আইসিইউ এর বাইরে থেকে বলছি
সকাল নয়টা বাজতে চলেছে।ডাঃলুতফর রহমান হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়াে করে তৈরি হচ্ছেন।
একটার পর একটা কল আসছে।মনে হচ্ছে তাকে ছাড়া হাসপাতাল অচল।এমন সময়,”আজকে কি না গেলেই নয়?দেশে আবার সাতদিনের কঠোর লকডাউন দিয়েছে!!”বলে হাতটা জড়িয়ে ধরে লুতফর সাহেবের
ছেলে।
ছােট বাচ্চা হলে হয়তাে চকোলেটের লােভ দেখিয়ে হাসপাতালে যেতেন।কিন্তু ফরহাদ তাে আর বাচ্চা ছেলে নয়। সে তাে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে।তাকে লুতফর সাহেব কিভাবে চকোলেটের লােভ দেখান?লুতফর সাহেব আস্তে করে বললেন,”আজকে তাে যাই।তারপর দেখা যাবে।”
ফরহাদ বলল,”করােনার সংক্রমণটা আবার বেড়েছে,তাই বলছিলাম আরকি।আর তাছাড়া তােমার বয়সটাও তাে আর কম হল না!একবার করােনা ধরলে ছাড়বে,বল?“ফরহাদের কথা শুনে হেসে ফেলেন লুতফর সাহেব।“যার এমন একটা ছেলে আছে তাকে কি আল্লাহ।
করােনা হতে দিতে পারে?“একথা বলে সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে যান লুতফর সাহেব।মুখে হাসি লেগে থাকলেও মনের ভেতর যে ভয় আছে সেটা স্বীকার না করে পারা যায় না।
লুতফর সাহেব যাওয়ার পর সাধারণত অনলাইনে ক্লাস করতে বসে ফরহাদ।কিন্তু করােনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়াএ আজকে আর ক্লাস হল না।ফরহাদ বিছানায়।
শুয়ে নেট চালাতে চালাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেই টের পায় না।মায়ের ডাকে যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন দুপুর ২ঃ৩০ টা।কোনমতে গােসল করে খেয়েদেয়ে এসে আবার নেটে ফেসবুক চালাত বসে।
হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে ফরহাদ।এখন প্রায় ৪ টা বাজতে চলেছে।তার বাবা তাে এত দেরি করে৷
?বাবার ফোনে রিং দেয় ফরহাদ।কিন্তু ফোন সুইচ অফ। কেমন একটা খারাপ লাগা শুরু হয় ফরহাদের।আনমনেই মায়ের পাশে গিয়ে বসে সে।“বাবার কোন খবর পেয়েছ?” তার মা চোখ না তুলেই অভিমানের সুরে বলল,“তাের বাবার দেরি হলে একটা ফোন করলেও পারে।কত চিন্তা হয় আমার!এটা কি তাের আব্বা বুঝে না?”মায়ের চোখ যে ভিজে গেছে তা বলে দিতে হয় না।
এমন সময় ফরহাদের মায়ের ফোনে একটা রিং আসল। বেশ কিছুক্ষণ কথা হল।ফোন রেখে দিয়ে মা বলল,“তাের আব্বার হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।তখনি হাসপাতালে ভর্তি
করা হয়।আমাদের দেখে আসার জন্য বলছে।”
কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে ফরহাদ।কোনমতে তৈরি হয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা হয় তারা।পথে আবার ফোন আসে ফরহাদের মায়ের ফোনে।অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে যাওয়ায় আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে তাকে। তার মা কেঁদে ওঠে।সেই কান্না রিক্সাওয়ালার বুকেও কাপুনি ধরিয়ে দেয়।
ফরহাদ যখন আইসিইউতে পৌঁছে তখন তার বাবা। আইসিইউ-র বেডে শান্তভাবে শুয়ে আছে।বাইরে ছােট কাচের গ্লাস দিয়ে বাবাকে দেখে ফরহাদ।মনে হচ্ছে যেন কোন বাচ্চা শুয়ে আছে।চিন্তা,উৎকণ্ঠা,আশঙ্কা আর দুয়ার মধ্যে কিছু সময় পার হয়ে যায়।আশেপাশের মানুষের চিৎকার আর ভয়ার্ত দৃষ্টি ফরহাদকে অসহায় করে দেয়।মায়ের কাছে এসে সে মুখ লুকায় ভয়ে।
এমন সময় এক টিভি সাংবাদিক আসে নিউজ করার জন্য।ফরহাদ মাথা নামিয়ে নেয় কথা বলবে না বলে।কি | আর বলবে?এমনিতেই মনটা ভাল নায় তার।হঠাৎ করে
উঠে দাঁড়ায় তার মা।বলে আমি কিছু বলব।তাকে ঘিরে ধরে সাংবাদিক আর ক্যামেরাম্যান।তিনি বলতে শুরু করেন,“আমি আইসিইউর বাইরে থেকে বলছি।হ্যা আমি ভাল নেই।আমি শুধু নই,এখানে যারা আছেন কেউ ভালাে নেই।আজ আমার স্বামী আইসিইউ তে।জানি না,বাঁচবে কি না?বাঁচলে আমার পরিবার হয়তাে বেঁচে গেল।আর মারা গেলে আরেকটা পরিবার হয়তাে বাঁচার আশা
খুঁজবে।আপনারা সবাই..“শেষ কথা গুলাে আর শােনা যায় নি।কান্নায় জড়িয়ে গেছে।আসলে আইসিইউর বাইরে থাকা সবগুলাে রােগীর গল্প এক একটা দীর্ঘশ্বাস।
লেখক,
মো. তাসদিকুল হক
প্রতিষ্ঠান: RMC