাব আছে। অনুরূপ ফেরেশতারও একটি প্রভাব আছে। শয়তানের প্রভাব হলো, অকল্যাণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া এবং সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা। আর ফেরেশতার প্রভাব হলো, কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া এবং সত্যের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা। সুতরাং যে ব্যক্তি কল্যাণের অবস্থা উপলব্ধি করে সে যেন জেনে রাখে, এটি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেই হয়েছে। কাজেই তার উচিত আল্লাহর প্রশংসা করা। আর যে ব্যক্তি অকল্যাণের অবস্থা উপলব্ধি করে, সে যেন অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) এ আয়াত পাঠ করেন, ‘শয়তান তোমাদের দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং অশ্লীলতার প্রতি নির্দেশ দেয়।’ (সুনানে তিরমিজি)
চার. নামাজে মনোযোগ সৃষ্টি : উসমান ইবনে আবুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, আমি একবার রাসুল (সা.)-এর কাছে আরজ করি, হে আল্লাহর রাসুল! শয়তান আমার ও আমার নামাজ-কিরাতের মধ্যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এবং তাতে জটিলতা সৃষ্টি করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) তখন বললেন, ‘তুমি যখন তার উপস্থিতি অনুভব করবে তখন তার কুমন্ত্রণা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং তোমার বাঁ দিকে তিনবার থুতু ফেলবে।’ (মুসলিম)
বিচার দিবসে শয়তানের পরিণতি ( Kiamot/ Judgement day)
মানুষের মতো ইবলিসও হাশরের ময়দানে উঠবে। ইবলিস তখন নিজেকে পরিচ্ছন্ন ও পাপমুক্ত রাখার চেষ্টা করবে। আল্লাহর বাণী যখন সব কাজের ফায়সালা হয়ে যাবে তখন শয়তান বলবে, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের সত্য ওয়াদা দিয়েছিলেন এবং আমি তোমাদের সঙ্গে ওয়াদা করেছি। অতঃপর তা ভঙ্গ করেছি। তোমাদের ওপর তো আমার কোনো ক্ষমতা ছিল না। শুধু এতটুকু যে আমি তোমাদের ডেকেছি, অতঃপর তোমরা (আমার ডাকে সাড়া দিয়ে) আমার কথা মেনে নিয়েছ। এখন তোমরা আমাকে ভর্ত্সনা কোরো না, বরং নিজেদেরই ভর্ত্সনা করো। (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ২২)