মারিয়ানা ট্রাঞ্চ নিয়ে যত রহস্য
বলা হয়ে থাকে যে এই খাতের গভীরতা সহজেই একটি পুরো হিমালয়কে গ্রাস করতে পারে। শুনতে অবাক লাগেলেও এটিই সত্য। এই খাতটি উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে বিস্তৃত, যার গভীরতা ১১,০৩৩ মিটার , হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া মাউন্ট এভারেস্টও এই গভীরতায় এক শিশুর মত। বিশ্বের গভীরতম এবং রহস্যজনক এই খাতটি প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমে মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের কাছে অবস্থিত।
ষোড়শ শতকে প্রশান্ত মহাসাগরের এই এলাকাগুলো ছিল স্পেনের উপনিবেশ। স্পেনের রাজা তখন চতুর্থ ফিলিপ। তাঁর রানির নাম ছিল মারিয়ানা। রানি মারিয়ানার সম্মানেই প্রশান্তমহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের নাম রাখা হয়েছিল মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ। এই দ্বীপপুঞ্জের কাছে হওয়ায় ২৫৫০ কিমি লম্বা আর প্রায় ৭০ কিমি চওড়া এই খাতের নাম মারিয়ানা ট্রেঞ্চ।
গভীরতা
এই খাতের গভীরতা মাপার জন্য বহু বছর ধরে তদন্ত চলছে। চেষ্টাও কম হয়নি। তবে বিজ্ঞানীরা 1970 এর আগে সাফল্যের মুখ দেখতে পেলেন না। অনেক বিজ্ঞানী বিভিন্ন সময়ে এই গভীর এবং রহস্যময় খাতে প্রবেশ করেছেন। তবে, 19960 সালের জানুয়ারিতে ফরাসি সাবমেরিন ‘বাথিস্কোপ ক্রেস্ট’ ইতিহাসের গভীরতম ডাইভ তৈরি করেছিল। যদিও এক্সপ্লোরাররা 10,900 মিটারের নিচে নামতে পারে নাই, তুলতে পারেনি কোনো ছবিও। কারণ তাদের যাত্রাটি একটি আশ্চর্যজনক রহস্যময় মেঘে ঘেরা ছিল। মেঘগুলি কিভাবে সমুদ্রের এত নিচে এসেছিল, রহস্যটি এখনও উত্তরহীন।
বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জগুলি আসলে একটি জলের নীচে আগ্নেয়গিরির মাথা। মেরিয়ানা প্লেট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সৃষ্ট সমুদ্রের একেবারে তলদেশে কয়েকশ বছরের আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত নিয়ে গঠিত। এক পর্যায়ে ফিলিপাইন প্লেটটি প্রকৃতির নির্দেশে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ফলস্বরূপ, বিশাল প্রশান্ত মহাসাগরের প্লেট ফিলিপাইন প্লেটের নীচে চলে। ফলস্বরূপ, প্রশান্ত মহাসাগরের জলের নীচে একটি গভীর খাত জন্মগ্রহণ করেছিল। মারিয়ানার দ্বীপগুলো দাঁড়িয়ে আছে এসব প্লেটের ওপরেই।
চ্যালেঞ্জার ডিপ
মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতম অংশকে চ্যালেঞ্জার ডিপ বলা হয়। গুয়াম দ্বীপ থেকে 340 কিলোমিটার দূরে, ইংরেজী বর্ণের V অক্ষরের মত দেখতে এই অংশটি 11,000 মিটারেরও বেশি গভীরতার সাথে বিশ্বের গভীরতম বিন্দুও। ‘চ্যালেঞ্জার 2’ নামে একটি জাহাজের নাবিকরা প্রথমে এই অংশটি খুঁজে পেয়েছিল। এটি অনুমান করা হয়েছে যে সূর্যালোক সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক হাজার মিটার অবধি পৌঁছতে পারে, তারপর শুধু অন্ধকার, ঘন কালো জল আর রহস্যময় আরেক জগতের ইশারা।
স্বাভাবিকভাবেই, 11 কিলোমিটার গভীর চ্যালেঞ্জার ডিপ পর্যন্ত সূর্যের আলো পৌঁছানোর কোনও সম্ভাবনা নেই। এটি সূর্যের আলো পৌছানো অসম্ভব। এটি পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে খুব নিচে অবস্থিত, সুতরাং সেই অংশটির তাপমাত্রাও অসম্ভব রকমভাবে কম। তাই দক্ষিণ মেরুর শীতলতম অংশের চেয়ে হাড়-শীতল করা তাপমাত্রা থেকেও এখানের তাপমাত্রা অনেক কম। এখানে শীতকালে পানির ঘনত্ব স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। সহজ কথায় বলতে গেলে এই খাতটি বিশ্বের সবচেয়ে শীতলতম বিপজ্জনক অঞ্চল। গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে জলের চাপও বাড়ে। 11,000 কিমি গভীরতায় এই শক্তিশালী জলের চাপটি কেমন হতে পারে আপনি কল্পনা করেন তো? জলের সেই অতিমানবিক চাপ স্টিলকে অনায়াসে বাঁকিয়ে দিতে পারে।
ক্ষেত্রের এই অস্বাভাবিক গভীরতায় ক্যালসিয়াম পানির চাপের মধ্যে দ্রবীভূত হয় এবং ক্যালসিয়াম দ্রবীভূত হলে প্রাণীদের মধ্যে হাড়ের গঠন সম্ভব হয় না, এটাই বিজ্ঞান বলে। কিন্তু এখানেও মিলেছে এক বিস্ময়কর তথ্য,,,যেখানে এত গভীরতা এবং পানির এত চাপের মধ্যে কোন প্রণীর হাড় গঠনও সম্ভব নয়, সেখানে তারা লক্ষ্য করলো কিছু অদ্ভুত রকমের প্রাণীর!
