স্বাস্থ্য

ধনেপাতার যত ওষুধি গুণ

অসাধারণ গুণে ভরপুর সুপরিচিত ধনে বা ধনিয়া একটি সুগন্ধি ঔষধি গাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম কোরিয়ানড্রাম সেটিভাম। এটি একটি একবর্ষজীবী উদ্ভিদ। ধনেপাতা খুবই পরিচিত একটি সবজি। ধনে পাতাকে মুলত আমরা সালাদ এবং রান্নার স্বাদ বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করে থাকি। তবে শুধু স্বাদ এবং ঘ্রাণ বাড়ানোর কাজেই এর গুণাগুণ শেষ হয়ে যায় না। এ পাতা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ভালো একটি শাক জাতীয় খাবার।

 

আসুন জেনে নিই ধনে পাতার অসাধারণ স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে।

 

১. ধনে পাতা খেলে শরীরে খারাপ কোলেস্টরলের মাত্রা কমে যায়, ভাল কোলেস্টরলের মাত্রা

বৃদ্ধি পায়। কারন এতে কোলেস্টেরল এর মাত্রা শূন্য।

 

২. ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের জন্যে ধনে পাতা বিশেষ উপকারি। এটি ইনসুলিনের

ভারসাম্য বজায় রাখে এবং রক্তের সুগারের মাত্রা কমায়।

 

৩. ধনে পাতায় থাকা অ্যান্টি-সেপটিক মুখে আলসার নিরাময়েও উপকারী, চোখের

জন্যেও ভাল।

 

৪. ঋতুস্রাবের সময় রক্তসঞ্চানল ভাল হওয়ার জন্যে ধনে পাতা খেলে উপকার পাওয়া যায়।

এতে থাকা আয়রন রক্তশূন্যতা সারাতেও বেশ উপকারী।

 

৫. ধনে পাতার থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যেমন –অ্যাসকরবিক এসিড, বিটা

ক্যারেটিন, ম্যাংগানিজ পাকস্থলীর ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করে।

 

৬. এতে রয়েছে অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি উপাদান যা বাতের ব্যথাসহ হাড় এবং

জয়েন্টের ব্যথা উপশমে কাজ করে।

 

৭. স্মৃতিশক্তি প্রখর এবং মস্তিষ্কের নার্ভ (স্নায়ু) সচল রাখতে সাহায্য করে ধনে

পাতা।

 

৮. ধনে পাতার ভিটামিন ‘কে’ অ্যালঝেইমার রোগের চিকিৎসায় বেশ কার্যকরী।

 

৯. ধনেপাতায় এসেনশিয়াল অয়েল লিনোলেয়িক এবং লিনোলিক অ্যাসিড থাকে যার মধ্যে অ্যান্টিরিউম্যাটিক এবং অ্যান্টি-আথ্র্রাইটিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।এরা ত্বকের জ্বালাপোড়া এবং ফুলে যাওয়া কমাতে সাহায্য করে।

 

১০. ডিসইনফেকট্যান্ট, ডিটক্সিফাইং বা বিষাক্ততা রোধকারী, অ্যান্টিসেপটিক, অ্যান্টিফাঙ্গাল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান থাকার কারণে এরা বিভিন্ন স্কিন ডিজঅর্ডার বা ত্বকের অসুস্থতা (একজিমা, ত্বকের শুষ্কতা এবং ফাঙ্গাল ইনফেকশন) সারাতে সাহায্য করে। ত্বক সুস্থ ও সতেজ রাখতে তাই ধনে পাতার উপকারিতা অনেক।

 

১১. অ্যান্টি হিস্টামিন উপাদান থাকায় এরা অ্যালার্জি বা এর ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে দূরে রাখে।

 

১২. খাবারের মাধ্যমে সৃষ্ট সবচেয়ে ভয়াবহ রোগ সালমোনেলা। ধনে পাতায় উপস্থিত ডডেসিনাল উপাদান প্রাকৃতিক উপায়ে সালমোনেলা জাতীয় রোগ সারিয়ে তুলতে অ্যান্টিবায়টিকের থেকে দ্বিগুণ কার্যকর।

 

১৩. এর মধ্যে থাকা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টিইনফেকসাস, ডিটক্সিফাইং, ভিটামিন ‘সি’ এবং আয়রন গুটিবসন্ত প্রতিকার এবং প্রতিরোধ করে।

READ MORE:  পাইলস হলে করণীয় সম্বন্ধে আজই জানুন

 

১৪. ধনেপাতার মধ্যে রয়েছে বিরল ঔষধি নানা উপাদান যা রক্ত শোধন করে। খাদ্যাভ্যাসের দরুণ আমাদের শরীরে রোজ তিলে তিলে জমা হতে থাকে বেশ কিছু ভারী ধাতু এবং বিষাক্ত দূষণকারী পদার্থ। এর থেকে শরীরে বহু দূরারোগ্য অসুখ যেমন ক্যান্সার, হৃদরোগ, মস্তিষ্কের বিভ্রাট, মানসিক রোগ, কিডনি ও ফুসফুসের অসুখ এবং হাড়ের দুর্বলতা তৈরি হতে পারে। ধনেপাতা রক্তপ্রবাহ থেকে এই সমস্ত ক্ষতিকর উপাদান দূর করে শরীরকে সুস্থ ও সতেজ রাখতে সাহায্য করে।

 

১৫. ধনেপাতায় রয়েছে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, লোহা ও ম্যাগনেশিয়ামের মতো বেশ কয়েকটি উপকারী খনিজ। এছাড়া ভিটামিন এ এবং ভিটামিন কে-র জোগান দেয় এই পাতা।

 

১৬. এই উদ্ভিদ অ্যান্টিসেপ্টিক, অ্যান্টিফাংগাল এবং যে কোনও চুলকানি ও চামড়ার জ্বলনে অব্যর্থ ওষুধ। এতে রয়েছে অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি উপাদান যা বাতের ব্যথাসহ হাড় এবং জয়েন্টের ব্যথা উপশমে কাজ করে।

 

১৭. এই ধনিয়া পাতার মধ্যে থাকা অ্যান্টিইনফেকসাস, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, ডিটক্সিফাইং, ভিটামিন ‘সি’ ও আয়রন এই পদার্থ থাকার কারনে গুটিবসন্ত প্রতিকার ও প্রতিরোধ করে থাকে।

 

সতর্কতাঃ

কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধনেপাতা অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। চোখের দৃষ্টি ক্ষতি হতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে সূর্যরশ্মির সংবেদনশীলতা বা সানলাইট সেনসিটিভিটি দেখা দিতে পারে এবং অত্যাধিক মাত্রায় খাওয়া হোলে সানবার্ন হতে পারে। অবশ্য আমরা প্রতিদিন যে পরিমাণে ধনে পাতা সেবন করি তা স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি করে না। অতিমাত্রায় রস সেবন করলেই ক্ষতির কারণ হয়।

 

বীজ রোপনের পদ্ধতিঃ

 

ধনিয়ার বীজ রোপনের আগে জমি তৈরি করে নিতে হয়। তবে ভালোভাবে জমি চাষ দিয়ে এক থেকে সোয়া মিটার চওড়া করে বেড তৈরি করে নিতে হয় এবং দুই বেডের মাঝে ৪০-৫০ সেমি.নালা রাখতে হবে। বীজ রোপনের আগে জমি তৈরির সময় মাটির সাথে হেক্টর প্রতি ৫-৭ টন জৈব বা গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে বুনার আগে বীজ পানিতে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর বীজ কে আস্তে আস্তে ঘষতে হয়। ঘষার ফলে বীজরে দুটি মেরিকার্প মানে (বীজরে দুটি অংশ) আলাদা হয়ে হবে। তবে বীজ বোনার আগে ছত্রাক নাশক (ব্যাভিস্টিন বা থায়রন) দ্বারা শোধন করে নিতে হবে। শোধন করে নিলে চারার গোড়া পচা রোগ প্রতিরোধ করা সহজ হয়ে যাবে। যে জমিতে বীজ বুনবে এবং বুনার বা ছিটানোর পর হালকা চাষ এবং মই দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হয়। তারপর ৩০ সেমিঃ দূরে দূরে ১.৫ সেমিঃ গভীর করে লাইন টানতে হবে। এরপর উক্ত লাইনে বীজ বুনে ঝুরঝুরা মাট দিয়ে হালকাভাবে ঢেকে দিলে ভালো বীজ জন্মায়। তবে চারা গজানোর ১০-১৫ দিন পর প্রতি ৫ সেমিঃ পর পর একটি চারা রেখে বাকি গুলো তুলে ফেলতে হয়।

READ MORE:  কণ্ঠের যত্নে অবহেলা করছেন না তো?

