ইসলামইসলামিক বিষয়াদি

বিসমিল্লাহ নাই যে সূরায় : কেন?

‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’। এটি কোরআনের স্বতন্ত্র আয়াত। এটি এমন ফজিলতপূর্ণ আয়াত, যা পাঠ করার মাধ্যমে ওই কাজে বরকত ও পূর্ণতা আসে।  

 

সব ভাল কাজের আগে বিসমিল্লাহ পড়ার নির্দেশ রয়েছে।

 

তবে আল্লাহর দুটি গুণবাচক নাম সংবলিত এই বাক্যটি সূরা তাওবা ছাড়া কোরআনের সব সূরার শুরুতে আছে।

 

সুরা তাওবার শুরুতে কেন বিসমিল্লাহ লেখা হয় না। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পরে পৃথক পৃথক এর দুটি কারণ জানা যায়।

 

প্রথমতঃ সুরা তাওবা স্বতন্ত্র কোন সুরা নয়; বরং এটি অন্য একটি সুরা অর্থাৎ, সুরা আনফালের অংশ। এর অর্থ হল সুরা আনফাল এবং আমরা যাকে সুরা তাওবা বলি উভয়ের সমষ্টি একটি পূর্ণাঙ্গ সুরা। তো তাওবা যেহেতু স্বতন্ত্র সুরা নয়। আর বিসমিল্লাহ আসে সুরার প্রারম্ভে, সুরার মধ্যে নয়, তাই বিসমিল্লাহ লেখা হয় না।

 

বিষয়টি আরো কিছুটা বিস্তৃত করা প্রয়োজন। আমরা জানি কুরআন মাজীদ তেইশ বছরের দীর্ঘ পরিসরে অল্প অল্প করে নাযিল হয়। এমনকি একই সুরার বিভিন্ন আয়াত বিভিন্ন সময়ে অবতীর্ণ হয়। হযরত জিবরাইল (আ.) ওহী নিয়ে উপস্থিত হলে আল্লাহর নির্দেশ মতে কোন সুরার কোন আয়াতের পর অত্র আয়াতকে স্থান দিতে হবে, তাও বলে যেতেন। সে মতে রাসুল (সা.) ওই লেখকদের দ্বারা তা লিখিয়ে একটি সুরা সমাপ্ত হওয়ার পর দ্বিতীয় সুরা শুরু করার আগে বিসমিল্লাহির রাহমানিয় রাহীম নখিল হত।

 

কুরআন মজীদের সকল সুরার বেলায় এ নীতি বলবৎ থাকে। সুরা তাওবা সর্বশেষ নাযিলকৃত সুরাগুলোর অন্যতম। কিন্তু সাধারণ নিয়ম মতে এর শুরুতে না বিসমিল্লাহ নাযিল হয় আর না রাসুল (সা.) তা লিখে নেয়ার জন্যে ওহী লেখকদের নির্দেশ দেন। এমতাবস্থায় রাসুল (সা.)এর ইন্তিকাল হয়। কুরআন সংগ্রাহক হযরত ওসমান গণী (রাযি.) স্বীয় শাসনামলে যখন কুরআনকে গ্রন্থের রূপ দেন, তখন দেখা যায় অপরাপর সুরার বরখেলাপ। সুরা তাওবার শুরুতে বিসমিল্লাহ নেই। তাই সন্দেহ ঘনীভূত হয় যে, হয়তো এটা স্বতন্ত্র কোন সুৱা নয়। বরং অন্য কোন সুরার অংশ। এতে এ প্রশ্নেরও উদ্ভব হয় যে, এমতাবস্থায় কোন সুরার অংশ হতে পারে? বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে একে সুরা আনফালের অংশ বলাই সঙ্গত।

 

হযরত ওসমান (রাযি.) এর এক রেওয়ায়াতে একথাও বর্ণিত আছে যে, নবী (সা.) এর যুগে সুরা আনফাল ও তাওবাকে কারীনাতাইন বা মিলিত সুৱা বলা হত। (মাজহারী) সেজন্য সুরা আনফালের পরে এর স্থান হয়। এতে এ সতর্কতাও অবলম্বিত হয়েছে যে, বাস্তবে যদি এটি সুরা আনফালের অংশ হয় তবে তারই সাথে যুক্ত থাকা দরকার।

 

পক্ষান্তরে সুরা তাওবার স্বতন্ত্র সুরা হওয়ার সম্ভাবনাও কম নয়। তাই কুরআন লিপিবদ্ধ করার সময় সুরা আনফালের শেষে এবং সুরা তাওবার শুরুতে কিছু ফাঁক রাখার ব্যবস্থা নেয়া হয়। যেমন, অপরাপর সুরার শুরুতে বিসমিল্লাহ-এর স্থান হয়। সুরা তাওবার শুরুতে বিসমিল্লাহ লিখিত না হওয়ার এ সমুহে কয়েকজন সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত রয়েছে।

 

এ বিষয়ে হযরত ইবনে আব্বাস তত্ত্বটি হাদীসের কিতাব (রাযি.) হযরত ওসমান (রাযি.)কে প্রশ্নও করেছিলেন যে, যে নিয়মে কুরআনের সুরাগুলোর বিন্যাস করা হয়, অর্থাৎ প্রথম দিকে শতাধিক আয়াত সম্বলিত বৃহৎ সুরাগুলো রাখা হয়। পরিভাষায় যাদের বলা হয় ‘মি-ঈন’ অতঃপর রাখা হয় শতের কম আয়াত সম্বলিত সুৱাগুলো যাদের ‘মাসানী’ বলা হয়। এর পর স্থান দেয়া হয় ছোট সুরাগুলোকে যাদের বলা হয় মুফাচ্ছালাত’।

 

কুরআন সংকলনের এ নিয়নুসারে সুরা তাওবাকে সুরা আনফালের পুর্বে স্থান দেয়া কি উচিত ছিল না? কারণ তাওবার আয়াত সংখ্যা শতের অধিক। আর সুরা আনফালের আয়াত সংখ্যা শতের কম। প্রথম দিকের দীর্ঘ সাতটি সুরাকে আয়াতের সংখ্যানুসারে যে নিয়মে রাখা হয়েছে যাদেরকে লরংঃব বলা হয়। তদানুসারে আনফালের স্থলে সুরা তাওবার থাকাই তো অধিক সঙ্গত। অথচ এখানে এ নিয়মের বরখেলাফ করা হয়। এর রহস্য কি?

 

হযরত উসমান (রাযি.) বলেন, কথাগুলো সত্য কিন্তু কুরআনের বেলায় যা করা হল তা শুধুমাত্র সাবধানতার খাতিরে, কারণ বাস্তবে যদি সুরা তাওবা স্বতন্ত্র সুরা না হয়ে আনফালের অংশ হয়। আর একথা প্রকাশ্য যে, আনফালের আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয় তাওবার আয়াতসমূহের বহু পূর্বে। তাই নস্ বা ওহীর ইঙ্গিত ব্যতীত আনফালের পূর্বে সুরা তাওবাকে স্থান দেয়া আমাদের পক্ষে বৈধ হবে না।

 

আর একথাও সত্য যে, ওহীর মাধ্যমে এ ব্যাপারে আমাদের কাছে কোন দিকনির্দেশনা আসেনি। তাই আনফালকে আগে এবং তাওবাকে পরে রাখা হয়েছে। এ তত্ত্ব থেকে বুঝা যায় যে, সুরা তাওবা স্বতন্ত্র সুরা না হয়ে সূরা আনফালের অংশ হওয়ার সম্ভাবনাটিই এর শুরুতে বিসমিল্লাহ না লেখার কারণ। এ সম্ভাবনা থাকার ফলে এখানে বিসমিল্লাহ লেখা বৈধ নয়। যেমন, বৈধ নয় কোন সুরার মাঝখানে বিসমিল্লাহ লেখা।

 

দ্বিতীয়তঃ এই সুরার নামের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে এবং সুরার প্রথম শব্দের প্রতি লক্ষ্য করলে সহজেই বুঝে আসবে। সুরা তাওবার আর একটি নাম হচ্ছে ‘বারাআত’। একে বারাআত বলা হয় এজন্য যে, এতে কাফেরদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ও তাদের ব্যাপারে দায়িত্বমুক্তির উল্লেখ রয়েছে। আর বিসমিল্লাহ হচ্ছে শান্তির প্রতীক। তো শাস্তি আর দায়িত্বমুক্তি পারস্পরিক বিরোধ থাকায় বিসমিল্লাহ উল্লেখ না করেই সরাসরি ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়েছে।

 

এর সমর্থনে হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) কর্তৃক হযরত আলী (রাযি.) থেকে বর্ণিত, একটি রেওয়ায়াত উল্লেখ করা যেতে পারে । এতে সুরা তওবার শুরুতে বিসমিল্লাহ না লেখার কারণ দর্শানো হয় যে, বিসমিল্লাহতে আছে শাস্তি ও নিরাপত্তার পয়গাম কিন্তু সুরা তওবায় কাফেরদের জন্যে শাস্তি ও নিরাপত্তা চুক্তিগুলো নাকচ করে দেয়া হয়। তাই তওবার শুরুতে বিসমিল্লাহ লেখা হয়নি ।

 

সুতরাং, আমরা বুঝতে পারলাম, সুরা তওবার শুরুতে বিসমিল্লাহ না লেখার কারন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link