নাবিকদের দ্বারা এই আশ্চর্যজনক এবং রহস্যময় ক্ষেত্রটি সম্পর্কে বিভিন্ন গল্প ছড়িয়ে আছে। যদিও তারা প্রথমে হেসেছিলেন, তবুও এক্সপ্লোরারদের মনে বিষয়টি কিছুটা খটকা লেগেছিল। ফরাসি সাবমেরিন ‘বাথিস্কাপ ক্রিয়েস্ত’এর দুইজন উচ্চপর্যায়ের ইঞ্জিনিয়র জাক পিকার আর মার্কিন লেফটেন্যান্ট ডোনাল্ড ওয়ালশ লক্ষ করেন অতো গভীরে দৈত্যাকার জলের চাপের মধ্যেও প্রাণের উপস্থিতি। অভিযান চলাকালীন তাঁরা না কি জলের মধ্যে এক ভয়ংকর দানবাকৃতি জীব দেখতে পান। পানির চাপে এমন বিশাল দৈত্যাকার প্রাণীটি কোথা থেকে এসেছিল যেখানে প্রাণীদের পক্ষে হাড় গঠন সম্ভব নয়? দু’জনের কারোরই প্রশ্নের উত্তর ছিল না।
তাদের মতে, সেই দৈত্য প্রাণীটি আমাদের জানা প্রাণীদের মধ্যে নয়। প্রাণীটি কিছুক্ষণ সাবমেরিনের দিকে তাকাল এবং তারপরে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। বহু খোঁজাখুঁজি চালিয়েও তাকে দেখা যায়নি আর কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন যে, এটা ছিল সম্পূর্ণ অজানা একটা সামুদ্রিক প্রাণী , আবার অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন যে, সেটা ছিল এমন একটা প্রাণী যেটা বহু বছর আগে আমাদের পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু বাস্তবে সেই প্রাণীটা আসলে কি ছিল? এটার উত্তর আসলে আমাদের কারো জানা নেই।
এই ঘটনার ঠিক 25 বছর পরে কিছু আমেরিকান বিজ্ঞানী মারিয়ানা ট্রেঞ্চ নিয়ে নতুন গবেষণা শুরু করেছিলেন। উনাদের সাবমেরিনটির নাম ছিল “গ্রম্মার চ্যালেঞ্জার”। আর এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল গভীর সমুদ্রের শব্দ রেকর্ড করা। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই ধাতুর তৈরি একটি গোলক জল-নিরোধক বস্তুকে মোটা তার দিয়ে বেধে জলে নামানো হয়। কিন্তু সেখানেও ঘটে এক আশ্চর্য বিপত্তি। জলের মধ্যে গোলকটি নীচে নামানোর জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে, গবেষণা দলটি অবাক হয়ে অবাক হয়ে দেখল যে গোলকটিকে অমানবিকভাবে কে যেন নিজের দিকে টানছে, যেন কেউ এটিকে নীচের জলের গভীরে টানছে। পরিস্থিতি অনুকূল নয় বলে বুঝতে পেরে বিজ্ঞানীরা তারের সাহায্যে ধাতব গোলকটিকে উপরের দিকে টানতে চেষ্টা করলেন। যদিও তারা প্রচুর টানাটানি করছিলো গোলকটিকে জল থেকে তুলার জন্য, তবুও এটি জল থেকে যেন উঠছিলোই না। মনে হচ্ছিল দৈত্যিক শক্তি সম্পন্ন কেউ এটিকে জলের গভীরে টেনে নিয়েছে। কিছুক্ষণ টানার পরে, তারা হ্যাঁচকা টান দিয়ে গ্রুপ গোলকটিকে আলগা করে ফেলল । তখন, বিজ্ঞানীরা জল থেকে টেনে তোলার সময় গোলকটি দেখে হতবাক হয়ে গেলেন। মনে হয়েছিল যেন কেউ সেই শক্ত ধাতব গোলকটি কামড়, দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে। ধাতব গোলকটির উপর অজানা ভয়ংকর দাতের দাগ দেখেতে পেলো তারা। এমনকি গোলকের সাথে সংযুক্ত তারটির ও একি অবস্থা ছিল।
এই ঘটনায় বেশ ভয় পেয়ে যান বিজ্ঞানীরা। অনুমান করা হয় কোনও বিশালাকার প্রাণী দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে রেখেছিল ওটাকে। গোল বস্তুটির মধ্যে দাঁতের দাগ, ছিন্নভিন্ন তার এবং আগের রিসার্চের তথ্যের ভিত্তিতে বেশ কিছুদিন ধরে গবেষণা করার পর বিজ্ঞানীরা যা অনুমান করেন তা রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। তথ্যপ্রমাণ মিলিয়ে মারিয়ানা খাতের ওই রহস্যময় অপরিচিত প্রাণীটার সাথে ‘মেগালোডন‘ হাঙরের বড় মিল খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
মেগালোডন হাঙ্গর
ভাবছেন তো, কে এই মেগালোডন! প্রাচীন বিশ্বের বৃহত্তম হাঙ্গর বলা হয় মেগালডন কে। বৈজ্ঞানিক নাম Carcharoclaus megalodon। এই প্রাগৈতিহাসিক হাঙ্গরের ওজন 48 টন এবং প্রায় 55 ফুট লম্বা ছিল। মেগালডন আজ আমাদের বর্তমান সাগরের হাঙ্গরগুলির আকারের প্রায় তিনগুণ বেশি ছিল। তাদের খাবার ছিল তিমি এবং ডলফিন। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়টি হলো , মিলিয়ন বছর আগে এই প্রাণীটি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তাহলে কি ম্যাগালোডনগুলি একেবারে হারিয়ে যায় নি? মারিয়ানা সেক্টরের বিপজ্জনক গভীরতায় তাদের কিছু বংশধর কি এখনও বেঁচে আছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি আজও।
তার কয়েক বছর পরে, একটি জাপানি জাহাজ মারিয়ানা ট্রেঞ্চে এর মধ্যদিয়ে চলাচল করছিল। হঠাৎ জাহাজের সামনে একটা বড় ঢেউ উঠল। তরঙ্গগুলি এত দুর্দান্ত ছিল যে জাহাজটি ডুবে যাচ্ছিল। এই মুহুর্তে, নাবিকরা লক্ষ্য করলেন যে জাহাজের সামনেই কেবলমাত্র ঢেউ বইছে। বাকী চারপাশে ঢেউ বা ঝড়ের চিহ্ন নেই। সমুদ্রও শান্ত। নাবিকরা হতভম্ব হয়ে গেল। তখনি তারা লক্ষ করল যে, তাদের জাহাজের প্রায় নিচ দিয়ে চলে যাচ্ছে একটা কালো বিরাট কিছু। সেটা কী ঠিকমতো বোঝার আগেই ঢেউয়ের নীচে হারিয়ে যায় সেই রহস্যময় কালো প্রাণীটি।
প্রশান্ত মহাসাগরে রহস্যের শেষ নেই। বলা হয়ে থাকে যে এই মহাসাগরের মাত্র 5 শতাংশ জানা গেছে, বাকিসব এখনও রহস্যের কবলে রয়েছে। মারিয়ানা খাতের কথা কি আর বলব! কয়েক যুগ আগে থেকেই সময় যেন থেমে আছে সেখানে। মেগালোড়নের উপস্থিতি নিয়ে সংশয় থাকলেও, এই খাতের গভীরে আরও যেসব আশ্চর্য প্রাণীর দেখা মিলেছে, তারাও কম রহস্যময় নয়! ১১০০ মিটার জলের এই চাপ, এত হিমশীতল ঠান্ডা সহ্য করেও এই প্রাণিরা সেখানে কিভাবে বেঁচে আছে! সেটাও আমাদের কাছে একটা রহস্যই রয়ে গেছে।
আমাদের চেনা জগতের বাইরের অজানা আরেক জগৎ যেন বেঁচে আছে এই মারিয়ানা খাতের বুকে, বিজ্ঞানীরা আজও কূলকিনারা পায়নি যার। সত্যিই কি প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীরা বেঁচে আছে সমুদ্রের নীচে রহস্যময় অন্ধকারে? না কি, ভিনগ্রহের দৈত্যাকার কোনও জন্তু ঘাঁটি গেড়েছে পৃথিবীর গভীরতম তলদেশে? এই রহস্য এখনও প্রশান্ত মহাসাগরের অনন্ত জলের গভীরেই চাপা পড়ে আছে।