ইতিহাসকী এবং কেন?

বাকশাল কি এবং কেন?

বাকশাল এর পূর্ণরূপ বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। এটি বঙ্গবন্ধুর একটি একক রাজনৈতিক দল, যা তিনি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে গঠন করেন। ১৯৭৫ সালে সংবিধান সংশোধন করে বহুদলীয় রাজনীতি বিলুপ্ত করে এক দলীয় রাজনীতি ব্যবস্থা কায়েম করার নামই বাকশাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই একক রাজনৈতিক দল বাকশাল গঠনের পিছনে অনেকগুলো কারণ বিদ্যামান ছিল। আজকের আলোচনায় বাকশাল গঠনের প্রেক্ষাপট এবং এর লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে আলোকপাত করব।

 

বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল গঠিত হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৫। বাকশাল পদ্ধতি কায়েম করার জন্য ১৯৭২ সালের সংবিধানের ব্যাপক মৌলিক পরিবর্তন আনতে হয়। সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর এনে বাংলাদেশে বহু রাজনৈতিক দলীয় পদ্ধতি পরিবর্তন করে শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতি শাসিত এককদলীয় শাসন ব্যবস্থা করা হয়। 

 

বাকশালের চেয়ারম্যান ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সেক্রেটারী ছিলেন ক্যাপ্টেনে এম. মনসুর আলী। বাকশাল গঠনের মাধ্যমে এটি বাংলাদেশের একমাত্র জাতীয় দল হিসেবে পরিগণিত হয়। আওয়ামী লীগ সহ বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।

 

বাকশাল এবং সংবিধানের সংশোধনী

 

বাকশাল গঠনের জন্য সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনা হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী, বঙ্গবন্ধু সংসদে এটি উত্থাপন করেন। একই দিনেই সংবিধান সংশোধন বিলটি পাস হয়ে যায়। এই সংশোধনের ফলে বাংলাদেশের সংবিধানের অনেক কাঠামোগত পরিবর্তন হয়। মূল সংবিধানের যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছিল তা হচ্ছে,

 

  • -সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে একদলীয় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার।
  • -একমাত্র রাষ্ট্রপতি সকল ক্ষমতার কেন্দ্র। তিনি তাঁর পদাধিকার বলে গঠিত বাকশালের নির্বাহী কমিটি, কেন্দ্রীয় কমিটি, এবং দলীয় কাউন্সিল এর সভাপতি ছিলেন।
  • -জাতীয় সংসদের সকল ক্ষমতা বিলুপ্ত
  • বিচার বিভাগের স্বাধীনতা লোপ এবং এর উপর রাষ্ট্রপতির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। কোন রকম পরামর্শ ছাড়াই বিচারপতি নিয়োগ ও বরখাস্ত করার ক্ষমতা
  • -ইচ্ছেমত মন্ত্রিপরিষদ গঠন
  • -সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া
  • -উপরাষ্ট্রপতির পদ সৃষ্টি। 
  • -সরকারী কর্মকর্তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দান।
  • -নির্বাচন কমিশন ও সরকারী কর্মকমিশনের যাবতীয় ক্ষমতা হ্রাস
  • -নতুন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রণয়ন। সারা দেশ ৬০টি জেলায় বিভক্ত করে ৬০ জন গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়।
  • -রাষ্ট্রপতির অপসারণে পূর্বের দুই-তৃতীয়াংশের পরিবর্তে তিন-চতুর্থাংশ সংসদ সদস্যের সমর্থন বিধান করা হয়।
  • -একদলীয় শাসন ব্যবস্থা। ফলে বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে শুধুমাত্র একটি একক জাতীয় দল গঠন করা, যা বাকশাল নামে নামকরণ করা হয়।

 

সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী প্রবর্তনের কারণ

 

গণতান্ত্রিক সংসদীয় রাজতিক দলের সুযোগ নিয়ে অনেকেই সরকার বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিল। এরা গোপনে চক্রান্ত করে সরকার হঠানোর কৌশলে নিমত্ত ছিল। স্বাধীনতা বিরোধী সংগঠন এবং বামপন্থী দলের কর্মীরা সরকার দলীয় অনেক নেতাকে হত্যার করে। তারা সর্বত্র খুন, হানাহানি, এবং রৈাজ্য সৃষ্টি করছিল। রাজনৈতিক এমন অস্থিরতা বিরাজ দেখে বঙ্গবন্ধু এই বাকশাল গঠনে উদ্যোগ গ্রহণ করে।

 

চতুর্থ সংশোধনী আনয়নের পিছনে রাজনৈতিক সমস্যা ছাড়াও অর্থনৈতিক সংকট ছিল অন্যতম কারণ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে মহা বিপর্যয় দেখা দেয়। পরপর কয়েক বছর বন্যা ও খরার কবলে পড়ে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতি হয়। এর ফলে দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তার উপর বিশ্বব্যাপি মুদ্রাস্ফীতির কারণে অত্যাধিক মূল্যে বিদেশ থেকে আমাদানি করতে হয়। রফতানিতেও বেহাল দশা ছিল। 

 

রফতানিকৃত পণ্যের সঠিক মূল্য না পাওয়া, কালোবাজারী ও চোরাচালানের উপদ্রেক বেড়ে যাওয়া, দুর্নীতি, এবং সুদখোর ইত্যাদির ফলে তখন দেশে একটি মারাত্মক অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দেয়। বিদেশ থেকে যেসব সাহায্য সহযোগিতা এসছিল, সবগুলোর সঠিক বন্টন হতে দেয়নি লুঠতরাজ নেতাদের কারণে। এছাড়াও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কর্মী এসব কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। দেশব্যাপি অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে সংবিধানের সংশোধন করা হয়।

 

বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে আইন শৃংখলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি লক্ষ্য করা যায়। মার্কসবাদী এবং মস্কোপন্থী ইত্যাদি মনোভাবের সদস্যরা দেশের অভ্যন্তরে গোপনে উগ্র কার্যকলাপে ব্যস্ত ছিল। এরা সমগ্র দেশে গুপ্ত হত্যা, লুণ্ঠন, রাহাজানি করতে থাকে। ফলে আইন শৃংখলা চরম অবনতি ঘটে। এ থেকে উত্তোরণের জন্য সরকার ১৯৭৪ সালে এক অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে বাংলাদেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে। 

 

বাকশালের শাসন কাঠামো

৭ জন, ১৯৭৫, বাকশাল সরকারের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমান বাকশালের গঠনতন্ত্র জারি করেন। এর মাধ্যমে দলের নামকরণ, আইন কানুন, দলীয় শৃংখলা, সদস্য অন্তর্ভুক্তকরণ, অর্থ সংগ্রহ ইত্যাদির একটি কাঠামো প্রণয়ন করা হয়। বাকশালের গঠনতন্ত্র অনুসারে এটির ৭টি স্তর বিদ্যামান।

 

  • ১. একটি কার্যনির্বাহী কমিটি
  • ২. একটি কেন্দ্রীয় কমিটি
  • ৩. দলীয় কাউন্সিল
  • ৪. প্রতি জেলায় একটি জেলা কমিটি
  • ৫. প্রতি জেলায় একটি জেলা কাউন্সিল
  • ৬. প্রতি থানায় একটি থানা কমিটি
  • ৭. প্রতি ইউনিয়নে একটি ইউনিয়ন কমিটি।

 

বঙ্গবন্ধু তার ক্ষমতা বলে নির্বাহী কমিটি, কেন্দ্রীয় কমিটি, এবং দলীয় কাউন্সিল এই তিন কেন্দ্রীয় সংস্থার সভাপতি। পুরো দলের সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকতো নির্বাহী কমিটির উপর। এই নির্বাহী কমিটিও সভাপতি কর্তৃক নিয়োগ হত। সভাপতির ইচ্ছে অনুযায়ী নিয়োগ ও অপসারণ করতে পারতেন। সভাপতির মাধ্যমে সাধারণ সম্পাদক ও অন্যন্য সদস্যগণ নিয়োগ হত। বাকশাল নির্বাহী কমিটি ১৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয়। এছাড়া ১১৫ জন সদস্য নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link