মৃত্যু ক্ষেত
মৃত্যু ক্ষেত
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই আহার সংগ্রহে নেমেছে হরিণ। রাতের আধারে ঘুম তার আসে না এখন আগের মতো করে।তাই তো অপেক্ষা করে রাতের প্রহর কাটানোর। সবুজ টিয়ে পাখিটা বরাবরের মতোই কানের কাছে টুপ করে একটা মাটির ঢেলা ফেলে জাগিয়ে তোলে তারে। আজ তার বড্ড ক্ষুধা লেগেছে।
একমনে কচি সবুজ ঘাসগুলো খেয়েই চলেছে হরিণ। কিন্তু তার খাওয়ার মাঝে বিরক্তির সুর ভেসে আসে দূর থেকে-
পালাও পালাও, মৃত্যুক্ষেতে ঢুকে পরেছো তুমি। দৌড়াও আরো জোড়ে দৌড়াও। দূর থেকে এক হরিণির আত্মচিৎকার এ দৌড়াতে থাকে হরিণ। নিজের অজান্তেই কখন যে বাঘ মামার রাজ্যে ঢুকে পরেছে টের এ পায় নি সে।কিছুদুর দৌড়ানোর পর..
হরিণিঃ এভাবে কেউ সকাল সকাল বাঘের এলাকায় ঐ মৃত্যু ক্ষেতে ঢুকে পরে তাও ঘাস খেতে?? (কণ্ঠে রাগ আর বিরক্তি ভরা হরিণির। কিছুদিন হয় এ বনে তার পরিবার সহ হরিণি পাড়ি জমিয়েছে। তাদের আগের আবাস পুরাটাই বন্যার জলে প্লাবিত, কিছুদিনের জন্য তাই এ বনেই অন্যান্য হরিণের সাথে বসবাস তাদের)
হরিণঃ ওহ মনে ছিল না। ঘাসগুলো অনেক কচি ও সুন্দর ছিল তাই ভেবেছিলাম বাঘ তো এখনো ঘুমাচ্ছে খেয়ে আসি এই ফাঁকে।
হরিণিঃ জানো না সুন্দরের আড়ালে রিক্ততা গা ঢাকা দিয়ে থাকে?? (ধমকের সুরে বললো হরিণি। আসোলে এখানে এসেছে থেকেই হরিণের প্রতি একটা আলাদা টান তৈরি হয়েছে তার)
হরিণঃ জানি বলেই তো বারবার সুন্দরের প্রতি ছুটে যাই। আবার নিজেরে পোড়াতে চাই সেই ভয়াবহ সৌন্দর্যে।
এই একপাশ দিয়ে হরিণকে বিরক্ত লাগে হরিণির। কোন কিছুর সহজ উত্তর সে বুঝি জানে না নাকি দিতে চায় না!!
হরিণিঃ অত বুঝি না বাপু। আজ নাহয় আমি বাঁচাইলাম। এর পরে কে বাঁচাবে??
হরিণঃ বেঁচে থেকেই বা কি!! একদিন তো ঠিক এ বাঘের পেটে যেতে হবে।
এ কথার প্রতিবাদ করতে যাবেই কি মনে করে রাগে গজগজ করে চলে গেলো হরিণি।
গল্পের হরিণকে আপনারা যতটা বিরক্তিকর আর একগুঁয়ে ভাবছেন তা কিন্তু না সে। ছোটবেলায় বাবা-মা কে হারিয়ে যুদ্ধ করে বড় হতে থাকে দলের অন্য সকলের সাথে। সেখানেই এক মায়াবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে একসাথে জীবন যাপন শুরু করে। কিছুসময় পর ৩ টা বাচ্চার তিড়িংবিড়িং লাফে মুখোরিত থাকতো তাদের পুরা হরিণের দল। পাশেই ছিল বাঘ রাজ্য। যেখানে পুরা এলাকাটাই ছিল কচি ঘাস আর সবুজ আরণ্যে পরিপূর্ণ। তবে সেখানে ঐ ঘাসের নেশায় একবার যে গেছে মৃত্যুক্ষেত থেকে সে আর ফিরে আসে নি।
কথায় আছে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। হরিণের মায়াবতী আর তার তিন বাচ্চা সেখানেই যায় খাদ্য আহরণে। ফলে নিজের চোখের সামনেই প্রাণের মায়াবতীর মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে বন ছেড়েই চলে যেতে চেয়েছিল সে। পারে নি শুধু দলের অন্যদের কথা চিন্তা করে।
এখন আমাদের হরিণ অনেকটাই বয়স্ক। কিন্তু এখনো তার মাঝে আরো তিনটা হরিণের শক্তি বিরাজমান। সুদর্শনচক্র যেনো তাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বাদে দিয়েছে এ জীবদ্দশায়। বিকেলে দলের বৈঠক শেষে যখন সে মৃত্যু ক্ষেতের পাশে এসে একমনে পুরাতন স্মৃতি চারণে ব্যস্ত তখন লাফিয়ে লাফিয়ে আমাদের গল্পের হরিণি এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। সেদিকে হরিণের একটুও ভ্রুক্ষেপ নেই।সে যে এখনো তার মায়াবতীর নেশায় বুদ।
হরিণিঃআর কত ওই মৃত্যুক্ষেতের দিকে তাকিয়ে থাকবে!!ওই রিক্ত হৃদয়ে একটু কি এই হরিণির ঠাই দেওয়া যায় না??
হরিণঃ.. (একবার হরিণির দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ হয়ে যায়)
হরিণিঃ তোমার, আমার নৃসিত কণ্ঠ কি আদৌও অতটা সুশীল লাগে না যতটা আর দশটা হরিণ বলে বেড়ায়?? আমার চোখে কি আদ্যিপন্তেই কোন মায়া নেই যে কারণে অন্য হরিণেরা একবার চোখ ফেললে আর সরাতে চায় না??
হরিণ নিশ্চুপ।।
হরিণিঃ তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ না??
হরিণঃ আমি আর সুন্দরের রূপে নিজেরে পোড়াতে চাই না। ওয় মায়াবী চোখে নিজেরে ডোবাতে চাই না,বলেই উলটো পথে হাটা শুরু করল হরিণ।
যাক তাহলে হরিণ হরিণির কচি রূপ উপলব্ধি করেছিল! ওই চোখে একবারের জন্য হলেও চোখ রেখেছিল?? এর চেয়ে সুখকর আর কিইবা হতে পারে আমাদের হরিণির জন্য!! এতটুকুতেই সন্তুষ্ট হয়ে হরিণের পথচলা চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকলো হরিণি।
(আসোলে সত্যিকার অর্থেই হরিণি তার রূপ লাবণ্যে পুরো বনটাই মাতিয়ে রাখে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।কিন্তু কি এক অজানা কারণে কেনো জানি এই বয়স্ক দৃঢ়্মনা হরিণকেই তার অনেক বেশি ভালো লাগে তা সে নিজেও জানে না)
এভাবেই চলতে থাকে হরিণির হরিণকে মাতানোর অভিপ্রায় আর হরিণের তাকে নাকোচ করে কোনরকম পালিয়ে বাঁচার পয়গাম। হরিণ যে হরিণিকে অপছন্দ করে এমনটাও না। তবে সে পরিবার হারিয়ে অন্য এক চিন্তায় বুদ থাকে সবসময়। সে চিন্তা একটুপর এ জানব আমরা।
হরিণ বিশ্বাস করে সে ছোট থেকেই যখন হারিয়েছে সব তো নতুন যাই তার হৃদমাঝারে ঠাঁই নিক তাও ঠিক একদিন ঝড়ে যাবে। বারবার জীবনে ব্যর্থ হওয়ার ইচ্ছা তার আর নেই।
হঠাৎ এ একদিন খবর এলো বনের যে একমাত্র বাঘের জন্য তারা মৃত্যুক্ষেতের কচি ঘাসগুলো ঠিকমতো খেতে পারে না সে বাঘ নাকি খুব অসুস্থ।যেকোন দিন তার মৃত্যু হতে পারে।। এখবর শুনেই আমাদের হরিণের চোখ মুখ আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠে।তবে কি সেই দিনটি দূরে নয় যার জন্য সে অপেক্ষা করছিল!! যে বাঘ তার সুন্দর সাজানো পরিবারটাকে শেষ করে দিয়েছে সেই মৃত্যুক্ষেতে বাঘকে সে আর তার দল এখন উচিত শিক্ষা দিবে বলে বৈঠক এর আয়োজন করে। ঠিক হলো যেহেতু রাতেই বাঘ শিকারে বের হয় তবুও সন্ধ্যা হওয়ার আগেই তারা বৃদ্ধ বাঘকে ধরাশায়ী করে ফেলবে তার অসুস্থতার সুযোগে। যদিও সে অসুস্থ তবুও কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না তারা।
মৃত্যুক্ষেতের দিকে আগমণ করল সে তার দলবল নিয়ে। নিজের জন্য না হলেও গল্পের হরিণি গেলো শুধুই তার হরিণের জন্য। কিন্তু গুহার কাছে আসতেই তাদের এতদিনের সব ধারণা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। সবাই জানতো এতদিন শুধু বাঘ ছিল মৃত্যুক্ষেতে। আর বাঘিনী গেলোবার বন্যায় ভেসে অন্যবনে চলে গেছে।কিন্তু বাঘিনীর আগমণ কেউ টের পায় নি এতদিন। বাঘের সাথে বাঘিনীকে দেখে দলের অন্যসব হরিণ দৌড়ে পালালো জীবন বাঁচাতে ।থেকে গেলো শুধু আমাদের হরিণ আর তার মায়ায় মন্ত্রমুগ্ধ হওয়া হরিণি। এদিকে বাঘিনী যদিও শিকার করে না সচরাচর তৎপর তার অসুস্থ বাঘকে রক্ষায় সে দুই থাবায় দুই হরিণ আর হরিণিকে ধরাশয়ী করে ফেললো।এদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে হরিণ বারবার হরিণিকে পালাতে বললো।
বেচারি হরিণির এক কথা..
“যাকে ভালোবেসে এতদূর এসেছি তাকে রেখে বাকিটা জীবন কিভাবে আধমরা হয়ে বাঁচব? তোমার মতো আমি নিজেকে ধুকে ধুকে মেরে ফেলতে পারি না”- হায় মায়া!! কে বলে আবেগ দিয়ে কিচ্ছু হয় না?? হরিণির এই আবেগ আর ভালোবাসার কাছে শেষমেস হরিণ হেরে গিয়েছে। হরিণির জন্য হরিণের অশ্রুসিক্ত নয়ন যেনো বারবার বলে দিচ্ছে
” বিশ্বাস কর হরিণি আমিও তোমায় অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। আজকের এই যুদ্ধে যদি বেঁচে ফিরতাম তবে আমিও মায়াবতীর ন্যায় তোমাকে নিয়ে আবার পুরো বন মাতিয়ে বেড়াতাম।মৃত্যুক্ষেতে এসে সেই কচি ঘাস খেয়ে দুজন দুজনাতে হারিয়ে যেতাম”
কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেড়ি হয়ে গেছে। অসুস্থ বাঘ তখন হরিণির বুকে আর বাঘিনী হরিণের বুকে চেপে বসেছে।
তারপর যা ঘটলো তাদের সাথে সেই বিদীর্ণ ঘটনার বর্ণনা দেওয়া কোনভাবেই সম্ভব না লেখকের পক্ষে।
সুন্দরের সৌন্দর্য যখন বিগলিত হতে শুরু করে তার চেয়ে কুৎসিত চিত্র বুঝি এ জগতে আর হয় না…
© লেখক
© মোঃ রিয়াজুর রহমান রিয়াজ।
পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ,