টাইফয়েড জ্বর নিয়ে আজই সতর্ক হোন
টাইফয়েড
টাইফয়েড জ্বর স্যালমোনেলা টাইফি নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমণে হয়ে থাকে। দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে প্রধানত দেহে এই জীবাণু ছড়ায় এবং জ্বরসহ নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়।
টাইফয়েড জ্বর বাংলাদেশে খুবই সচরাচর একটি রোগ। টাইফয়েড জ্বর স্যালমোনেলা টাইফি নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমণে হয়ে থাকে। দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে প্রধানত দেহে এই জীবাণু ছড়ায়। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার লোকজনের টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তস্রোতে ও অন্ত্রনালীতে এই ব্যাটটেরিয়া অবস্থান করে এবং দুষিত খাবার ও পানি গ্রহণের মাধ্যমে এই ব্যাকটেরিযা দেহে প্রবেশ করা জীবাণুগুলো গুণিতক আকারে বেড়ে গিয়ে রক্তস্রোতে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে জ্বরসহ নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। আজ আমরা জানব টাইফয়েড জ্বরের কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিকার সম্পর্কে।
টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ
প্রচণ্ড মাথাব্যথা, গলাব্যথা, পেটব্যথা, শরীর দুর্বল হয়ে যাওয়া, জ্বরে শরীরের তাপমাত্রা ১০৩-১০৪ ফারেনহাইট, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, চামড়ায় লালচে দানা দেখা দেওয়া টাইফয়েডের প্রাথমিক লক্ষণ। অনেক ক্ষেত্রেই এই জ্বর প্রথম সপ্তাহে ধরা পড়ে না। দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহে জ্বর ধরা পড়ে এবং মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। ওষুধ চলা অবস্থায়ও সপ্তাহ খানেক জ্বর থাকতে পারে।
টাইফয়েড জ্বর ভালো করার উপায়
প্রধানত এন্টিবায়োটিকের মাধ্যমে ডাক্তারগণ টাইফয়েড জ্বরের চিকিৎসা করে থাকেন। নির্দিষ্ট এন্টিবায়োটিক শুরুর পরও জ্বর কমতে পাঁচদিনও লেগে যেতে পারে। টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পরও দ্রুত চিকিৎসা না করলে জ্বর সপ্তাহ বা মাসব্যাপী থাকতে পারে। এছাড়া রোগী অন্যান্য জটিলতায় ভুগতে পারে। চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীকে অধিক পরিমাণে তরল খাবার দেওয়া দরকার কারণ দীর্ঘস্থায়ী জ্বর এবং ডায়রিয়ার কারণে তাঁর শরীরে পানি স্বল্পতা দেখা দিতে পারে। তীব্র আকারে পানি শূন্যতা দেখা দিলে শিরাপথে ওষুধ প্রদানের মাধ্যমেও তরলজাতীয় খাবার প্রদান করা যেতে পারে। টাইফয়েডের রোগীকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। জ্বর বেশি থাকলে পুরো শরীর ভেজা গামছা বা তোয়ালে দিয়ে মুছে দিতে হবে। অসুস্থতাকালীন সময়ে হারানো পুষ্টি পুনরুদ্ধারে উচ্চ ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা উচিত। প্রতিবার বাথরুম ব্যবহারের পর হাত পানি ও সাবান দিয়ে ভাল করে ধুয়ে ফেলতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হলো যতদিন পর্যন্ত চিকিৎসক এন্টিবায়োটিক গ্রহণের পরামর্শ দিবেন ততদিন পর্যন্ত তা গ্রহণ করতে হবে।
টাইফয়েড জ্বরের ঔষধ
চিকিৎসকরা এখন সরাসরি সেফটিআক্সন নামক ইনজেকশন দৈনিক ১ গ্রাম অথবা ২ গ্রাম করে থাকেন। সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে রোগী দুই সপ্তাহের মধ্যে ভাল হয়ে যায়। তবে অনেক ক্ষেত্রে পেনিসিলিন গ্রূপের আরেকটি ইনজেকশন ব্যাবহার করতে হয়। এই রোগের সংক্রমন ঠেকাতে জল ফুটিয়ে পান করতে হবে এবং এই রোগ ছোঁয়াচে নয় । সবসময় মনে রাখবেন “জর” হলে কখনোই এন্টিবায়োটিক দিয়ে ট্রিটমেন্ট শুরু করা যাবেনা। প্রথমে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দিয়ে চিকিত্সা শুরু করতে হবে সাথে অনেক সময় তৃতীয় প্রজন্মের সেফালোস্পরিন দেয়া হয়। তবে অনেক রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায় প্যারাসিটামল এবং টেট্রাসাইক্লিন এই ভালো হয়ে যায়। ১০ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায় কিন্তু প্রথমে উল্টা-পাল্টা মেডিসিন খেলে একটু বেশি সময় লাগে।
টাইফয়েড জ্বর কতদিন থাকে
সাধারণত ৩-৪ সপ্তাহ জ্বর থাকে। অসুখ সেরে গেলেও কিছুদিন জ্বর থাকতে পারে। এতে ভীত হওয়ার কিছু নেই।
টাইফয়েড জ্বর হলে কি কি খাওয়া উচিত
শুকনো আঙুর টাইফয়েডের পর শরীর স্বাস্থ্য দ্রুত পুনরুদ্ধারে অত্যন্ত কার্যকরী! এটি ইউনানি ওষুধ হিসাবেও প্রয়োগ করা হয়। টাইফয়েডে শুকনো আঙুর সন্ধক নুন মাখিয়ে খেতে পারেন। প্রচণ্ড জ্বরেও চার-পাঁচটি শুকনো আঙুর ভিজিয়ে খাওয়া যেতে পারে। রোগীর শরীরের জন্য খুবই উপকারী!
টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগীর শরীরে তরল বা জলের অভাব লক্ষ্য করা যায়। এই সময় অনেক রোগীর মধ্যে ডায়রিয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়, বাড়তে থাকে শরীরের তাপমাত্রা। ফলে এই সময় চিকিৎসকরা রোগীকে বেশি করে জল খেতে বলেন। এই পরিস্থিতিতে ডাবের জল রোগীর শরীরের জন্য খুবই উপকারী!
টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগীকে দ্রুত সুস্থ করে তুলতে প্রয়োজন কার্বোহাইড্রেট জাতিয় খাবার-দাবার। টাইফয়েডে শরীর বেশি পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট জাতিয় খাবার খেলে রোগীর সেগুলি হজম করতে কোনও সমস্যা হয় না, শরীর তার প্রয়োজনীয় পুষ্টিও পায়। সিদ্ধ আলু, ভাত রোগীর পেট ভরাতে আর শরীরের পুষ্টি জোগাতে সাহায্য করে। এগুলি হজমও হয়ে যায় সহজেই।
টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগীর দুগ্ধজাত খাবার-দাবার খাওয়ালে শারীরিক দুর্বলতা দ্রুত কেটে যায়। শরীরকে শক্তি দিতে রোগীকে টক দই, ছানার মতো দুগ্ধজাতিয় দেওয়া যেতে পারে। এতে রোগীর শরীর তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাবে।
টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগীর স্বাস্থ্য দ্রুত পুনরুদ্ধারের জন্য উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার-দাবার খাওয়া অত্যন্ত জরুরি! টাইফয়েডে চিকিৎসকরা রোগীকে উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন। আসলে এই জ্বরে একজনের শরীর খুবই দুর্বল হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে রোগীর ওজনও কমতে শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার-দাবারগুলি শরীরে শক্তি যোগাতে সাহায্য করে। কলা, মিষ্টি আলু বা পিনাট বাটারের মতো খাবার রোগীকে খাওয়ানো যেতে পারে।
টাইফয়েড জ্বর কি ছোঁয়াচে
টাইফয়েড রোগটি পানিবাহিত। সালমনেলা টাইফি এবং প্যারাটাইফি জীবাণু থেকে টাইফয়েড রোগ হয়ে থাকে। টাইফয়েড প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে এবং সঠিকভাবে চিকিৎসা করলে এর গুরুতর জটিলতা এড়ানো যায়। দূষিত পানি, খাদ্য এবং দুধের মাধ্যমে এই ব্যাকটেরিয়া শরীরের খাদ্যনালিতে প্রবেশ করে। তা ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে এবং পানির মাধ্যমেও এই রোগের জীবাণু ছড়ায়!