 

ধনিয়া চাষের জন্য নিন্মরূপ হারে সার প্রয়োগ করতে হবে- 

 

 

সারের নাম                                     সারের পরিমান                           হেক্টর/একর

 

গোবর সার                                            ৮-১০ টন                                 প্রতি হেক্টর

 

ইউরিয়া                                    ২০০-২৫০ কেজি                                  প্রতি হেক্টর

 

টি.এস.পি                                  ১০০-১২৫ কেজি                                   প্রতি হেক্টর

 

এম.পি                                      ১০০-১৫০ কেজি                                   প্রতি হেক্টর

 

জিপসাম                                  ৬০-৭৫ কেজি                                      প্রতি হেক্টর

 

জিংক সালফেট                        ১২-১৫ কেজি                                        প্রতি হেক্টর

READ MORE:  গরমকালে ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা কেমন হওয়া উচিত?

 

ধনিয়া চাষ করার আগে জমি তৈরির সময় সমসত্ম গোবর সার এবং টি.এস.পি, অর্ধেক ইউরিয়া এমন কি এম.পি সার প্রয়োগ করতে হয়। তবে চারা গজানোর ১৫-২০ দিন পর বাকী ইউরিয়া এবং অবশিষ্ট এম.পি সার উপরি প্রয়োগ করতে হয়। তবে সার প্রয়োগের পূর্বেই আগাছা নিড়িয়ে পানি সেচ দিয়ে নিলে সবচেয়ে বেশি ভাল হবে।

 

ধনিয়া পাতা চাষের পরিচর্যা

 

বেশির ভাগ পাতা সংগ্রহের জন্য ধনিয়ার চাষ করা হয়। সেক্ষেত্রে পাতা সংগ্রহের জন্য ৩/৪ দিন পর পর হালকাভাব পানি সেচ দিতে হয়। তারপর নিড়ানি বা কাস্তে দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে মাটি ঝুরঝুরা করে দিতে হয়। পানি দিবার পর প্রতিবার সেচের পর ‘জো’আসা মাত্র মাটির চটা ভেঙ্গে আলগা করে দিতে হয়। তবে গ্রীষ্মকালে বীজ ফেলার পর বেডের উপর হালকা করে খড় বিছিয়ে দিলে ভাল হবে। সেক্ষেত্রে সেচ বা বৃষ্টির পানির ছিটিয়ে পাতায় মাটি লাগতে পারে না এবং পাতা ভালো থাকে। তবে পাতার জন্য ধনিয়া চাষের ক্ষেত্রে ৬০ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করতে হয় নতুবা নষ্ট হবার সম্ভ্যবনা থাকে। এই ফসল তুলার পর একই জমতি ২০% কম সার প্রয়োগ করে আবার এই ফসল চাষ করা যাবে।

 

ফসল কাটা

 

এই বীজ বপনের ১১০-১২০ দিন পর বীজ তোলা শুরু করতে পারবেন। এই ফসল যখন বীজ সম্পূর্নভাব পাকবে ও গাছ মোটামুটি সবুজ থাকবে তখন এই ফসল কাটার সময় হবে। সেক্ষেত্রে বীজ যেনো ঝরে পড়ে না যায় তার জন্য সকালে কুয়াশার পানি থাকতেই হাত দিয়ে টেনে বা কাঁচি দিয়ে ফসল তুলতে হবে। ধনিয়া গাছ কাটার পর ছোট ছোট আঁটি বেধে ২ / ৩ দিন ছায়ায় রেখে দিতে হয়। তারপর মাড়াই করার জন্য ছড়িয়ে দিয়ে ২-৩ দিন রোদে শুকানোর পর ফসল মাড়াই করতে পারবেন। আর পাতার জন্য ৩০-৩৫ দিন পর পাতা তোলা ভাল হবে। পাতা তুলে আঁটি করে বাজারে বিক্রির জন্য পাঠাতে পারবেন।

 

ধনিয়ার ফলন

বীজ হিসেবেঃ ১.৭-২.০ টন / হেক্টর আর পাতা/ শাক হিসেবেঃ ৩.৫-৫.০ টন / হেক্টর

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *