মরণব্যধি জলাতঙ্ক থেকে বাঁচার উপায়

মরণব্যধি জলাতঙ্ক থেকে বাঁচার উপায়

র‌্যাবিস ভাইরাস ঘটিত একটি মারাত্মক রোগ হলো জলাতঙ্ক। আমাদের দেশে জলাতঙ্ক রোগে বছরে প্রায় ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। জলাতঙ্কের ক্ষেত্রে মৃত্যুহার প্রায় শতভাগ। অর্থাৎ রোগলক্ষণ একবার প্রকাশ পেলে রোগীকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব। জলাতঙ্ক সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাই জেনে রাখা জরুরি। একে হাইড্রোফোবিয়া কিংবা পাগলা রোগও বলা হয়। আক্রান্ত রোগী পানি দেখে বা পানির কথা মনে পড়লে প্রচণ্ড আতঙ্কিত হয়ে পড়ে বলে এই রোগের নাম হয়েছে জলাতঙ্ক। এটি প্রাণিবাহিত র‌্যাবিস ভাইরাসঘটিত রোগ, রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর আক্রান্ত রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।

 

বিশ্বে প্রতি ১০ মিনিটে একজন এবং প্রতিবছর প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ জলাতঙ্ক রোগে মারা যান। বাংলাদেশেও বছরে গড়ে ৪০ থেকে ৫০ জন রোগী মৃত্যুবরণ করেন জলাতঙ্কে। শুধু মানুষই নয়, প্রতিবছর প্রায় ২৫ হাজার গবাদিপশুও জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে থাকে দেশে। রোগটি প্রতিরোধের লক্ষ্যে মানুষকে সচেতন করতেই গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর র‌্যাবিস কন্ট্রোলের উদ্যোগে প্রতিবছর ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জলাতঙ্ক দিবস পালিত হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য—জলাতঙ্ক: ভয় নয়-সত্য জানুন।

 

জলাতঙ্ক যেভাবে ছড়ায়:

 

 কুকুর, শিয়াল, বিড়াল, বানর, বেঁজি, বাদুড় ইত্যাদি র্যাবিস জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে এবং আক্রান্ত উল্লেখিত প্রাণি মানুষকে কামড়ালে মানুষের এ রোগ হয়। এসব আক্রান্ত প্রাণির মুখের লালায় র্যাবিস ভাইরাস থাকে। এ লালা পুরোনো ক্ষতের বা দাঁত বসিয়ে দেওয়া ক্ষতের বা সামান্য আঁচড়ের মাধ্যমে রক্তের সংস্পর্শে এলে রক্তের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং জলাতঙ্ক রোগ সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে শতকরা ৯৫ ভাগ জলাতঙ্ক রোগ হয় কুকুরের কামড়ে।

 

জলাতঙ্ক রােগ এর উপসর্গ – 

 

রেবিস হচ্ছে প্রােগ্রেসিভ অসুখ অর্থাৎ রােগ বাড়লে উপসর্গ তীব্র হতে থাকে। কোনও ব্যক্তির ভাইরাস সংক্রমণের সময় থেকে যত সময় বাড়তে থাকে তত উপসর্গ পাল্টাতে থাকে। রেবিসের উপসর্গ বাড়তে ৩০ থেকে ৬০ দিন পর্যন্ত যে কোনও সময় লাগে। বিভিন্ন পর্যায়ে রেবিস সংক্রমণের উপসর্গ নিম্নলিখিত ভাবে দেখা যায়:

 

  • ইনকিউবেশন (উন্মেষপর্ব) সংক্রমণের পর প্রথম দিনগুলিতে ক্ষতস্থান ঘিরে চারপাশে শিরশিরানি বা যন্ত্রণার অনুভূতি থাকে। তার সঙ্গে কিছু অস্বাচ্ছন্দ্য যেমন চুলকানি, যা রােগের প্রথম ইঙ্গিত হতে পারে কিন্তু এগুলিকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না।

 

  • প্রােড্রোমাল। ধীরে ধীরে বমিভাব, শীত শীত লাগা, ঠান্ডা, এবং জ্বর দেখা যায়। এই পর্যায়ে পেশিতে ব্যাথা এবং অন্যান্য উপসর্গের সঙ্গে অসহিষ্ণুতা দেখা যায়। এই উপসর্গগুলিকে বহু সময়ে সাধারণ ভাইরাস সংক্রমণ বা সাধারণ ফ্লু বলে ধরে নেয়া যায়। 

 

  • চূড়ান্ত নিউরােলজিক পিরিয়ড বা অবস্থা

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উপসর্গ তীব্র আকার ধারণ করে, যখন প্রবল জ্বর আসে, অসংলগ্নতা দেখা দেয়, এবং রােগী আক্রমণাত্মকও হয়ে উঠতে পারে। এই পর্যায়ে রােগীর তড়কা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। অন্যান্য যে। সমস্ত উপসর্গ দেখা যায় তার মধ্যে খিচুনি, আংশিক পক্ষাঘাত, আলােতে ভয়, ঘন ঘন শ্বাস, এবং লালা ঝরা (হাইপারভেন্টিলেশন) অন্যতম। 

 