টাইফয়েড জ্বর হলে কি গোসল করা যায়
টাইফয়েড জ্বর হলে গোসল করা উচিত নয় প্রতিদিন। এসময় কপাল এবং ঘাড়ের পেছনের অংশে জলপট্টি দিয়ে জ্বর কমানো উচিত। পুরোদস্তুর গোসলের পরিবর্তে কুসুম গরম পানিতে ভেজানো কাপড় দিয়ে শরীর মোছাও দ্রুত জ্বর কমাতে সাহায্য করে। চিকিৎসকের অনুমতি ছাড়া জ্বর নিয়ে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করা যাবে না। অন্যথায় শরীরে কাঁপুনি দেখা দিতে পারে এবং জ্বর আরও বেড়ে যেতে পারে।
শিশুর টাইফয়েড হলে করণীয়
টাইফয়েডের লক্ষণগুলি বাচ্চার মধ্যে দেখা গেলে অবিলম্বে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। টাইফয়েড ডায়াগনোজ় করার জন্য বিশেষ কয়েকটা টেস্ট আছে যেমন ব্লাড কালচার, স্টুল কালচার, ইউরিন কালচার ইত্যাদি। সেই টেস্টগুলি দ্রুত করিয়ে নিতে হবে। প্রধানত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিয়েই টাইফয়েডের চিকিৎসা করা হয়। এছাড়া জ্বর কমানোর ওষুধ খেতে হয় এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। জ্বরটা কমে গেলে সাধারণত পাঁচ-ছয় দিনের একটা অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স দেওয়া হয়। অন্যথায় দশ থেকে বারো দিন অ্যান্টিবায়োটিক চালিয়ে যেতে হবে। সঠিক সময়ে যথাযথ চিকিৎসা করা হলে টাইফয়েড সেরে যায়।
টাইফয়েডের জীবাণু যেহেতু মানুষের স্টুল বা ইউরিনের সঙ্গে বেরিয়ে যায়, তাই বাড়িতেই একজনের থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। টাইফয়েড প্রতিরোধ করতে হলে প্রথমেই পরিবারের সকলের উপযুক্ত হাইজিন এবং স্যানিটেশন মেন্টেন করা উচিত। ভাল করে হাত-পা ধুতে হবে, বিশেষ করে খাওয়ার আগে। জল ফুটিয়ে খাবেন। বাইরের যে সমস্ত খাবার থেকে ইনফেকশন হতে পারে সেগুলি বরং এড়িয়ে চলাই ভাল। ধরুন আপনি রাস্তায় কাটা ফল খেলেন। এদিকে সেই ফলটা হয়তো এমন জল দিয়ে ধোয়া হয়েছে যেটায় টাইফয়েডের জীবাণু উপস্থিত। ব্যস, আর দেখতে হবে না।
টাইফয়েড প্রতিরোধ করার আর একটি উপায় হচ্ছে সময়ে টাইফয়েড ভ্যাক্সিন নেওয়া। সাধারণত দু’বছর বয়সের পরে এই ভ্যাক্সিন দেওয়া শুরু করা হয়। এরপর প্রতি তিন বছর অন্তর ফের এই ভ্যাক্সিন নিতে হয়। এখন অবশ্য একটি নতুন ভ্যাক্সিনও বেরিয়েছে যেটা নয় মাস বয়সের পরেই দেওয়া যায়। সময়ে ঠিকঠাক ভ্যাক্সিন নিলে টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়।
টাইফয়েড ভ্যাক্সিনের দাম কত
প্যারেন্টেরাল ভি পলিস্যাকারাইড টাইফয়েড এর একটি জনপ্রিয় ভ্যাক্সিন। এছাড়া আরও অনেক ভ্যাক্সিন রয়েছে বর্তমানে। প্যারেন্টেরাল ভি পলিস্যাকারাইড এর প্রতি ডোস এর দাম ৩ হাজার টাকা৷ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী টাইফয়েড জ্বরের জন্য নির্ধারিত ভ্যাকসিন (টিকা) গ্রহণ করা রোগটি থেকে বেঁচে থাকার একটি উপায়। ইনজেকশন এবং মুখে খাওয়ার উভয় ধরনের ভ্যাকসিন বাজারে পাওয়া যায়। ভ্যাকসিন গ্রহণ করার ব্যাপারে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার।