স্বাস্থ্য

অপারেশন পরবর্তী জটিলতা এবং তা থেকে পরিত্রাণের উপায়

জীবনে নানা সময় আমরা অসুস্থ হই। অপারেশন এর মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হয়। অপারেশন করার পর আমাদের দেহে নানা রকম জটিলতা দেখা দিতে পারে। চলুন আজ জেনে নিব অপারেশন পরবর্তী সময়ে কি কি জটিলতা বা সমস্যা হতে পারে এবং তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় কি। 

 

১. বমি বা বমি বমি ভাব: এটা হয় মূলত এনেস্থেশিয়ার ওষুধ ব্যবহারের জন্য। এটি এমনিতেই চলে যায়।

 

২. পেট ফাপা এবং পায়খানা না হওয়া: এটাও মূলত এনেস্থেশিয়া এবং অপারেশনে নাড়ি-ভুড়ি নাড়াচাড়ার ফলে নাড়ি- গতি বন্ধ হয়ে যায়। একে বলে প্যারালাইটিক আইলিয়াস। উঠে হাটাহাটি করলে সাধারণত এটা ঠিক হয়ে যায়। তারপরও ঠিক না হলে পটাশিয়াম চেক সহ এর অন্য কারন খুঁজতে  হয়।

 

৩. পিপাসা: অপারেশনের পর ৬-৮ ঘন্টা না খাওয়ায়ে রাখার জন্য এমন হয়। তবে ক্ষেত্র বিশেষে আমরা রোগীর ঠোট ভিজিয়ে দিতে বলি।

 

৪. গলা ব্যাথা: অজ্ঞান করার পর মুখ দিয়ে গলায় শ্বাস নালীর মধ্যে টিউব (Endo-tracheal tube) ঢুকিয়ে কৃত্তিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস চালানো হয়। ঐ টিউব দেওয়ার কারনে অনেক সময় গলার ভেতরে হালকা খোচা লাগতে পারে। যার ফলে অপারেশন পরবর্তি গলা ব্যাথা বা অস্বস্তি লাগতে পারে। অপারেশনের পর যে ব্যাথার ওষুধ দেওয়া হয়, তাতেই এটা ভাল হয়ে যায় যায়। খুব অস্বস্তি লাগলে গরম পানি বা চা খেলে ঠিক হয়ে যায়।

 

৫. মাথা ব্যাথা: কোমড়ে এনেস্থেশিয়া ইঞ্জেকশন দেওয়ার সময় স্পাইনাল কর্ড থেকে সিএসএফ (সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড) নামক তরল পদার্থ বের করে ইঞ্জকশনের রূট নিশ্চিত করা হয়। তখন ঐ তরলের কিছুটা ঘাটতি হওয়ার জন্য ব্রেইন বা মস্তিষ্ক মাথার খুলির সাথে লেগে যায় বা ঘষা খায়। ফলে মাথা ব্যাথা হয়। ঘন ঘন তরল খেলে বা শিরাতে জল দিলে এটা ঠিক হয়ে যায়।

 

৬. অস্থিরতা ও নিদ্রাহীনতা: কেউই বিছানায় আবদ্ধ থাকতে চান না। অপারেশনের পর রোগীর দেহে কিছুটা পরিবর্তন হয়। একে বলে টিস্যু ইঞ্জুরি রেস্পন্স বা স্ট্রেস রেস্পন্স ম্যাকানিজম। এর ফলে হরমনেরও কিছু কম বেশি হতে পারে। এর সাথে আছে ব্যাথা ও খারাপ লাগা। সব মিলিয়ে ঘুম হয় না এবং ঘুম না হলে অস্থির লাগে। এ কারনে অপারেশন পরবর্তিতে ঘুম এবং দুশ্চিন্তা মুক্ত করার ওষুধ দেওয়া হয়।

 

৭. কাটা জায়গায় ব্যাথা এবং ফুলে যাওয়া: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এটি। ডিউটি ডাক্তারগণ প্রতিদিন কাটা জায়গার ব্যান্ডেজ পরীক্ষা করেন। দেখেন যে ব্যান্ডেজটা ভিজে যাচ্ছে কি না। খুলে দেখেন, জায়গাটা ফুলে যাচ্ছে কি না। ভিজে গেলে ড্রেসিং করে দেন আর ফুলে গেলে বা পুজ জমলে অনেক সময় সুতা একটা বা দুইটা কেটে খুলে রাখা হয়।

 

৮. কাটা জায়গা দিয়ে রক্ত পড়া: অপারেশনের পর শরীরের রক্তচাপ যদি বাড়ে বা রোগী যখন নড়াচড়া করে তখন কাটা জায়গার জমাট রক্ত বা ক্লট সরে যায় বা অনেক সময় শেলাইয়ের গিট খুলে গিয়ে রক্ত পড়তে পারে। রোগী নিজে বা রোগীর লোকজন বা নার্স কেউই খেয়াল না করলে অনেক রক্তপাত হয়ে রোগী শকেও চলে যেতে পারে। তাই অবশ্যই তিন বেলা ফলো আপের সময় ব্যান্ডেজ চেক করা উচিৎ।

 

৯. ইনফেকশন: অপারেশনের জায়গায় ইনফেকশন হলে একে বলা হয় উন্ড ইনফেকশন বা সারজিক্যাল সাইট ইনফেকশন (SSI)। যদিও আমাদের দেশে এখন প্রায় সব ভাল বা বড় হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার, যন্ত্রপাতি এবং সার্জারির প্রক্রিয়া জীবানুমুক্ত উপায়ে করা হয়, তাতে রোগীর ইনফেকশন হয় না বললেই চলে বা হবার কথা নয়। কিন্তু তারপরও অনেক রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে এবং তার কারন যেমন: ডায়াবেটিস, অপুষ্টি, ক্যান্সার, এইডস, হাপানি বা জয়েন্ট ব্যাথার জন্য স্টেরয়েড সেবন, কিডনী বা লিভারের অসুখসহ অন্যান্য। আবার অপারেশনের পর সেই কাটা জায়াগার কিছু যত্ন বা কেয়ার আছে। যেমন: ড্রেসিং, এগুলো ঠিক মত না হলেও ইনফেকশন হতে পারে। 

 

ইনফেকশন হলে বুঝার উপায়: কাটা জায়গা অতিরিক্ত ফুলে  যাবে, ঐ জায়গার তাপমাত্রা বেড়ে যাবে, চামড়ার রঙ বদলে যাবে, পুজ জমবে, পুজে বেরিয়েই আসতে পারে, জ্বর আসবে, ব্যাথা আরো বেড়ে যাবে ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে শেলাই খুলে দেওয়া হয় অর্থাৎ কাটা জায়গা ফাক করে রাখা হয় এবং নিয়মিত ড্রেসিং ও ভেতরে গজ প্যাক দিয়ে রাখা হয়। তাতে ভেতরের পুজ গুলো গজ প্যাক শুষে নেয় এবং ভাল এন্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। 

 

চামড়ায় সাধারনত ছত্রাক, স্ট্যাফাইলোকোক্কাস ও এনেরোবিক ব্যাক্টেরিয়া থাকে। তাদেরকে মারার জন্য ভাল এন্টিবায়োটিক কম্বিনেশন ব্যবহার করতে হয়। অনেক সময় দামি এন্টিবায়োটিক যেমন: মেরোপেনেম বা ইমিপেনেম দেওয়া হয়। (কারন: প্রায় প্রত্যেকেরই কম দামি এন্টিবায়োটিক গুলো রেজিস্ট্যান্ট বা অকেজো হয়ে গেছে। তা সকলেরই জানা। যাই হোক, এভাবে ড্রেসিং এবং প্যাক দেওয়া এবং এন্টিবায়োটিক চলতে চলতে যখন জায়গাটা শুকিয়ে আসে, তখন ভেতরটা ভাল করে পরিস্কার করে পুন: শেলাই দেওয়া হয়।

 

১০. শিরায় রক্ত জমা এবং জমাট বাধা: একে বলে ডিভিটি বা ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস। অপারেশনের পর দীর্ঘক্ষন শুয়ে থাকলে এটি হতে পারে। হাটিহাটি করলে এটা প্রতিরোধ করা যায়।

 

১১. ফুসফুসে রক্ত জমাট: একে বলে পালমোনারি এম্বোলিজম। ঐ ডিভিটি থেকে জমাট রক্ত ছুটে গিয়ে রক্ত স্রোতে ভেসে ভেসে ফুসফুসের রক্তনালিতে জমলে এই সমস্যা হয়। তবে এটা সাধারণত পাওয়া যায় না। অর্থাৎ এটা হওয়ার আগেই রোগীরা প্রায় হাটা চলা, শুরু করেন।

 

১২. নিউমোনিয়া এবং কাশি: অপারেশনের ৮-১২ ঘন্টা পর breathing & coughing excercise অর্থাৎ দম এবং কাশির জন্য ছোট্ট একটা ব্যায়াম করলে এটা হয় না। সাধারণত যারা অপারেশনের ৪৮ ঘন্টার পরও ঠিক মত শ্বাস নেন না বা কাশেন না, তাদের ফুসফুসে বিভিন্ন নি:সরণ জমে, এবং নিউমোনিয়া হতে পারে। লক্ষন থাকে- কাশি, বুকে ব্যাথা, জ্বর, বুকের মধ্যে শো শো করা ইত্যাদি। তবে এটাও এখন খুব কম পাওয়া যায়। কারন ডাক্তার, নার্স সবাই রোগীকে নিয়মগুলো শিখিয়ে দেন।

 

১৩. প্রশ্রাব বন্ধ:  এনেস্থেশিয়ার জন্য এমন হয়। অনেক সময় প্রোস্টেট বা কিডনির অপারেশন হলে জমাট রক্ত প্রশ্রাবের নালিতে জমে নালিপথ বন্ধ করে দেয়। এমন হলে বাথরুমে বসে ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে প্রশ্রাবের চেষ্টা করা বা ক্যাথেটার দেওয়া হয়। তবে এটা ডাক্তারগন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেন।

 

১৪. এনেস্থেটিক এলার্জি: এনেস্থেশিয়ার ওষুধের জন্য হয়।  তবে এটাও আমাদের দেশে খুব কম পাওয়া যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link