দাঁত এর যত্ন সঠিকভাবে না নিলে হতে পারে সর্বনাশ, জেনে নিন করণীয়গুলো
দাঁত
দাঁত ও মাড়ির যত্ন আমাদের শরীরে সামগ্রিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য অংশ। দাঁত আমাদের দেহের সৌন্দর্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঠিকভাবে দাঁতের পরিচর্যা না করলে আমরা হারিয়ে ফেলতে পারি আমাদের দাঁতের সৌন্দর্য। শুধু তাই নয়, দাঁতের যত্নে অবহেলা করলে আমাদের মৌখিক স্বাস্থ্যের অবনতি হবে এবং ভবিষ্যতে দাঁতের চিকিৎসায় প্রচুর টাকা ব্যয় করতে হতে পারে। দাঁতের সুস্থতা বজায় রাখতে চলুন কিছু অতি প্রয়োজনীয় কিছু স্বাস্থ্য বিধি সম্পর্কে জেনে আসি।
দাঁত নিয়মিত ব্রাশ করুন কিন্তু আক্রমনাত্মক ভাবে নয়
আমাদের উচিত প্রতিদিন দিনে দুই বার ব্রাশ করা। সকালে ব্রেকফাস্ট এর পর এবং রাতে খাবার পর ঘুমানোর আগে দাঁত ব্রাশ করা উচিত। প্রতিদিন এইভাবে সকালে ও রাতে মিলিয়ে দিনে ২ বার ব্রাশ করা আমাদের দাঁত এবং মাড়ি সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। যারা এভাবে সকালে ও রাতে দুবার দাঁত ব্রাশ করে তাদের ক্ষেত্রে দাঁতে প্লেক এবং ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ কম হয় এবং এটি দাঁত পরিষ্কার রাখার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। তবে শুধু ব্রাশ করলেই হবে না। সঠিক কৌশলে ব্রাশ করতে হবে। সঠিক কৌশলে ব্রাশ করলেই এটি আমাদের দাঁতের সুস্বাস্থ্যের জন্য কার্যকর হতে পারে। তাই আমাদের ব্রাশ করার সময় সঠিক কৌশল ব্যবহার করতে হবে। ব্রাশ করার সঠিক কৌশল হলো ব্রাশকে দাঁতের সাথে ৪৫° কোণে রেখে সামান্য একটু বল প্রয়োগ করে উপরে নিচে সঞ্চালন করে ব্রাশ করতে হবে। ব্রাশ করার সময় দাঁতের উপরের পাটি ও নিচের পাটি ২ টিতেই সমান যত্ন নিয়ে ব্রাশ করতে হবে। ছোট বৃত্তাকার গতি ব্যবহার করে ব্রাশ করতে হবে। সামনের, পিছনের অর্থাৎ প্রতিটি দাঁতের উপরে ব্রাশ করতে হবে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ২-৩ মিনিটের বেশি ব্রাশ করা উচিত নয়। কারণ টুথপেষ্টের ক্যামিকেল বেশিক্ষণ মুখের ভিতর থাকলে দাঁতের ক্ষতি হতে পারে। আমাদের দাঁতের সামনে-পিছনে সমান যত্ন নিয়ে ব্রাশ করা উচিত। আর একটি বিষয় হলো খুব শক্তভাবে ব্রাশ করা বা শক্ত ব্রাশযুক্ত টুথব্রাশ ব্যবহার করে ব্রাশ করা উচিত নয়। এতে করে দাঁতের এনামেল এবং মাড়ির ক্ষতি হতে পারে। বেশি বল প্রয়োগ করে ব্রাশ করলে এর প্রভাবে দাঁতের সংবেদনশীলতা, দাঁতের সুরক্ষামূলক এনামেলের স্থায়ী ক্ষতি এবং মাড়ির ক্ষয় ইত্যাদি ক্ষতি হতে পারে। ডাক্তারদের মতে নরম ব্রিসল যুক্ত টুথব্রাশ ব্যবহার করা উচিত। আমাদের উচিত প্রতি মাসে একটি নতুন টুথব্রাশ ব্যবহার করা। একটি টুথব্রাশ একমাসের বেশি সময় ব্যবহার করা উচিত নয়। এছাড়া আপনার জিহবাও সামান্য একটু ব্রাশ দিয়ে হালকা করে ঘষে নিন।
ফ্লসিং
ফ্লসিং দাঁতের কোণায় আটকে থাকা খাদ্যকণা বের করার জন্য খুবই কার্যকর একটি পদ্ধতি। এক প্রকার খুবই চিকন সুতা বাজারে পাওয়া যায় যা দিয়ে দুই দাঁতের ফাকে জমে থাকা খাদ্য কণা অপসারণ করা যায়। চিকন সুতা দুই দাঁতের মাঝে বসিয়ে টান দিলে খাদ্যকণা বের হয়ে আসে। এই পদ্ধতিকে ফ্লসিং বলে। আপনার টুথব্রাশ পৌঁছাতে পারে না এমন ফলক এবং খাদ্য কণা অপসারণের জন্য দৈনিক ফ্লসিং প্রয়োজন। মাড়ির রেখার ঠিক নীচের এলাকা এবং দাঁতের মাঝখানে টাইট ফাঁকা জায়গাগুলিতে খাদ্যকণা দীর্ঘদিন জমে থাকার ফলে সেখানে প্লেক তৈরি হয়। প্লেক হলো আঠালো আস্তরণ যাতে প্রচুর ব্যাকটেরিয়া জন্মে, এটি দাঁতের উপর তৈরি হয় এবং পরবর্তীতে সেটা ক্যাভেটিস তথা গহ্বর তৈরি করে যাকে আমরা দাঁতের পোকা বলে থাকি। এছাড়াও প্লেক অন্যান্য মাড়ির রোগ সৃষ্টিতে অবদান রাখে। যদি আপনি নিয়মিত ফ্লস না করেন, তবে দাঁত এবং মাড়িতে নানা রকম জটিল সমস্যা হতে পারে, ক্ষতিকর জীবাণু বাসা বাঁধতে পারে এবং একসময় দাঁত পড়ে যেতে পারে।
ফ্লোরাইড উপাদান সমৃদ্ধ টুথপেষ্ট ব্যবহার করুন
বাজারে অনেক রকম বিভিন্ন কোম্পানির টুথপেষ্ট পাওয়া যায় বর্তমানে। টুথপেষ্ট নির্বাচন দাঁতের সুরক্ষার জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে টুথপেষ্টই কিনুন না কেনও, এটা নিশ্চিত করুন যে টুথপেষ্টে ফ্লোরাইড এর উপস্থিতি রয়েছে। ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করুন। কারণ ফ্লোরাইড দাঁতকে ঝকঝকে সাদা করে। মুখের ভিতরে ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংস করে ফ্লোরাইড। এই কারণে ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেষ্ট দাঁতের সুরক্ষার জন্য অন্যতম একটি প্রধান হাতিয়ার।
মাউথ ওয়াশ ব্যবহার করুন
আমাদের দেশে খুব কম মানুষই মাউথ ওয়াশ কিনে এবং ব্যবহার করে। কিন্তু মাউথ ওয়াশ দিয়ে কুলি করা আমাদের দাঁতের সুরক্ষায় অত্যন্ত কার্যকরী প্রভাব রাখতে পারে। আমরা যে খাবার খাই এরপর মুখ গহ্বরে এসিডিয় পরিবেশের সৃষ্টি করে যা আমাদের দাঁতের জন্য ক্ষতিকর। মাউথ ওয়াশ মুখে অ্যাসিডের পরিমাণ হ্রাস করে। এছাড়া মাউথ ওয়াশ দিয়ে কুলি করার সময় মাড়িতে এবং আশেপাশের অনেক জায়গা যেখানে আমাদের ব্রাশ পৌছাতে পারে না তা পরিষ্কার হয় এবং মুখের দুর্গন্ধ দূর করে। মাউথওয়াশ মুখের ভেতরের এসিডিয় পরিবেশ হ্রাস করে ভারসাম্য আনতে সাহায্য করে। তাই ব্রাশ করার পর আমাদের উচিত মাউথ ওয়াশ দিয়ে কুলি করা।
পুষ্টিকর খাবার খান
দাঁত ও মাড়ির সুস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিকর খাবারের কোনো বিকল্প নেই। ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার আমাদের দাঁতের গঠন ও মজবুত করতে অত্যন্ত কার্যকরী। তৈলাক্ত মাছ, ডিমের কুসুম, মাখন, কলিজা, উন্নত প্রজাতির মাশরুম, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, দই ইত্যাদি খাবারে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম রয়েছে। সবুজ শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি রয়েছে। ভিটামিন সি মাড়ি এবং মুখ গহ্বরের মধ্যে হওয়া অন্যান্য রোগ প্রতিহত করে। বিভিন্ন ফলমূল যেমন কমলা, আপেল, আমলকি, মালটা, আঙুর, পেঁপে, আনারস, জাম ইত্যাদি ফলে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি রয়েছে যা আমাদের দাঁতের জন্য অত্যন্ত উপকারী। দইয়ের মধ্যে রয়েছে উপকারী ব্যাকটেরিয়া যা আমাদের মুখের ভেতর জন্মানো ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংস করে।
চিনি এবং অম্লীয় খাবার কম খান
চিনি আমাদের মুখের ভেতর অ্যাসিডে রূপান্তরিত হয়। এসিড আমাদের দাঁতের এনামেলকে ক্ষয় করে। এনামেল হলো দাঁতের বাইরের শক্ত আবরণ যা ক্যালসিয়াম এবং ফসফেট এর সমন্বয়ে গঠিত। যখন ব্যাকটেরিয়া চিনি খায়, তখন তারা এসিড তৈরি করে, যা দাঁতের এনামেল ক্ষয় করে। এটি দাঁতকে বাইরের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং জীবাণুর আক্রমণ প্রতিহত করে। অম্লীয় ফল, চা এবং কফি দাঁতের এনামেল ক্ষয় করতে পারে।
বেশি করে পানি পান করুন
পানি আমাদের শরীরের সামগ্রিক সুস্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য উপাদান। ঘন ঘন পানি পান করলে দাঁতের ফাকে আটকে থাকা খাবার পানির সাথে অপসারিত হয়ে যায়। পানি পর্যাপ্ত পরিমাণে পান না করলে শরীরে নানা রকম রোগ হয় এবং এর ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলস্বরুপ পরোক্ষভাবে মুখের সুস্বাস্থ্যের উপরও এর বিরুপ প্রভাব পড়ে এবং দাঁত ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
ধুমপান থেকে বিরত থাকুন
ধুমপান আমাদের দাঁতের অপরিসীম ক্ষতি করে। বেশিদিন ধরে ধূমপান করলে দাঁতের ওপর প্লেক তৈরি হয়। পরবর্তীতে তা দাঁত ক্ষয়ের কারণ হয়। এছাড়া ধুমপানের ফলে মুখে ক্যান্সার হতে পারে। ধুমপান করলে মাড়ি কালো হয়ে যায়। মাড়িতে নানা রকম জটিল রোগের সৃষ্টি হয়। তাই দাঁতের সুস্বাস্থ্যের জন্য ধুমপান থেকে বিরত থাকুন।
এছাড়া আপনার দাঁতে যদি কোনো সমস্যা নাও থাকে তারপরও অত্যন্ত বছরে একবার অভিজ্ঞ ডেন্টিস্ট এর দ্বারা নিয়মিত দাঁতের চেক আপ করান। মনে রাখবেন, দাঁত এর সুস্বাস্থ্যের সাথে আমাদের সামগ্রিক সুস্বাস্থ্য ও শারীরিক সৌন্দর্য ওতপ্রতভাবে জড়িত। তাই দাঁত এর সুস্বাস্থ্যের বিষয়টি নিশ্চিত করতে কোনোরূপ অবহেলা করা যাবে না।