জীবনী

কাজী নজরুল ইসলাম জীবনী | Biography of Kazi Nazrul Islam

বাংলা সাহিত্যের এক বিষ্ময় প্রতিভার নাম কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)। কবিতা, নাটক ও উপনাস্যের মতো সাহিত্যের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে তাঁর ছিলো অবাধ বিচরণ | নিজেই লিখতেন গান, দিতেন সেইসব গানের সুর এবং সেইসাথে গাইতেন গানও। এছাড়াও পাশাপাশি সাংবাদিক হিসাবে ধরেছিলেন পেন এবং করেছিলেন নানা আন্দোলন রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য।

ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানের কারণের জন্য কাজী নজরুল ইসলামকে (Kazi Nazrul Islam) “বিদ্রোহী কবি” হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়।

 

কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম :

 বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে মে , বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ ই জ্যৈষ্ঠ বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। 

 

কাজী নজরুল ইসলামের পিতা ও মাতা :

কাজী নজরুল ইসলামের (Kazi Nazrul Islam)  পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ , মায়ের নাম জাহেদা খাতুন । নজরুল বড় আরাে তিন ভাই ছিলাে , কিন্তু তারা জন্মের কিছুদিন পর – পরই মারা যায় ।

কাজী নজরুল ইসলামের নাম দুখু মিয়া কেন?

নজরুল বড় আরাে তিন ভাই ছিলাে , কিন্তু তারা জন্মের কিছুদিন পর – পরই মারা যায় । সন্তান হওয়ার পর – পরইঅন্যান্য ছেলেরা মারা যাওয়ায় নজরুলের দাদি তার নাম রেখেছিলাে দুখু মিয়া । এই দুখু মিয়াই একদিন মহীরূহ মহাকবিতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথের পর তার মতাে বড় কবি বঙ্গদেশে আর জন্মগ্রহণ করেন নি ।

কাজী নজরুল ইসলামের শৈশব :

 কাজী নজরুল ইসলামের (Kazi Nazrul Islam) শৈশব কেটেছে নানা দুঃখ – কষ্টের মধ্যে । তার পিতা ছিলেন একমাজারের খাদেম এবং এক মসজিদের ইমাম । নজরুলের বয়স যখন দশ বছর তখন তার বাবা মারা যান । ছােট তিন ভাই ও দুই বােন ও বিধবা মায়ের সংসারের সকল বােঝা এসে পড়ে তার কাধে । এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে তাকে হিমসিম খেয়ে উঠতে হয়েছিলাে ।

 ছােটবেলায় নজরুল এক মাদ্রাসায় লেখাপড়া শুরু করেন । তিনি সুললিত কন্ঠে কোরআন তেলওয়াত করতে পারতেন । এ সময় দুষ্টুমির পাশাপাশি নজরুল তার আপন কাকার কাছে ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যেরও নানা পাঠ নিতে থাকেন।

 

কাজী নজরুল ইসলামের শিক্ষাজীবন :

 কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) তার ছেলেবেলায় বরাবরই ছিলেন অস্থিরচিত্তের মানুষ । তিনি বাবার মৃত্যুর পর মাদ্রাসায় পড়া বন্ধ করে প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হন এবং মাত্র দু’বছরের মধ্যে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষা বেশ ভালােভাবেই পাস করে ফেলেন । এগারাে – বারাে বছর বয়সে স্কুলের বাঁধাধরা পড়া ছেড়ে গ্রাম্য এক লেটোর দলে যােগদান করেন । এই লেটোর দলের জন্যে ঐ বয়সেই তিনি চাষার সং , রাজপূত , মেঘনাদবধ ইত্যাদি কয়েকটা পালাগান লিখলেন এবং সুর দিলেন । বয়স কৈশােরে পৌঁছাতেই তিনি লেটোর দলের সর্দার হয়ে গেলেন ।

 আস্তে আস্তে কাজী নজরুল ইসলাম মুখে – মুখে ছড়াগান ও কবিতা রচনায় পারদর্শী হয়ে উঠলেন । এসময় তিনি স্কুলের বাঁধাধরা পড়াশুনা না করলেও বাংলা ভাষায় অনেক বই এবং হিন্দু এবং মুসলমান ধর্ম শাস্ত্রের বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জন করেন ।এরপর তিনি রানীগঞ্জের এক স্কুলে ভর্তি হন । 

কাজী নজরুল ইসলামের গান বাজনা ও কবিতার প্রতি ঝোক :

কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) রানীগঞ্জের এক স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বর্ধমান জেলার মহকুমা শহরে আসানসােলে পালিয়ে আসেন । সেখানে এক রুটির দোকানে পাঁচ টাকা মাসিক বেতনে রুটি বানানাের চাকরি নিলেন ।সেখানকার এক দারােগা কাজী রফিকউদ্দিন গান বাজনা ও কবিতার প্রতি ঝোক দেখে নজরুলকেতার ময়মনসিংহস্থ নিজ গ্রামে কাজীর সিমলায় নিয়ে আসেন । এখানে তিনি তাকে এক স্কুলে ভর্তি করে দেন । কিন্তু পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে আবার রানীগঞ্জে ফিরে এলেন । এর ফাঁকে ফাঁকে নানা ধরনের সাহিত্য আর কবিতার বই পড়ে নিজের জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে লাগলেন ।

কাজী নজরুল ইসলামের সেনাবাহিনীতে যোগ (Solder Life of Kazi Nazrul Islam) : 

 

নজরুল তখন দশম শ্রেণীতে পড়েন , ম্যাট্রিক পরীক্ষার পূর্বে টেস্ট পরীক্ষা এসে গেল । কিন্তু ১৯১৭ সালে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে । কাজী নজরুল ইসলাম স্থির করলেন যুদ্ধে যােগ দেবেন । ১৯১৭ সালে নজরুল ৪৯ নম্বর বাঙালী পল্টনে যােগ দিয়ে গেলেন নওশেরায় । সেখান থেকে করাচীতে । করাচী সেনানিবাসে তার সঙ্গে আলাপ হয় এক সহকর্মী পাঞ্জাবী মৌলভীর সঙ্গে । ফার্সি ভাষায় তার দক্ষতা ছিলাে গভীর । নজরুল তার কাছে ফার্সি ভাষার কালজয়ী প্রতিভা হাফিজ , শেখ সাদী , রুমি , ওমর খৈয়াম প্রমুখের রচনাসম্ভার সম্বন্ধে পাঠ নেন । এখান থেকেই নজরুল সৃষ্টিধর্মী কবিতা , গল্প , গান , গজল , উপন্যাস প্রভৃতি লেখার জন্য অন্তরের তাগিত অনুভব করলেন ।বিভিন্ন ধরনের লেখা লিখে নজরুল কলকাতার নামকরা পত্রিকায় পাঠাতে লাগলেন । সেগুলাে যথামৰ্যাদায় ছাপাও হতে লাগলাে । ১৯১৯ সালে বাঙালী পল্টন ভেঙে দেওয়ায় নজরুল দেশে ফিরে এসে পুরােদমে কবিতা , গান , গল্প , উপন্যাস রচনায় মনােনিবেশ করলেন । 

কাজী নজরুল ইসলামের চলচ্চিত্র :

নজরুল ‘ধূপছায়া ‘ নামে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। এটিতে তিনি একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। ১৯৩১ সালে প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘জামাই ষষ্ঠী’র ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত ‘গৃহদাহ’ চলচ্চিত্রের সুরকার ছিলেন তিনি। গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন ১৯৩৩ সালে পায়োনিয়ার ফিল্মস কোম্পানির প্রযোজনায় নির্মিত চলচ্চিত্র ‘ধ্রুব’ এবং সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন ১৯৩৭ সালের ‘গ্রহের ফের’ চলচ্চিত্রের ১৯৩৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পাতালপুরী’ চলচ্চিত্রের ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৩৮ সালে নির্মিত ‘গোরা’ চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন নজরুল।

কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতা :

মাত্র বাইশ বছর বয়সে নজরুল লিখে ফেললেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘ বিদ্রোহী ’ । এই কবিতাটি রচনা করে কাজী নজরুল ইসলাম  বিখ্যাত হয়ে গেলেন ‘ বিদ্রোহী কবি হিসাবে । দেশে প্রচুর সাড়া পড়ে গেল । এই একটি মাত্র কবিতার জন্য নজরুলকে চিরঞ্জীব পরিচিতি দান করেছে । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাকে সমাদরে স্বাগত জানিয়ে আশীর্বাদ করলেন । তারপরের ইতিহাস বিজয়ের ইতিহাস,  গৌরবের ইতিহাস,অমরত্বের ইতিহাস ।

 “ মে ভুখাহু ’ শীর্ষক প্রবন্ধ ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশের পর ১৯২৩ খ্রি : ১৬ জানুয়ারি রাজদ্রোহের অভিযােগে নজরুলের এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয় ।

 ১৯২৩ খ্রিঃ অক্টোবর মাসে নজরুলের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীনা প্রকাশিত হয় ।

কাজী নজরুল ইসলামের বিবাহ :

 

কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) ১৯২৪ সালের ২৪ শে এপ্রিল প্রমীলা সেনগুপ্তাকে বিয়ে করেন । তার স্ত্রী প্রমীলা পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় মারা যান ।

 ১৯২৬ খ্রীঃ কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয় । সেই সময় কবি কৃষ্ণনগরে লিখলেন কান্ডারী হুশিয়ার , দেশবন্ধুর স্বরাজ পার্টির সম্মেলনে ওই সময়ে লিখে কবি গাইলেন ‘ ওঠরে চাষী জগৎবাসী ধর কসে লাঙল ‘ ।

 ১৯৪৫ খ্রীঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে জগত্তারিনী পদক পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছেন । ১৯৬০ খ্রিঃ ভারত সরকার পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করেন রসােত্তীর্ণ কাব্যস্রষ্টা , অসংখ্য গানের রচয়িতা ও সুরকার কবি নজরুল ইসলামকে ।

  বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর কাজী নজরুল ইসলামকে ১৯৭২ সালে ঢাকায় আনা হয় এবং তাকে জাতীয় কবি হিসাবে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয় ।

কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যু  :

 কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam) ১৯৪২ সালের ৮ ই জুলাই থেকে দুরারােগ্য মূক ও বধির রােগে আক্রান্ত হন ।

একাদিক্রমে বছরের পর বছর মূক ও বধির হয়ে জীবনমৃত থাকা অবস্থায় ১৯৭৬ সালের ২৯ শে আগস্ট চিরবিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকায় পরলােক গমন করেন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে তাকে জাতীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয় ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link