স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে আজই সচেতন হোন
বিশ্বব্যাপী, স্তন ক্যান্সার হচ্ছে মহিলাদের আক্রমণ করা সর্বাধিক ব্যাপকভাবে ঘটা ক্যান্সার। স্তন ক্যান্সারের সবচেয়ে দেখা উপসর্গ হচ্ছে স্তনে একটা পিণ্ড বা দলার গঠন। যাই হোক, স্তন ক্যান্সার থাকা সব মহিলাদের কিন্তু তাঁদের স্তনে কোনও পিণ্ড বা দলা গড়ে (উপস্থিত থাকা) ওঠেনা। স্তন ক্যান্সারের অন্যান্য উপসর্গগুলির মধ্যে রয়েছে স্তনের উপরের ত্বকের খোসা ওঠা, স্তনবৃন্ত থেকে তরল পদার্থ চুঁইয়ে বার হওয়া, এবং ঘাড় এবং বগলে পিণ্ড বা দলার উপস্থিতি। ওষুধ এবং প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে, অনেক অভিনব (নতুন) রোগনির্ণয়সংক্রান্ত সরঞ্জাম এখন সুলভ, যা স্তন ক্যান্সারের প্রাথমিক স্তরে নির্ণয় সহজতর করে। স্তন ক্যান্সার চারটা বিভিন্ন পর্যায়ের মাধ্যমে ক্রমবৃদ্ধি পায়, অতএব, রোগটার প্রাথমিক স্তরে সনাক্তকরণ দ্রুত চিকিৎসায় সাহায্য করে, এভাবে বেঁচে থাকার হার বাড়ায়। রোগনির্ণয়সংক্রান্ত সরঞ্জামের অন্তর্ভুক্ত ম্যামোগ্রাফি ব্যবহার করে স্তনের মূল্যায়ন বা অনুসন্ধান, ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (এমআরআই স্ক্যান), এবং স্তনে উপস্থিত থাকা তরল এবং টিস্যুগুলির মূল্যায়ন বা অনুসন্ধান। জৈবপ্রযুক্তিতে (বায়োটেকনোলজি) বিরাট অগ্রগতি স্তন ক্যান্সারের জন্য দায়ী ত্রুটিপূর্ণ জিন বা বংশাণুগুলির সনাক্তকরণ সম্ভব করেছে। প্রোটিন মার্কারগুলির উপর গবেষণা স্তন ক্যান্সারের জন্য একটা যথার্থ চিকিৎসা বিধি নির্ধারণ করা সহজ করেছে।
রোগটার চিকিৎসা প্রচলিত কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপি, এবং হরমোনসংক্রান্ত থেরাপি থেকে শুরু করে নতুন ন্যানোটেকনোলজি-ভিত্তিক চিকিৎসাপ্রস্তুতি পর্যন্ত ব্যাপ্ত। নিয়মিত ব্যায়াম, শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ, এবং প্রসবের পর অন্ততঃ ছয় মাস বাচ্চাকে স্তনপান করানোর দ্বারা স্তন ক্যান্সার কিছু পরিমাণে প্রতিরোধ করা যায়। যাই হোক, স্তন ক্যান্সারের একটা জোরালো পারিবারিক ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মগুলিতে রোগটার বিপদ খুব বেশি পরিমাণে বাড়ায়। সেজন্য, এধরণের ক্ষেত্রগুলিতে, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষাগুলি স্তন ক্যান্সারের মূল্যায়ন বা অনুসন্ধানের পক্ষে সহায়ক হতে পারে। জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যখন ক্যান্সারযুক্ত টিস্যুগুলি শরীরের স্বাভাবিক টিস্যুগুলিকে আক্রমণ করে, উদাহরণস্বরূপ, সংলগ্ন টিস্যুগুলির উপর চাপের ফলে ঘটা ব্যথা, সংলগ্ন রক্তবাহী নালী এবং স্নায়ুগুলির আটকে পড়া অবস্থা, এবং আরও অনেক কিছু। যাই হোক, বেশির ভাগ জটিলতা সৃষ্টি হয় স্তন ক্যান্সার চিকিৎসার বিরূপ প্রভাবগুলির কারণে, উদাহরণস্বরূপ, চুল পড়া, বমি হওয়া, কমে যাওয়া শ্বেত রক্তকোষের সংখ্যা এবং অন্যান্য। এই ভয়ঙ্কর রোগে বেঁচে থাকার হার বাড়াবার জন্য প্রাথমিক স্তরে রোগলক্ষণ নির্ণয় এবং চটজলদি চিকিৎসা হচ্ছে মূল চাবিকাঠি। তীব্রতা এবং ক্যান্সার বিস্তারের ব্যাপ্তির উপর ভিত্তি করে, রেডিয়েশন, ওষুধ প্রয়োগ করে কেমোথেরাপি এবং অস্ত্রোপচার হল চিকিৎসার সবচেয়ে প্রচলিত তিনটি পদ্ধতি।
ব্রেস্ট ক্যান্সার (স্তন ক্যান্সার) এর উপসর্গ –
স্তন ক্যান্সারের সবচেয়ে প্রথমদিকের লক্ষণ হল সাধারণতঃ
স্তনে অনুভূত একটা পিণ্ড বা দলা, যাই হোক, অন্যান্য উপসর্গও থাকতে পারে, যেগুলি স্তন ক্যান্সারের বৃদ্ধি ইঙ্গিত করতে পারে। উপসর্গগুলিকে শ্রেণীবিভক্ত করা যেতে পারে স্তন পিণ্ড উপসর্গ, পিণ্ড-হীন উপসর্গ, এবং স্তন-ছাড়া উপসর্গ হিসাবে।
স্তন পিণ্ড উপসর্গসমূহঃ
°লক্ষণীয় কিনারাসহ শক্ত বৃদ্ধি।
- নরম এবং গোলাকার বৃদ্ধি।
°ছোট আকারের পিণ্ড অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হিসাবে সনাক্ত।
°পিণ্ডহীন উপসর্গসমূহ
- স্তনের পুরোটা অথবা একটা অংশে স্ফীতি বা ফোলা।
°স্তনবৃন্ত (বোঁটা) ভিতরের দিকে বাঁক নেওয়া।
°দুধ ছাড়া অন্য তরল পদার্থ এবং কোনও সাম্প্রতিক গর্ভাবস্থার ঘটনা ছাড়া বোঁটা থেকে ক্ষরণ (চুঁইয়ে পড়া)।
- স্তনের উপর লালচেভাব, ত্বকের আঁশ বা খোসা ওঠা।
স্তন-ছাড়া উপসর্গসমূহঃ
- অবসাদ।
- শ্বাসের কষ্ট বা দমবন্ধ অবস্থা।
- ঘাড়ে দলা বা পিণ্ড।
- ব্যাখ্যার অতীত খিদে না হওয়া এবং ওজন কমে যাওয়া।
ব্রেস্ট ক্যান্সার (স্তন ক্যান্সার) এর চিকিৎসা
স্তন ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য এবং গোড়ার দিকে রোগলক্ষণ নির্ণয় এবং সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার দ্বারা, জটিলতাগুলি বহুলাংশে কমানো যেতে পারে। ভারতীয় শহুরে অঞ্চলগুলির তুলনায় গ্রামীণ ভারতে মৃত্যু-ঘটনার অনুপাত অত্যন্ত বেশি, সেজন্য, উন্নততর স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং প্রাথমিক স্তরে রোগলক্ষণ নির্ণয় জীবনহানি বা মৃত্যুর হার কমাতে সাহায্য করতে পারে।
প্রচলিত চিকিৎসাঃ
স্তন ক্যান্সারের প্রচলিত চিকিৎসার মধ্যে আছে ব্রেস্ট কনজার্ভেশন সার্জারি, রেডিয়েশন থেরাপি, কেমোথেরাপি, এবং হরমোনাল থেরাপি।
প্রচলিত চিকিৎসাঃ
স্তন ক্যান্সারের প্রচলিত চিকিৎসার মধ্যে আছে ব্রেস্ট কনজার্ভেশন সার্জারি, রেডিয়েশন থেরাপি, কেমোথেরাপি, এবং হরমোনাল থেরাপি।
ব্রেস্ট কনজার্ভেশন সার্জারি (স্তন সংরক্ষণ অস্ত্রোপচার)ঃ
এই প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকে ক্যান্সার কোষগুলির আরও বিস্তার (ছড়ানো) এড়াতে ক্যান্সার-আক্রান্ত স্তনের শুধুমাত্র একটা অংশের অপসারণ (বাদ দেওয়া)। এটা করা হয় কোনও স্থানীয়ভাবে সীমাবদ্ধ টিউমারের ক্ষেত্রে, যা আশেপাশের টিস্যুগুলিতে ছড়ায়নি। অতএব, ক্যান্সারের পরবর্তী বৃদ্ধি ঠেকাতে স্তনের আক্রান্ত এলাকা অস্ত্রোপচারের সাহায্যে বাদ দেওয়া হচ্ছে সবচেয়ে ভাল বিকল্প। এই ধরণের অস্ত্রোপচারে, সুস্থ স্তন টিস্যু বাদ দেওয়া হয়না এবং স্তন সংরক্ষিত থাকে। ক্যান্সারের ব্যাপক ছড়ানোর ক্ষেত্রগুলিতে, স্তন সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া দরকার হতে পারে। এই ধরণের ক্ষেত্রগুলিতে, ব্রেস্ট রিকন্সট্রাক্টিভ সার্জারি (স্তন পুনর্গঠনকর অস্ত্রোপচার) হিসাবে কথিত একটা দ্বিতীয় অস্ত্রোপচারে শারীরিক চেহারা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে স্তন ইমপ্ল্যান্ট (কৃত্রিম টিস্যু প্রতিস্থাপন করা) করা যেতে পারে।
রেডিয়েশন থেরাপিঃ
অস্ত্রোপচারের পর, এলাকাটায় ক্যান্সারযুক্ত কোষগুলি ধ্বংস করায় সাহায্য করার জন্য রেডিয়েশন (শক্তির বিকিরণ প্রক্রিয়া) দ্বারা চিকিৎসা করা হয়। যাই হোক, এটা বিশেষ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সাথে জড়িত থাকে এবং জায়গাটা সংবেদনশীল, লাল, আর্দ্র, এবং ব্যথায় পীড়িত রাখতে পারে।
- কেমোথেরাপি এতে জড়িত থাকে নানারকম ক্যান্সার-প্রতিরোধী ওষুধ মৌখিকভাবে অথবা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে নিয়মানুগ প্রয়োগ। স্তন ক্যান্সারের তীব্রতা এবং পর্যায়ের উপর চিকিৎসার স্থায়িত্বকাল নির্ভর করে।
অ্যাডজুভ্যান্ট (সহযোগিতামূলক বা কার্যকর) থেরাপি
এতে জড়িত থাকে এন্ডোক্রিন্যাল চিকিৎসা যা ক্যান্সারের প্রকোপ বাড়াতে পারে এমন হরমোনগুলির ভারসাম্য রাখে বা আটকে দেয়।
স্তন ক্যান্সার চিকিৎসায় অভিনব (নতুন) কৌশলসমূহঃ
ন্যানোটেকনোলজি একটা সফল পদ্ধতি হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে যা ন্যানো-আকারের (অত্যন্ত ক্ষুদ্র) উপযুক্ত ওষুধের প্রয়োগ, ওই উপায়ে, প্রচণ্ড নির্ভুলতার সাথে ক্যান্সার কোষগুলি নিশানা করে ব্যবহার করায় যুক্ত থাকে।
নিউক্লেয়িক অ্যাসিড টেকনোলজি হচ্ছে আর একটা পদ্ধতি যাতে ক্যান্সার-ঘটানো জিনগুলির (বংশাণু) প্রকাশ বিশেষ ওষুধ ব্যবহার করে দমন করা যায়।
ইমিউনোমডুলেশনঃ
এই পন্থাতে যুক্ত থাকে ক্যান্সার কোষগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বাড়াতে সাইটোকাইনস-এর ব্যবহার (প্রতিরোধ ব্যবস্থার দ্বারা নির্গত রাসায়নিক)।
প্রাকৃতিক ওষুধের ব্যবহারঃ
কারকিউমিন, গালেটস, লাইকোপিন-এর মত কোন কোন শাকসবজি থেকে প্রাপ্ত কিছু ফাইটোকন্সটিটিউয়েন্ট (উদ্ভিদে পাওয়া প্রাকৃতিকভাবে ঘটা পদার্থসমূহ), স্তন
ক্যান্সারের চিকিৎসায় কার্যকর হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে।
জীবনধারা সামলানোঃ
ভারতে প্রায় ৪৫% ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সার মেটাস্ট্যাটিক পর্যায়ে (মূল উৎসস্থল থেকে অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সার) জানানো হয়। জীবনধারায় কিছু বদল স্তন ক্যান্সার সামলানোয় উপকারী প্রমাণিত হতে পারে। এর মধ্যে আছেঃ
- ওজন ঠিক রাখা।
°চর্বিযুক্ত খাবারের পদ খাওয়া এড়ানো।
°নিয়মিত ব্যায়াম। • অ্যালকোহল পান এড়ানো।
- প্রসবের পর এক বছর পর্যন্ত বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো।
°নিয়মিত স্তন পরীক্ষা।
°অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট-সমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাবার খাওয়া।