মায়ের যুদ্ধ – ১

 

পর্ব – ১

সময়টা ছিলো ১৯৯৮। মা চাকরি করতো ধানমন্ডিতে। অনেক কষ্টে লেখাপড়া করে একটা বেসরকারি চাকরি পেয়েছেন। বাবাও চাকরির জন্য হন্নে হয়ে ঘুরছেন। ঠিক তখনই পৃথিবীতে আগমন আমার। এর পর আমার বয়স ২ মাস হবে। বলা যায় খুব টানাপোড়েন অবস্থা পরিবারে। ছোট্ট একটা রুমে আমি,আর মা বাবা থাকতাম। হঠাৎই আম্মুর এক সুখবর এলো। জামালপুর সরকারি হাসপাতালে পোস্টিং। যখন এলাম সরকারি কোয়াটার এর বেশ কিছু বিল্ডিং এ কাজ চলতেছিলো। যে বিল্ডিংগুলার কাজ শেষ হয়েছিলো সেগুলো সাথে সাথেই ভরে যায়। তাই আমরা তখন কোয়াটারে জায়গা পেলাম না। ফোজদারি সংলগ্ন দেওয়ান পারা নামক জায়গায় এক রুমের একটা বাসা ভাড়া নেয়া হয়। বাবা তখন চাকরি পেলেন চিটাগাং একটি বেসরকারি কোম্পানিতে। সেই থেকে শুরু বাবা মার ২ জনের ২ জায়গায় চাকরি আর দূরে থাকা। তো চলতে থাকে দিন। আমাকে নিয়ে অফিস করতেন মা। কিন্তু এটা খুবই কষ্টকর হতো। কাজের মানুষ ও পাওয়া যাচ্ছিলো না তাই গ্রামের বাড়ি থেকে বড় খালা আসলেন আমাকে দেখাশোনা করার জন্য। বড় হওয়ার পর মায়ের মুখে শুনেছি অনেক কান্না করতাম। মা অফিস চলে গেলে আমার কান্না ঠেকায় কে। মাঝে মাঝে খালা কলে করে আমাকে নিয়ে যেতেন মায়ের অফিসে। ২ বছর সেখানে থাকার পর কোয়াটারে একটি বাসায় এক রুম দেওয়া হয়। ২ রুমের একটি বাসা। একটি বড় ছিলো আর একটি ছোটা রুম। ছোটো রুমটি আমাদের দেওয়া হয়। পাশের রুমে থাকতেন অন্য সিনিয়র আন্টি। অনেক আদর করতো আমায়। আম্মু অফিস গেলে তাদের রুমেই থাকতাম। ভালো লাগার বিষয় ছিলো মহিলাদের তালিম হতো সেখানে কলে নিয়ে বসে থাকত আন্টি। আমিও মগ্ন হয়ে শুনতাম। একবার আমার ১০৪ ডিগ্রি জ্বর উঠে, আমার বাসায় কেউ ছিলো না। তখন এতো মোবাইলের চল ছিলো না যার কারণে মাকে ডাকতে পারেনি। তখন আবার পাশের বাসা খালি হয়ে যায়, সেই আন্টি চলে যায় পাশের বাসায়। সেখানেই গেলাম কলা, বিস্কুট খাওয়ায় ঘুম পারায় দিলেন। আস্তে আস্তে বড় হলাম। স্কুলে ভর্তি করালো মা। বড় সমস্যা হইলো কে আমাকে নিয়ে যাবে, নিয়ে আসবে। এলাকার অন্য বড় ভাইদের সাথে পাঠাতো আবার কখনো সহপাঠীদের সাথে যেতাম। অটো রিক্সা ছিলো না। পায়ে চালিত রিক্সা চলতো। একজন উঠলে পাশের সিটের জন্য হাকা হত। তখন এক রিক্সায় একজন এমনটা খুব একটা দেখা যেতো না। ভাড়া ছিলো ৩ টাকা, ৪ টাকা। ভাবা যায়। একটা সুন্দর ঘটনা এক বড় ভাইয়ের সাথে যেতাম নিয়মিত। ভাড়া ছিলো ৩ টাকা হঠাৎ ৪ টাকা হলো। স্কুলে যাওয়ার সময় ভাই দিতেন।আমি দিতাম আসার সময়। তো ৩ টাকা দিতে দিতে আর ৪ টাকা কেনো জানি মা দিতো না । আজো রহস্য লাগে। ১ টাকা প্রায়ই ভাইয়েরই দেওয়া লাগত। এভাবেই কাটলো নার্সারি, কেজি,কেজি ওয়ান,। মনে পড়ে সকাল বেলা মা অফিস চলে যেত স্কুল থেকে এসে দেখতাম প্লেটে ভাত মাখানো। সাথে সাথে খেয়ে খেলতে যেতাম। খেলা শেষ করে আসতাম ১ টায় গোসল করে যোহরের নামায। মাঝে মাঝে খেলার তালে আযান ও শুনতাম না। একদিন এক অন্য রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম। খেলতে গিয়ে বাসার চাবি হারিয়ে ফেলি। এখন করি কি। মা তো সারাদিন অফিস করে আসছে খুব ক্লান্ত। খুব রেগে অবস্থা খারাপ, বকা দিচ্ছে। পরে পাশের বাসার আংকেল এসে তালা ভাঙলো। পরে বাসায় ডুকলাম। এর পর আরো ১/২ বার চাবি হারায়ছে কিন্তু খুজে পেয়েছি। তবে সবথেকে আনন্দের সময় ছিলো রাতে বিদ্যুৎ চলে গেলে। সবাই চিৎকার করে উঠতাম সাথে সাথে বাইরে গিয়ে খেলা শুরু,পলান টুক্কুরু বেশি খেলা হত। আবাসিক এলাকা হওয়াতে সবার সাথে ভালো খাতির জমে যেত। সবাই একত্রিত থাকতাম। যেমন খাতির আবার তার উল্টোটাও হতো, ঝগড়া, মারামারি। খেলতে গিয়ে কতো কথা কাটাকাটি, গালাগালি আহ সেই দিনগুলো। তবে ছোটো বেলা থেকেই নামাজ পরার অভ্যাস থাকায় সবার দৃষ্টিতে আমিই ভালো ছেলেই ছিলাম। মুরুব্বিরা অনেক আদর করতো। মুরুব্বিদের কাছ থেকে হুজুর উপাধি পেয়েছিলাম। নামাজে সবার আগে আবার নামাজ শেষে টাকা তোলার সময় মাথার টুপি খুলে সেখানে টাকা উঠাতাম। আমার প্রিয় খেলা ছিলো ক্রিকেট। অবাক করার বিষয় কিনে আনা ব্যাট টিকতো না, ১/২ দিন পরই ভেঙ্গে যেত। পরে এক দাদু কাঠমিস্ত্রিদের কাছ থেকে ব্যাট বানায় এনে দিলেন। সেই ব্যাট ভাঙ্গত না। আবার বছর শেষে পিকনিক যাওয়া হতো গজনি অবকাশ, মধুটিলা। সেখানেও কম দামে মজবুত ব্যাট পাওয়া যেতো, এখনো পাওয়া যায়। খেলতে গিয়ে কতো যে বাসার কাচের জানালা ভাঙ্গছি আমরা তার শেষ নেই। ভাঙার সাথে সাথে দৌড় আর পর পরই বাসায় বিচার ‘আপনার ছেলে আমার বাসার গ্লাস ভাঙছে’। তার পর চলত বাসার ভিতর আর এক দফা মায়ের হাতে মার। মা কখনই চাইতনা অন্য বাসা থেকে বিচার আসবে। তবুও আমরা দমে যাওয়ার পাত্র নই। আবার সেই বাসার নিচেই খেলতে যেতাম। বকা শুনতাম আর খেলা চালাই যেতাম। রমজান মাসে ইফতার করতাম মসজিদে। অন্য মানুষরা মসজিদে ইফতারি দিতো আমরা বন্ধুরা সবাই খেলা শেষ করে যেতাম। কে খায় কার আগে এমন প্রতিযোগিতা হত। মার যেদিন বিকালে অফিস থাকত না ঔদিন বাসায়ই ইফতার খেতাম। তবে বেশির ভাগ সময় সব বন্ধুরা মিলে খেলার পর এক দৌড়ে মসজিদ। মাগরিবের নামাজ পরে একবারে বাসায়। তার পর আবার তারাবীহ নামাজে যেতাম। সেখানে আর এক আনন্দ। কেউ তারাবিহ বাদ দিতাম না। আমার মনে পড়ে সব সময় ২য় কাতারে নামাজ পরতাম। অনেক বড় বড় সুরাতে রাকাত হত তো আমরা বন্ধুরা বলতাম চল কে কতক্ষণ হাত পা নাড়ানো ছাড়া থাকতে পারি এমন সব মজা ছিলো। সেই দিনগুলো  সব হারিয়ে ফেলেছি। আর আসবে না। শৈশবকাল যেন সবাইকেই পিছু টানে। সবার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় শৈশবকাল। 

READ MORE:  ক্রিকেটটাই নাকি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন মুনিম শাহরিয়ার