  • অন্তিম পর্যায় রেবিসে আক্রান্ত ব্যক্তি জলের সংস্পর্শে এলে দুশ্চিন্তা এবং প্যানিক অ্যাটাকে ভুগতে পারেন। এই অবস্থাকে সাধারণভাবে বলা হয় হাইড্রোফোবিয়া বা জলে আতঙ্ক। এই পর্যায়ে যখন সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছে তখন আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসের জন্য সাহায্য এবং বাঁচিয়ে রাখার জন্য চিকিৎসা প্রয়ােজন। শেষ পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তি কোমায় চলে যায় এবং শ্বাসকষ্টের জন্য পেশি নড়ানাের শক্তি থাকে না। এই পর্যায় বেশিদিন থাকে না এবং কয়েকদিনের মধ্যেই রােগী মারা যায়।

 

জলাতঙ্ক রোগ এর চিকিৎসা 

 

কোন সময়ে, কোন প্রাণী কামড়েছে, এবং উপসর্গের চেহারা কীরকম, তার ওপর চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ভর করবে। রেবিসের সাধারণ চিকিৎসার পদ্ধতি নিম্নরূপ:

 

  • নিরাময় গুণসম্পন্ন সাবান এবং জল দিয়ে ক্ষতস্থান অন্তত ১৫ মিনিট ধরে ভাল করে ধুয়ে ফেলা এবং সংক্রমণ মুক্ত করা। যদি ত্বকের মধ্যে ছিদ্র হয়ে থাকে তাহলে ওপর থেকে তােড়ে সাবান জল ফেলে পরিষ্কার করতে হবে। খুব প্রয়ােজন না হলে ক্ষতস্থান সেলাই না করাই ভাল।

 

  • এরপর, টেটেনাস এবং/ বা অ্যান্টিবায়ােটিক

ইনজেকশন দিতে হবে। 

 

  • প্রাথমিক চিকিৎসার পর আক্রান্তকে রেবিসের টিকা দিতে হবে। যদি ওই ব্যক্তিকে কোনও বাড়ির পােষ্য প্রাণী কামড়ে থাকে এবং কোনও উপসর্গ না দেখা যায়। (আসিম্পটোম্যাটিক), তাহলে চিকিৎসক ওই ব্যক্তি এবং প্রাণীটিকে দিন কয়েকের জন্য সতর্কতার সঙ্গে নজরে রাখার পরামর্শ দেবেন। যদি পােষ্যটিকে নজরে রাখা না জায় তাহলে ওই এলাকায় কোনও রেবিসের আক্রমণ দেখা গিয়েছে কিনা তা সমীক্ষা চালিয়ে দেখা হবে। যদি পরীক্ষা চালিয়ে প্রাণীটির মধ্যে রেবিসের। চিহ্ন পাওয়া যায়, তাহলে সেটিকে মেরে ফেলতে হবে এবং তারপর পুত্থানু ইড সহ সর্ট বিসের পরীক্ষা চালানাে হবে। যদি যেখানে প্রাণীটিকে দেখা গিয়েছে  সেখানে রেবিসের চিহ্ন না পাওয়া যায় তাহলে কিছু প্রতিরােধী ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়ােজন হবে না। 

 

  • যদি প্রাণীটি যাকে কামড়েছে তার মধ্যে রেবিসের উপসর্গের ইঙ্গিত পাওয়া যায় তাহলে চিকিৎসক অবিলম্বে প্রতিরােধী চিকিৎসা শুরু করে দেন। রেবিস প্রতিরােধী ইমিউনােগ্লবিন ইনজেকশন দিয়ে চিকিৎসা করা হয় যা রােগ প্রতিরােধে সাহায্য করে এবং শরীরে রেবিসকে বাসা বাঁধতে দেয় না। পনেরােদিন ধরে পরপর এই ধরনের ৫ টি ইনজেকশন দেওয়া হয়। যেখানে প্রাণীটিকে নজরে না রাখা যায় সেই অবস্থায় কিছু চিকিৎসক প্রতিশেধক হিসাবে এই ইনজেকশনগুলি দেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। যদি বন্য প্রাণী কামড়ায় তাহলে প্রায় সর্বক্ষেত্রে এই চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া হয়।

 

  • যে সব ক্ষেত্রে উপসর্গ দেখা দিয়েছে কিন্তু প্রতিরােধী চিকিৎসার সময় পার হয়ে গিয়েছে, সেখানে তড়কা যাতে না হয় তার জন্য ওষুধ দেওয়া হয়। দুশ্চিন্ত দূর করার জন্য পেশি নমনীয় রাখার রিল্যাক্সন্ট এবং ওষুধের সঙ্গে ব্যাথা কমানাের ওষুধ প্রয়ােগ করা হয়।

 

  • চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে ওই ব্যক্তিকে সতর্কতার সঙ্গে নজরে রাখা এবং রােগ বেড়ে যাওয়ার কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে কিনা সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি। সেরকম কোনও ইঙ্গিত দিলে চিকিৎসককে সতর্ক করা প্রয়ােজন।

 

সর্বোপরি জলাতঙ্ক প্রতিরোধে পোষা ও অ-পোষা সব বিড়াল-কুকুরকে জলাতঙ্কের টিকা কার্যক্রমের আওতায় আনাও একটি কার্যকর উপায়। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই মৃত্যুদূত ব্যাধিকে করায়ত্ত করা সম্ভব।

 

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *