একটা লাশ ঝুলছে

বাঁদরলাঠি গাছের পশ্চিম দিকের মরা ডালটায় একটা মৃতদেহ ঝুলছে।
দু পায়ের গোড়ালিতে রক্ত জমাট বাধা, আশপাশের ঘাসের ডগায় রক্তিম শিশিরের আবির্ভাব। কয়েকটা মাছি ভন ভন শব্দে মাতাল করে তুলছে চারপাশ টা। জমাট রক্ত চুমুক দিয়ে অমৃতের সাধ নিতে ব্যস্ত ওরা।
কালো ঠোঁটজোড়ার সর্বশেষ আকুতি কি ছিলো সে নিয়ে এক বিজ্ঞ জটলায় কানাকানি চলছে। খড়ের ঢিপে আগুন জ্বালিয়ে চারপাশে বৃত্তাকারে বসে কয়েকজন ‘এর পেছনে কারণ কি’, সেটা খতিয়ে দেখছে। কয়েকজন খাতা কলমসমেত ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে জীবনবৃত্তান্ত বের করতে।
একটা লাশ ঝুলছে। মোটা পাটের দড়িতে কিছু স্বপ্ন ঝুলছে। মৃত সব স্বপ্ন।
তীব্র শীত। কুয়াশায় আচ্ছন্ন চারপাশ। তিনজন যুবক এসে দড়ি কেটে লাশ নামাবার সাহস দেখাতেই মুরব্বিমহল ক্ষেপে যাচ্ছে। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদারপ্রাণের আনাগোনা লক্ষ করা যাচ্ছে। বাচ্চাকাচ্চারা যেন আশেপাশে ভীড় জমাতে না পারে, আপাতত এ কাজেই ব্যস্ত তারা। এদের একজনের ফোন বেজে উঠতেই, “জ্বি,  হ্যালো স্যার! হ্যা হ্যা, হাতের ডানদিক দিয়ে ঢুকুন, তারপর বায়ে এসে দেখবেন কয়েকটা দোকান, ওখানে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই আপনাদেরকে নিয়ে আসবে। হ্যা স্যার, ঘটনাস্থলের আশপাশে কিলোখানেকের মাঝে কোনো বাড়িঘর নেই স্যার। না স্যার, নাম ঠিকানার কোনো হদিস মেলেনি স্যার। একলা অমাবস্যার রাতে, গভীর রাতে স্যার, জ্বিন ভুত স্যার, শেয়ালের ভয় স্যার, কি কলিজা দ্যাখেন স্যার! স্যরি স্যার। জ্বি স্যার চলে আসুন।”
একটা মরা ডাল। একটা মৃতদেহ। ঝুলছে।
লোকে বলাবলি করছে, জায়গাটা ভালো না। বিশেষত গাছ টা। প্রতিবছর কয়েকটা করে মানুষ খায় এই গাছ। কেউ কাটতেও ভয় পায়। কেউ কাটবে মনস্থির করলে রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে। আর কাটা হয় না।
শরীরের অন্য কোথাও আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। ভেতরের ক্ষত কি পোস্টমর্টেম রিপোর্টে ধরা পড়ে? থাক সে কথা। জিহ্বার আগাটুকু মুখের এক পাশ দিয়ে কিছুটা বেড়িয়ে আছে। চোখ দুটো স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বৃহদাকৃতি নিয়ে সামনের দিকে বেড়িয়ে এসেছে। মৃত্যুযন্ত্রণায়, নয়তো শেষবারের মতো দুনিয়াটাকে প্রশান্তি করে দেখবার আশায়। অমাবস্যা রাতে। চোখের নিচটা অস্বাভাবিকরকম কালো। চোখ থেকে ঠোঁট অবধি জল গড়িয়ে পড়ার চিহ্ন। চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। অথচ পড়নে স্যুট-টাই। কি অদ্ভুত ছিলো লোক টা!
নাহ্। আশপাশে কোনো সুইসাইড নোট নেই। কেউ চিনতেও পারছে না ঠিকঠাক। থানা পুলিশ আসতেও দেরি করছে। এদিকে বেড়েই চলছে উৎসুক জনতার আগ্রহ।
এর মাঝে দুজন সাংবাদিক এসে হাজির। পরপরই থানা পুলিশ৷ লাশ নামানো হলো। লোক সমাগম কয়েক গুণ বেড়ে গেল৷ পকেট খুঁজে একটা ফাঁকা মানিব্যাগ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি।
লাশ নামিয়ে আনা হয়েছে অমলতাসের ডাল থেকে, স্বপ্নগুলোকে নামানো হয়নি। ওদের অপমৃত্যু মেনে নিতে পারলে হয়তো স্যুট টাই পড়ে লাশঘরে ঢুকতে হতো না নিজের পোস্টমর্টেম করাতে।
আমার ভাঙা জানালা দিয়ে তাকালে সোনালু গাছটা খুব কাছে মনে হয়।।
লেখক,
রিয়াদ
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ
হাবিপ্রবি
READ MORE:  অতিথির স্মৃতি - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়