তিল নিয়ে যত প্রশ্ন

অনেকের মুখে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে বাদমি ও লালচে রঙের তিল হয়ে থাকে। মুখে অবাঞ্চিত দাগ এবং তিলের জন্য মুখের সৌন্দর্যই নষ্ট হয়। তাই অনেকে এর সমাধান খুঁজে থাকেন। তিল আসলে এক ধরনের ‘বিনাইন টিউমার’। তবে এসব তিল ক্ষতিকর নয়।

 

গায়ের রং নির্ভর করে ত্বকের বিশেষ কোষ মেলানোসাইটের সংখ্যা এবং এর বিস্তৃতির ওপরে। শরীরের ত্বকে যেখানে একসঙ্গে অনেক মেলানোসাইট ক্লাস্টার হিসেবে তৈরি হয় বা জমে যায়, সেই স্থান তিলে পরিণত হয়। পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরে ১০ থেকে ৪০টি তিল থাকা স্বাভাবিক। তিল সাধারণত হাত, পা বা উন্মুক্ত স্থানে বেশি দেখা যায়, যা সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আসে। কারও কারও জন্ম থেকেই তিল থাকে। আবার কারও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তিলের সংখ্যা বাড়ে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় তিলকে বলে নেভি বা নেভাস।

 

তিল কেন হয়?

 

আমাদের ত্বকে যে সমস্ত কোষ আছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো মেলানোসাইট। এই কোষ মেলানিন নামক রঞ্জক পদার্থ তৈরি করে আমাদের ত্বকের স্বাভাবিক বর্ন প্রদান করে।

 

এই মেলানোসাইট আমাদের ত্বকের সর্বত্র সুষম ভাবে বণ্টিত। কিন্তু কোনো কারণে যদি অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনের ফলে ত্বকের কোনো অংশে একত্রিত ভাবে একগুচ্ছ মেলানোসাইটের জন্ম ও বৃদ্ধি হয় তাহলেই তিল বা আঁচিলের সৃষ্টি হয়ে থাকে।

 

সাধারণ তিলের আকার পাঁচ মিলিমিটারের কম হয়। রং বাদামি, লালচে বা কালো থাকে। উপরিভাগ মসৃণ আর আকারে বৃত্তাকার বা ওভাল। আশপাশের ত্বক থেকে স্পষ্টভাবেই আলাদা, কখনো খানিকটা উঁচু থাকে।

 

তিল ক্ষতিকর নয়?

 

তিল সাধারণত জিনগত কারণে হয়। অতিরিক্ত সূর্যালোকে যাওয়া ও রেডিয়েশন থেরাপি দীর্ঘদিন চললেও তিল হতে পারে। কেউ দীর্ঘদিন অন্য কোনো রোগের ওষুধ সেবন করলেও তিল দেখা দিতে পারে। সাধারণত তিল বা আঁচিল শরীরের ক্ষতি করে না। তবে শরীরের তিলের পরিবর্তন বা স্ফীতি দেখা দিলে, তার সঙ্গে খাবারে অরুচি, হঠাৎ ওজন হ্রাস, মলত্যাগের অভ্যাসের আকস্মিক পরিবর্তন থাকলে অবহেলা করা ঠিক না। কোনো কোনো সময় পরিবর্তিত তিল ক্যানসারের লক্ষণ বলে ধরা হয়।

 

তিলের প্রকারভেদ 

 

জন্মদাগ বা কনজেনিটাল নেভি

 

জন্মের সময় থেকে উপস্থিত কনজেনিটাল নেভি প্রায় ১০০ জনের মধ্যে একজনের মধ্যেই দেখা যায়। তবে এই ক্ষেত্রে মেলানোমা (ক্যান্সার) হওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা বেশি থাকে।

 

ডিসপ্লপ্লাস্টিক নেভি

 

এটি আকারে কনজেনিটাল নেভির থেকে আকারে সামান্য বড় এবং আকারে অনিয়মিত হয়। গাঢ় বাদামী বর্ণের কেন্দ্র এবং হালকা, অসম প্রান্ত। এই নেভিগুলি মেলানোমা হওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা বেশি।

আসলে, যাদের ১০ বা ততোধিক ডিসপ্লপ্লাস্টিক নেভি রয়েছে তাদের ত্বকের ক্যান্সার, মেলানোমা হওয়ার ১২ গুণ বেশি সম্ভাবনা রয়েছে।

 

লেন্টিগো 

শ্বেতাঙ্গ মানুষের মধ্যে লেন্টিগো হওয়ার বেশি প্রবণতা দেখা যায়। সাধারণত এ ক্ষেত্রে ত্বকের কোনো অংশ বাকি অংশের তুলনায় গাঢ় হয়ে থাকে। অতিরিক্ত সূর্যালোক, জেনেটিক্যাল কারণ অথবা রেডিয়েশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে লেন্টিগোর আবির্ভাব হতে পারে।

 

আঁচিল বা স্কিন ট্যাগ

 

এগুলি সাধারণত বিপদ্দজনক নয় এবং কোনো ব্যথাও সৃষ্টি করে না। আঁচিল ঘাড়ে, বুকে, পিঠে বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়। মহিলাদের ওজন বৃদ্ধির সাথে সাথে এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে আঁচিল হওয়ার বেশি প্রবণতা দেখা যায়

 

ফ্রেকল

 

সাধারণত যারা ফর্সা হয় তাদের মধ্যে এই ফ্রেকল দেখা যায়। মুখ, বাহু, ঘাড় এবং বুকে এই বাদামি রঙের ছোট ছোট স্পট সৃষ্টি হয়। এটি একেবারেই বিপদ্দজনক তো নয়ই বরং খুব স্বভাবিক।

 

সেবোরহেইক কেরাটোসিস 

 

এটি কেরাটোসাইট নামক কোষ থেকে সৃষ্টি হয় I কালো অথবা খয়েরি বর্ণ বিশিষ্ট ত্বকের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বুক, পিঠ এবং কিছু ক্ষেত্রে মাথায় দেখা যায় I তবে এটিও ক্যান্সার বা অন্য কোনো ক্ষতি সাধন করে না I

 

লাল তিল

 

শরীরের যে অংশে চামড়া তার ঠিক নিচেই শিরা (যেমন ঘাড়, গলা, পিঠ কিংবা বুক) থাকে, সেখানেই এ ধরনের লালচে তিল হয়। চিকিৎসার ভাষায় এর নাম ক্যাম্পবেল দ্য মরগ্যান স্পট। ত্রিশের বেশি বয়সে যখন রক্তবাহী শিরা বা ধমনি পাতলা থাকে, তখনই এ ধরনের তিল তৈরির আশঙ্কা বাড়ে।

 

কালো তিল

 

মেলানিন ত্বকের কোন স্থানে বেশি মাত্রায় জড়ো হলে কালো তিল হয়।

 

বাদামী তিল

মেলানিন সংশ্লেষণ সুষমভাবে না হলে শ্বেতাঙ্গ লোকদের ত্বকে এই ধরণের বাদামী তিল বেশি দেখা।

 

অতিরিক্ত তিল কি ক্যানসারের লক্ষণ

 

গবেষকদের মতে, শরীরে তিল বা আঁচিলের সংখ্যা থেকে ত্বকের ক্যানসারের বিষয়ে ধারণা করা যায়। কিংস কলেজ লন্ডনের গবেষকেরা প্রায় আট বছর ধরে নারীদের ত্বকের ধরন, তিল ও আঁচিলের সংখ্যা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জোগাড় করেন।

 

তাঁরা বলছেন, যাদের ডান হাতে ১১টির বেশি তিল বা আঁচিল রয়েছে এবং সারা শরীরে ১০০টির বেশি তিল বা আঁচিল রয়েছে, তাদের মেলানোমার ঝুঁকি বেশি।

 

খুবই বিরল হলেও কিছু তিল থেকে ত্বকের ক্যানসার মেলানোমা হতে পারে। যদি নিচের পরিবর্তনগুলো লক্ষ করে থাকেন, তবে তা চিকিৎসককে জানানো উচিত।

 

তিলের রং হঠাৎ পরিবর্তন হওয়া, হঠাৎ আকারে অনেক বেড়ে যাওয়া বা ছোট হয়ে যাওয়া, তিলের আকৃতি মসৃণ হওয়া ইত্যাদি পরিবর্তন, তিলের উপরিভাগ যদি শুষ্ক আর মাছের আঁশের মতো খসখসে মনে হয়, চুলকানি দেখা দেয় বা রক্তপাত হয়।

 

অনেকের মুখে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে বাদামি, কালো ও লালচে রঙের তিল হয়ে থাকে। মুখে–গলায় অবাঞ্ছিত ও অজস্র তিলের জন্য মুখের সৌন্দর্য নষ্ট হয়। অনেকে এর সমাধানও খুঁজে থাকেন।

 

চিকিৎসা

 

 চিকিৎসকরা বলেন, কোনো ওষুধ বা মলম ব্যবহারে এসব তিল দূর করা যায় না। তিল সমস্যা দূর করতে অনেক সময় ডারমেটো সার্জারির প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া করেই অপারেশন করা হয়। আর ইলেকট্রো সার্জারিও করা লাগতে পারে।

 

তিল এড়ানো সম্ভব?

 

নতুন নতুন তিল তৈরি এড়াতে হলে যতটা সম্ভব রোদ এড়িয়ে চলা আর রোদে বের হলে ভালো ব্র্যান্ডের সানব্লক ব্যবহার করা উচিত। তা ছাড়া রোদে গেলে ছাতা ব্যবহার করা ভালো। সুষম খাবার খাওয়া ও প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা দরকার। যতটা সম্ভব রোদ এড়িয়ে চলা, ভালো ব্র্যান্ডের সান ব্লক ব্যবহার করা, রোদে গেলে ছাতা, স্কার্ফ ও ব্যবহার করা এবং সুষম খাবার খাওয়া ও প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা- এই বিষয়গুলো অবশ্যই মেনে চলতে হবে। 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *