জিজিয়া কর : কারা, কেন, কিভাবে দিবেন?
ইসলামী রাষ্ট্রীয় ব্যাবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে ‘জিজিয়া’। ইসলামের এই দিকটির ব্যাপারে অনেকেরই বেশ অজ্ঞতা রয়েছে। ইসলামের বিভিন্ন দিকের ন্যায় নাস্তিক-মুক্তমনাদের পক্ষ থেকে এখানেও আপত্তি উত্থাপিত হয়। তাদের দাবি হচ্ছে – জিজিয়া একটি শোষণমূলক ব্যবস্থা। সত্যি কি তাই? জিজিয়ার ব্যাপারে এখন কিছু আলোকপাত করা হবে ইন শা আল্লাহ।
জিজিয়া কী? :
জিজিয়া (جزية) শব্দটি جزاء শব্দ হতে উৎপন্ন। এর অর্থ হচ্ছে – মাথা পিছু ধার্য কর, অর্থকর। এটি ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকদের (আহলুয যিম্মাহ বা যিম্মি) উপর ধার্য কর। ‘জিজিয়া’ শব্দটির উৎপত্তি প্রসঙ্গে আলুসী(র.) আল খাওয়ারিজমীর মতের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, এটি ফার্সি ‘গিযইয়াত’ শব্দ হতে গৃহিত (রুহুল মাআনী ১০/৭৮) যার অর্থ খাজনা। যিম্মি’ (ذمي) শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘সংরক্ষিত ব্যক্তি’। শব্দটি দ্বারা তাদেরকে বোঝায় যাদের সাথে যিম্মা (ذمة) বা নিরাপত্তার চুক্তি করা হয়।
ইসলামী রাষ্ট্রে যুদ্ধ করতে সক্ষম অমুসলিমদের নিকট থেকে দেশ রক্ষার দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেবার বিনিময়ে প্রতি বছর যে অর্থ আদায় করা হয়, তাকে জিজিয়া বলা হয়। এর বদলে কেউ যাতে তাদের উপর আগ্রাসন না চালাতে পারে, সে জন্য তাদেরকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেয় ইসলামী সরকার।
জিজিয়ার অর্থ কারা দেবেন ও কেন দেবেন :
মুসলিম শাসককে জিজিয়ার অর্থ পরিশোধ করবেন আর্থিক সক্ষমতা আছে এমন পূর্ণবয়স্ক পুরুষরা। শিশু-কিশোর, নারী, পাগল, দাস-দাসী, প্রতিবন্ধী, উপাসনালয়ের সেবক, সন্যাসী, ভিক্ষু, অতি বয়োবৃদ্ধ এবং বছরের বেশির ভাগ সময়ে রোগে কেটে যায় এমন লোকদের জিজিয়া দিতে হবে না।
অমুসলিমদের কেউ যদি দেশরক্ষার কাজে নিয়োজিত হতে রাজি হন, তাহলে তার জিজিয়া মওকুফ হতে পারে।
যদি ইসলামী সরকার অমুসলিম নাগরিকদের জান-মাল ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা দিতে না পারে, তাহলে তাদের থেকে কোনো প্রকারের জিজিয়া আদায় করা হয় না। বরং আদায়কৃত জিজিয়া ফেরত দেয়া হয়।
ইয়ারমুকের যুদ্ধে যখন রোমানরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিশাল সৈন্য সমাবেশ ঘটালো এবং মুসলিমরা শামের (বৃহত্তর সিরিয় অঞ্চল) বিস্তীর্ণ এলাকা পরিত্যাগ করে একটি ক্ষুদ্র অঞ্চলে নিজেদের শক্তি কেন্দ্রিভূত করতে বাধ্য হল, তখন আবু উবাইদাহ(রা.) নিজের অধীনস্ত সেনাপতিদের নির্দেশ দিলেন যে—তোমরা যে সব জিজিয়া ও খারাজ (ভূমি রাজস্ব) অমুসলিমদের নিকট থেকে আদায় করেছিলে তা তাদের ফিরিয়ে দাও এবং তাদের বলো যে, “এখন আমরা তোমাদের নিরাপত্তা দিতে অক্ষম। তাই যে অর্থ তোমাদের রক্ষা করার বিনিময়ে আদায় করেছিলাম তা ফেরত দিচ্ছি।”
এই নির্দেশ মোতাবেক সকল সেনাপতি অমুসলিম নাগরিকদের তাদের থেকে আদায় করা জিজিয়া ও খারাজের অর্থ ফেরত দিলেন।
এ সময়ে অমুসলিম নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে ঐতিহাসিক বালাযুরী(র.) লিখেছেন, “মুসলিম সেনাপতিগণ যখন শামের হিমস নগরীতে জিজিয়ার অর্থ ফেরত দেন, তখন সেখানকার (খ্রিষ্টান) অধিবাসীরা সমস্বরে বলে ওঠে—
ইতোপূর্বে যে জুলুম-অত্যাচারে আমরা নিষ্পেষিত হচ্ছিলাম, তার তুলনায় তোমাদের শাসন ও ন্যায়বিচারকে আমরা পছন্দ করি। এখন আমরা তোমাদের গভর্নরের [আবু উবাইদাহ(রা.)] সাথে মিলে যুদ্ধ করে হিরাক্লিয়াসের বাহিনীকে দমন করব।”
সেখানকার ইহুদিরা সমস্বরে বলে ওঠে, “আমরা প্রাণপনে যুদ্ধ করে পরাজিত হওয়া ছাড়া কোনো অবস্থাতেই হিরাক্লিয়াসের কোনো প্রতিনিধি আমাদের শহরে ঢুকতেই পারবে না।”
জিজিয়াতে কীভাবে অর্থ নেয়া হয়? :
জিজিয়াতে কি বিশাল পরিমাণ অর্থ নেয়া হয় যার ভারে অমুসলিম নাগরিকরা চিরেচ্যাপ্টা হয়ে যায়? এমন কিছু ধারণা ইসলামবিরোধী মহলে প্রচলিত আছে। চলুন বাস্তবতা দেখে নেয়া যাক!
জিজিয়ার অর্থের পরিমাণ অমুসলিম নাগরিকদের আর্থিক সঙ্গতি অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়। যারা স্বচ্ছল তাদের কাছ থেকে বেশি, যারা মধ্যবিত্ত তাদের কাছ থেকে কিছু কম এবং যারা দরিদ্র তাদের কাছ থেকে অনেক কম নেয়া হয়। আর যার উপার্জনের কোনো ব্যবস্থা নেই অথবা যে অন্যের দান-দক্ষিণার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে, তার জিজিয়া ক্ষমা করে দেয়া হয়। অধিকাংশ ইমামের মতে, জিজিয়ার কোনো বিশেষ পরিমাণ নির্ধারিত নেই । তবে জিজিয়ার কিছু মূলনীতি পাওয়া যায়। এর আলোকে ফকিহগণ জিজিয়ার বিভিন্ন মুদ্রামাণ উল্লেখ করেছেন। এই মূলনীতি ও সাহাবীদের যুগের উদাহরণ এখন উল্লেখ করা হবে।
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকদের উপর সাধ্যের অতীত জিজিয়া চাপানো যায় না। জিজিয়া অবশ্যই তাদের সাধ্যের মধ্যে হতে হবে।
রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেন,
أَلَا مَنْظَلَمَ مُعَاهِدًا، أَوِ انْتَقَصَهُ، أَوْ كَلَّفَهُ فَوْقَ طَاقَتِهِ، أَوْأَخَذَ مِنْهُ شَيْئًا بِغَيْرِ طِيبِ نَفْسٍ، فَأَنَا حَجِيجُهُ يَوْمَالْقِيَامَةِ
অর্থঃ ‘সাবধান! যদি কোনো মুসলিম কোনো মুআহিদ (চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিক) এর ওপর নিপীড়ন চালিয়ে তার অধিকার খর্ব করে, তার ক্ষমতার বাইরে কষ্ট দেয় এবং তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক নিয়ে যায়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি তার পক্ষে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ উত্থাপন করব।’
ইসলাম কি জিজিয়ার দিতে অক্ষম ব্যাক্তিকে নির্যাতন করতে বলে? এ সংক্রান্ত মূলনীতিও আমরা হাদিস থেকে পেয়ে যাই।
উরওয়া বিন যুবায়ের বিন আওয়াম থেকে হিশাম বিন উরওয়ার মাধ্যমে আবু ইউসুফ বর্ণনা করেছেন, উমার(রা.) সিরিয়া থেকে ফেরার পথে এক স্থানে দেখলেন, কয়েকজন লোককে প্রখর রৌদ্রে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি বললেন, ব্যাপার কী? লোকেরা বললো, এদের উপর জিজিয়া অত্যাবশ্যক ছিলো। কিন্তু এরা জিজিয়া পরিশোধ করেনি। তাই তাদেরকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। তিনি বললেন, এরা জিযিয়া পরিশোধ করতে চায় না কেন? লোকেরা বললো, এরা বলছে, এরা কপর্দকহীন। উমার(রা.) বললেন, এদেরকে ছেড়ে দাও। সাধ্যবহির্ভূত বোঝা এদের উপর চাপিয়ো না। আমি রাসুল(ﷺ)কে বলতে শুনেছি, “মানুষকে শাস্তি দিয়ো না। পৃথিবীতে মানুষকে যারা (অন্যায়ভাবে) শাস্তি দেবে, আখিরাতে আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেবেন।”
আমরা দেখলাম, কিছু লোক মূলনীতি না জেনে জিজিয়া দিতে অক্ষম কিছু যিম্মিকে কষ্ট দিচ্ছিলো। উমার(রা.) তা দেখতে পেয়ে তাদেরকে বিরত করেন এবং রাসুল(ﷺ) এর বাণী স্মরণ করিয়ে দেন।
খলিফা উমার(রা.) এর শাসনামলে একজন জিজিয়া সংগ্রহকারী সংগ্রহকৃত জিজিয়া উমার(রা.) এর নিকট অর্পণ করলেন। বিপুল পরিমাণ জিজিয়ার অর্থ দেখে উমার(রা.) বিচলিত হয়ে পড়লেন। উমার(রা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি জনগণের এগুলো চাপিয়ে দেননি তো! তিনি উত্তর দিলেন, “মোটেও না। আমরা শুধুমাত্র উদ্বৃত্ত এবং বৈধ অংশই সংগ্রহ করেছি।” উমার(রা.) জিজ্ঞেস করলেন, “কোনো প্রকারের চাপ কিংবা অত্যাচার ব্যতিরেকে?” তিনি উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ”। উমার(রা.) বললেন, “যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর, আমার শাসনকালে অমুসলিম প্রজাদের উপর অত্যাচার হচ্ছে না। ”
আমিরুল মু’মিনীন উমার(রা.) এর ওসিয়ত ছিল –
“…আমি তাঁকে এ ওয়াসিয়াতও করছি যে, তিনি যেন রাজ্যের বিভিন্ন শহরের আধিবাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করেন। কেননা তারাও ইসলামের হেফাযতকারী। এবং তারাই ধন-সম্পদের যোগানদাতা। তারাই শত্রুদের চোখের কাঁটা। তাদের থেকে তাদের সন্তুষ্টির ভিত্তিতে কেবলমাত্র তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ যাকাত আদায় করা হয়। আমি তাঁকে পল্লীবাসীদের সহিত সদ্ব্যবহার করারও ওয়াসিয়ত করছি। কেননা তারাই আরবের ভিত্তি এবং ইসলামের মূল শক্তি। তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ এনে তাদের দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া হয়। আমি তাঁকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের(ﷺ) যিম্মিদের বিষয়ে ওয়াসিয়াত করছি যে, তাদের সাথে কৃত অঙ্গীকার যেন পুরা করা হয়। (তারা কোনো শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে) তাদের পক্ষাবিলম্বে যেন যুদ্ধ করা হয়, তাদের শক্তি সামর্থ্যের অধিক জিজিয়া যেন চাপানো না হয়।”
১ম খলিফা আবু বকর(রা.) বলেন, “যদি কোনো অমুসলিম বৃদ্ধ অকর্মণ্য হয়ে পড়ে অথবা কোনো বিপদে পতিত হয় অথবা কোনো সম্পদশালী যদি এমনভাবে দরিদ্র হয়ে পড়ে যে তার গোত্রের লোকেরা তাকে সাহায্য করে—এরূপ পরিস্থিতে তাকে জিজিয়া থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। উপরন্তু মুসলিমদের বাইতুল মাল (ইসলামে রাষ্ট্রের কোষাগার) থেকে তার ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যতদিন সে মদীনায় বা ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে বসবাস করে।”
আলী(রা.) আদেশ প্রদান করেন,
“যখন তাঁদের কাছে [ভুমি রাজস্বের] জন্য যাও, তাদের শীত বা গ্রীষ্মের জন্য উদ্বৃত্ত পোশাক বিক্রি করে দিও না। তাদের আহারের খাদ্য, তাদের প্রয়োজনীয় পশু বিক্রী করো না। দিরহামের জন্য তাদের কাউকে কখনো চাবুক মেরো না। অথবা দিরহামের জন্য কখনো তাদের কাউকে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রেখো না। তাদের গৃহস্থলী জিনিসপত্র বিক্রী করো না। কারণ আমরা তো সেটাই গ্রহণ করি যা তাঁদের হাতে আছে। যদি আমার এ আদেশ মেনে না চলো, তাহলে আমার অনুপস্থিতিতে আল্লাহ তোমাদেরকে শাস্তি দেবেন। আর আমি যদি তোমাদের ব্যাপারে কোনো অভিযোগ শুনি, তাহলে তোমরা বরখাস্ত হবে।”
এই মূলনীতি অনুসরণ করে ইসলামী ফিকহ গ্রন্থগুলোতে জিজিয়া সংক্রান্ত বিধান আলোচনা করা হয়েছে। ইমাম ইবনু কুদামা মাকদিসী(র.) উল্লেখ করেছেনঃ
যে সকল অমুসলিম নাগরিক দারিদ্র্যের শিকার ও পরের উপর নির্ভর করে চলে, তাদের জিজিয়া মওকুফ তো করা হবেই উপরন্তু বাইতুল মাল থেকে তাদের জন্য নিয়মিত সাহায্য বরাদ্দ দিতে হবে।
একবার খলিফা উমার(রা.) এক অন্ধ বৃদ্ধকে ভিক্ষা করতে দেখেন। এ সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে তিনি জানতে পারলেন যে সে ইহুদি। উমার(রা.) জানতে চাইলেন, কেন সে ভিক্ষা করতে বাধ্য হয়েছে।
জবাবে সে জানালোঃ জিজিয়া, প্রয়োজন এবং জীবনধারণের চাহিদা।
খলিফা উমার(রা.) হাত ধরে তাকে নিজের বাড়ীতে নিয়ে আসেন, তৎক্ষণাৎ তার প্রয়োজন পূরণ করেন এবং বাইতুল মালের খাজাঞ্চীর কাছে বার্তা পাঠানঃ “এ ব্যক্তি এবং এর মতো অন্য ব্যক্তিদের প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি রাখবে। আল্লাহর কসম, আমরা যৌবনে (জিজিয়া) নিয়ে বার্ধক্যে তাকে কষ্ট দিলে তার প্রতি এটা আমাদের ইনসাফ করা হবে না। সদকা তো নিঃসন্দেহে অভাবগ্রস্ত ও নিঃস্ব ব্যক্তিদের জন্য। আর এ হচ্ছে আহলে কিতাবের নিঃস্ব ব্যক্তি।
খলিফা উমার(রা.) দামেস্ক সফরকালে একস্থানে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত কিছু খ্রিষ্টানকে দেখতে পান। তিনি তাদেরকে সরকারী কোষাগার (বাইতুল মাল) থেকে সাহায্য দেবার নির্দেশ দেন। তাদের জীবন-জীবিকার উপায়-উপকরণ সরবরাহেরও নির্দেশ তিনি দেন।
আবু বকর(রা.) এর সময়ে জিজিয়ার পরিমাণ ছিল যৎসামান্য। সে সময়ে মুসলিমদের দ্বারা বিজিত হিরা অঞ্চলের অধিবাসীর কাছ থেকে বছরে মাত্র ১০ দিরহাম আদায় করা হতো। সংগ্রহ করতেন খালিদ বিন ওয়ালিদ(রা.)।
আমরা দেখলাম যে, জিজিয়ার পরিমাণ যেমন অমুসলিম নাগরিকদের সাধ্যের মধ্যে থাকতে হবে, এ জন্য অন্যায়ভাবে কাউকে নির্যাতন করা যাবে না। তেমনি এটিও বলা হচ্ছে যে তারা যদি দারিদ্র্যের শিকার হয় কিংবা অর্থাভাবে থাকে – উল্টো ইসলামী সরকার তাদেরকে সাহায্য করবে! এমন বেশ কিছু উদাহরণ আমরা উত্তম যুগে ন্যায়পরায়ন খলিফাদের আমল থেকে পাচ্ছি। যারা জিজিয়াকে শোষণমূলক ব্যবস্থা বলতে চান বা ইসলামকে নিষ্পেষণকারী ধর্ম বলতে চান, এই তথ্যগুলো তাদের নিদারুণ ভ্রান্তিকেই পরিষ্কার দেখিয়ে দিচ্ছে। লুটতরাজ আর বর্বরতায় ভরা সেই ৭ম শতাব্দীতে শক্তিশালী জাতিগোষ্ঠীগুলো ভিন্ন ধর্মীদের উপর জোর-জুলুম চালিয়ে যাচ্ছিলো। সেই অন্ধকার যুগে এভাবে অন্য ধর্মের লোকদের সাথে সদাচারণের বিধান দিয়েছিল নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) আনিত ইসলাম। চিন্তাশীলদের জন্য এটি একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে।
যাকাত-জিজিয়া ও শরিয়ানির্ভর ব্যবস্থার ফল :
আমরা এতক্ষন তাত্ত্বিক আলোচনা করেছি। এবার আমরা আমাদের দেশ ও নিকট অঞ্চলগুলোতে ইসলামী শরিয়ানির্ভর শাসনব্যাবস্থার ফলাফলের ব্যাপারে আলোচনা করব, যেখানে যাকাত, জিজিয়া এই জিনিসগুলো প্রচলিত ছিল। এতে আমাদের পক্ষে এই ব্যবস্থার ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রে কীরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা বোঝা সহজ হবে। আমরা অনুধাবন করতে পারব ইসলামী বিধান কি কল্যাণকর নাকি শোষণমূলক অথবা এখানে ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হলে তা কীরকম প্রভাব ফেলতে পারে।
ভারতবর্ষ সর্বপ্রথম ইসলামী শাসন দেখে মুহাম্মাদ বিন কাসিম(র.) এর সিন্ধু বিজয়ের সময়ে। তিনি বিজিত অঞ্চলগুলোতে ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী শাসন কায়েম করেন। এই সময়ের আলোচনা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কেননা সেটি ছিল সালাফে সলিহীনদের (Early righteous Muslims) যুগ। সাহাবীদের যুগ ছিল ১১০ হিজরী পর্যন্ত। মুসলিমরা সিন্ধু বিজয় করে ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে বা ৯৩ হিজরীতে। অর্থাৎ সেই সময়টি ছিল সাহাবীদের যুগের অন্তর্ভুক্ত, দ্বীন ইসলাম তখন নববী আদর্শ অনুযায়ী বিশুদ্ধভাবে পালিত হচ্ছিল। মুহাম্মাদ বিন কাসিম(র.) যখন সিন্ধু বিজয় করেন, তখন তিনি বিজিত অংশে স্থানীয় হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের থেকে জিজিয়া গ্রহণ করেন ও তাদেরকে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেন। তাদেরকে ইসলাম গ্রহণ করতে জোর করা হয়নি বা শোষণও করা হয়নি। মুসলিমরা তাদেরকে নিরাপত্তা প্রদান করে। জাত-বর্ণহীন ইসলামের মহান আদর্শে মুগ্ধ হয়ে বরং স্থানীয় অধিবাসীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলাম গ্রহণ করছিল।
আমাদের দেশ এবং গোটা ভারতবর্ষ সর্বশেষ ইসলামী শাসন দেখেছিল মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব(র.) {আলমগীর} এর সময়ে। সম্রাট আওরঙ্গজেব(র.) ভারতবর্ষে ইসলামী শরিয়া কায়েম করেন। জিজিয়া আরোপের জন্য তাঁকে পশ্চিমা ঐতিহাসিকরা সমালোচনার বাণে বিদ্ধ করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সম্রাট আওরঙ্গজেব(র.) এর গৃহিত ব্যবস্থার ফল কীরূপ ছিল? চলুন দেখে নেয়া যাক।
সম্রাট আওরঙ্গজেব(র.) এর সময়ে মুসলিমদের উপরে যাকাত এবং অমুসলিমদের উপর জিজিয়া আরোপ করা হয়, সেই সাথে অন্য সব কর উঠিয়ে দেয়া হয়। ইসলামের সাধারণ নিয়ম হচ্ছেঃ জনগণের উপর কর আরোপ করা যায় না। আওরঙ্গজেব(র.) ইসলামী বিধান অনুসরণ করে আগের শাসকদের আরোপিত ৮০টি কর উঠিয়ে দিয়েছিলেন। এবং শুধু যাকাত ও জিজিয়া চালু করেছিলেন। এতগুলো কর উঠিয়ে দেয়ার ফলে সে সময়ের হিসাবে ৫০ লক্ষ স্টার্লিং (এক প্রকার ব্রিটিশ মুদ্রা) সমমানের অর্থমূল্যের কর থেকে রাজকোষ বঞ্চিত হয়। রাজকোষের দিকে লক্ষ্য না করে তিনি আল্লাহর বিধান পালনের দিকে জোর দিয়েছিলেন। এভাবে কর উঠিয়ে দিলে স্বভাবিকভাবেই দ্রব্যমূল্যের দাম কমে যাবে এবং জনগণের আর্থিক অবস্থা অনেক ভালো হয়ে যাবে। আল্লাহর বিধান আরোপের ফলে দেশের উপর বারাকাহ আসবে। এবং হয়েছেও ঠিক তাই। সম্রাট আওরঙ্গজেব(র.) এর সময়ে ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দে চীনকে পিছনে ফেলে ভারতবর্ষ পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থনীতিতে (World’s Largest Economy) পরিনত হয়, যার মূল্যমান ছিল প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলার। এর জিডিপি ছিল সে সময়ের সমগ্র বিশ্বের ৪ ভাগের ১ ভাগ। অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক অবস্থা তখন এমনই প্রাচুর্যশালী হয়ে গিয়েছিল। জিজিয়া দিয়ে কেউ ‘শোষিত’ হয়নি। জনগণ কোন অবস্থায় শোষিত হয় – ৮০ টি কর থাকাকালে, নাকি মাত্র ১টি জিজিয়া কর থাকাকালে?
সে সময়ে ইসলামী শাসনের সুফল ও সমৃদ্ধির ছোঁয়া বাংলাতেও লেগেছিল। সম্রাট আওরঙ্গজেব(র.) নিযুক্ত মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খানের আমলে বাংলায় ১ টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেতো। সে সময়ে বাংলা সমৃদ্ধি ও স্বচ্ছলতার এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যা আজও প্রবাদ হয়ে আছে। দুঃখের বিষয় হল মানুষ শায়েস্তা খানের আমলে বাংলার সমৃদ্ধির কথা ঠিকই মনে রেখেছে, কিন্তু ইসলামী শাসনকে মনে রাখেনি।
পরিশেষে বলব, জিজিয়াকে শোষণমূলক ব্যবস্থা আখ্যায়িত করে যে প্রচার চালানো হয় তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। আল্লাহর দেয়া জীবনব্যাবস্থা ইসলামের মাঝে সকল যুগের সকল মানুষের জন্য কল্যাণ নিহিত আছে। তবে একটা কথা না বললেই নয় – জিজিয়া প্রদান করে অমুসলিমগণ হয়তো পার্থিব কিছু সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে পারবে, কিন্তু পরকালে তাদের কোনো অংশ থাকবে না। আল্লাহর নিকট গ্রহনযোগ্য দ্বীন তো একটাই, আর তা হল ইসলাম। পরকালে মুক্তি লাভের জন্য সকলকে সত্য দ্বীন গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ সকলকে সত্য অনুধাবন করার তৌফিক দান করুন।