কর্ণফুলী টানেল হলে বদলে যাবে বাংলাদেশের চিত্র!
কর্ণফুলী টানেল আওয়ামী লীগ সরকারের একটি মেগা প্রকল্প। আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের অনেক উন্নয়ন করেছে। পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর এবার সবার চোখ কর্ণফুলী টানেলের দিকে।
চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী এবং দেশের প্রধানতম বাণিজ্যিক রাজধানী। ৫৭ লাখ ৪০ হাজার মানুষের শহর চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনৈতিক বড় কর্মস্থল। কর্ণফুলী চট্টগ্রামের সবচেয়ে দীর্ঘতম নদী। কর্ণফুলী নদী ১৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। মূলত কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রাম শহরকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে।
কর্ণফুলীর পূর্বপাশের শিল্পাঞ্চল এবং পশ্চিম পাশে সমুদ্র বন্দর, বিমানবন্দর ও মূল নগরীর সাথে সংযোগ স্থাপনকারী উপযুক্ত হিপ্টারল্যান্ড এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি। যাতায়াতের সময় কমিয়ে আনা, যানজট কমানো এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড কোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ হতে প্রয়োজনে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আঞ্চলিক যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত এই টানেলের নাম দেয়া হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান টানেল।’ চট্টগ্রাম বিসিআইএস (বাংলাদেশ-চীন-ইন্ডিয়া মিয়ানমার) করিডোরের তৃতীয় নম্বর স্থানে অবস্থিত। চীনের কুনসিং থেকে শুরু করে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ হয়ে ভারতের কলকাতায় গিয়ে শেষ হবে এ করিডোর।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে স্থলপথে টানেল রয়েছে, তবে সমুদ্র বা নদী তলদেশে টানেল নির্মাণ উপমহাদেশের অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম।
২০১৪ সালে জুনে চীনের সাথে বাংলাদেশের টানেল স্থাপনে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এক বছর পর ২০১৫ সালে ৩০ জুন সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ইয়াং চুয়ানতাঙ্গের উপস্থিতিতে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যবসায়িক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৬ সালে অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শিং জিনপিং আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২০১৭ সালে ৬ নভেম্বর ঋণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ২০১৯ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলের বোরিং কাজের শুভ উদ্বোধন করেন। প্রকল্পটির নির্মাণ কাজের মেয়াদ ধরা হয়েছে পাঁচ বছর। সেই অনুযায়ী ২০২১ সালে ডিসেম্বরে টানেলের নির্মাণকাজ শেষ হবে।
কেন এই টানেল
সরকারি বিভিন্ন তথ্য বিবরণীতে দেখা যায় ওই টানেল নির্মাণের পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। চীনের কুনসিংকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ হয়ে ভারতের সাথে যুক্তকারী করিডোর বেল্ট অ্যান্ড কোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরই) উদ্দেশ্য হচ্ছে :
১. পণ্যসেবা ও জ্বালানির বাজার প্রবেশগম্যতা বাড়ানোর পাশাপাশি অশুল্ক বাধা দূরীকরণ।
২. বাণিজ্য সহজীকরণ ত্বরান্বিত করা, অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করা এবং খনিজদ্রব্য পানি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের যৌথ উত্তোলন ও উন্নয়ন করা।
৩. এশিয়ান হাইওয়ের সাথে সংযোগ স্থাপন করা।
৪. চীনের সাংহাই নগরীর মতো চট্টগ্রামকেও ‘ওয়ান সিটি’ অ্যান্ড টু টাউনের আদলে গড়ে তোলা।
৫. বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে আবর্তিত ব্লু ইউকোনমি সমর্থন দেয়া।
৬. আনোয়ারা উপজেলায় এক্সক্লুসিভ চাইনিজ ইকেনোমিক ও কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনকে আরো সমর্থন জোগানো।
৭. চট্টগ্রাম নগরীতে নিরবিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগের পাশাপাশি বিদ্যমান সড়ক নেটওয়ার্কের উন্নয়ন করা।
৮. পরিবহন কেন্দ্রস্থল হিসেবে চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক শহরকে আরো বেশি শক্তিশালী করা।
৯. কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ের মধ্যে যোগাযোগ ও ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি প্রসার ঘটানো।
১০. কর্ণফুলী নদীর ওপর বিদ্যমান দুই সেতুুর ওপর থেকে যানবাহনের চাপ কমিয়ে আনা।
১১. ব্যবসা বাণিজ্যের প্রধান স্থানের সাথে কর্ণফুলী পূর্বপাশে নির্মীয়মাণ শহরের সংযোগ স্থাপন এবং উন্নয়ন কাজে গতি বৃদ্ধি করা।
১২. কর্ণফুলী নদীর পূর্ব পাশে নতুন শহর ও বসতি বাড়ানো।
১৩. চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান সুযোগ সুবিধা আরো বৃদ্ধি করা।
১৪. ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে নতুন সড়ক যোগাযোগের আরো উন্নয়ন করা।
টানেল প্রকল্পের বর্ণনা
কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে রোড টানেলটি হবে চার লেনের। টুইন টিউব টাইপের মূল টানেলের দৈর্ঘ হবে ৩.৩১৫ কিলোমিটারের বাইরে পতেঙ্গা প্রান্তে ৫৫০ মিটার এবং আনোয়ারা প্রান্তে ৪.৮ কিলোমিটারসহ মোট ৫.৩৫ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোড রয়েছে। আনোয়ারা প্রান্তে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানার কনভয়ের বেল্টের কারণে সেখানে থাকছে ৭২৭ মিটার ফ্লাইওভার ব্রিজ, যা আনোয়ারা উপজেলাকে চট্টগ্রাম নগরীর সাথে সংযুক্ত করবে
প্রবেশের পথ
সরকারের বর্তমান প্রস্তাবিত নকশা অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রবেশ পথ হবে, বিমানবন্দর অর্থাৎ পতেঙ্গা থেকে দক্ষিণ পশ্চিম অংশের কর্ণফুলী নদীর দুই কিলোমিটার ভাটির দিকে নৌবাহিনী এভিনিউয়ের সামনে।
বহির্গমন পথ
কর্ণফুলী নদীর অপরপাড়ে আনোয়ারা প্রান্তে সার কারখানা কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি এবং চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের মাঝামাঝি স্থান দিয়ে।
টানেলের দৈর্ঘ হচ্ছে মোট ৯.৩৯২ কিলোমিটার। ডুয়েল অর্থাৎ দুই লেনের টানেল এইটি। শিল্প ড্রিভেন মেথন পদ্ধতিতে টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। নদীর তলদেশ থেকে টানেলের গভীরতা হবে ১৮ থেকে ৩১ মিটার বা কমপক্ষে ৩৬ ফুট থেকে ১০৮ ফুট পর্যন্ত গভীর।
খনন পদ্ধতি
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় মেশিন এবং চীন থেকে আমদানি করা প্রায় তিন তলা ভবনের সমান উচ্চতার ৯৪ মিটার দৈর্ঘ এবং ২২ হাজার টন ওজনের খননের মূল যন্ত্র টানেল বোরিং মেশিন টিবিএম, দিয়ে মাটি, বালু, এমনকি শক্তমাটি কেটে খনন কার্য সম্পাদন করা হচ্ছে। পাথরের ক্ষেত্রে ড্রিলিং অ্যান্ড ব্লাস্টিং (ডিঅ্যান্ডবি) পদ্ধতি এবং মাটির ক্ষেত্রে প্রথাগত ‘হ্যান্ড মাইনিং’ এর বিকল্প হিসেবে টিবিএম ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
টানেলের অন্যান্য তথ্য
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ আইন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। টানেলের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হচ্ছে চায়না কমিনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি)। অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক অব চায়নার (এক্সিম) মাধ্যমে চীন সরকার। এটি বাংলাদেশে একক বৃহত্তম বিনিয়োগ। ওই টানেলের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ওভি অরূপ অ্যান্ড পার্টনারস হংকং লিমিটেড, ডেভ কনসালট্যান্সস লিমিটেড, এসিই কনসালট্যান্টস লিমিটেড এবং স্ট্যাটেজি কনসালটিং লিমিটেডের সহযোগী এসএমইসি ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড, অস্ট্রেলিয়া ও সিওডব্লিউআই এ/এস ডেনমার্কের জয়েন্ট ভেনসর (এসএমইসি-সিও ডার উমাই জেভি) প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৪২ কোটি টাকা। এই ব্যয়ের চার হাজার ৪৬১ দশমিক ২৩ কোটি বাংলাদেশ সরকার বহন করবে। বাকি পাঁচ হাজার ৩১৯ দশমিক ১৯ কোটি ঋণ সহায়তা দেবে আমাদের বন্ধু দেশ চীন।
কর্ণফুলী টানেল বাস্তবায়নের জন্য অনেকগুলো চুক্তি সরকার বিভিন্ন সংস্থার সাথে করেছে। টানেলের নকশা, নির্মাণ ও কমিশনিংয়ের জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন্স কোম্পানির সাথে নির্মাণ চুক্তির মধ্যে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। অ্যাপ্রোচ রোড, ভায়াডাকী, সার্ভিস ফ্যাসিলিটিজ এবং ইলেকট্রিকেল কন্ট্রোল সিস্টেম ও এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত।