জীবনীসাহিত্য

আমাদের একজন আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন

বাংলাদেশে তুমুল জনপ্রিয় ও লাখো শ্রোতা সংগীত শিল্পী অনেকেই আছেন। কিন্তু মিউজিসিয়ান হিসেবে, গিটার বাজানোর জন্য সমগ্র উপমহাদেশে যদি কেউ  বিখ্যাত থেকে থাকেন , তিনি আর কেউ নয়।  আইয়ুব বাচ্চু। 

 

 

 

আইয়ুব বাচ্চু দীর্ঘ চার দশক  ধরে কয়েক প্রজন্মের শ্রোতাদের মাঝে  সংগীত করেছেন; তার এই চার দশকের  সংগীতের যাত্রায়  দেশে বিদেশে তার শ্রোতা, সংগীত সহযোদ্ধাদের ঘিরে ৪০ হাজারেরও বেশি ঘটনা থাকার কথা এবং বোধ করি আছেও। এসব ঘটনার মধ্যে তার  একান্ত ব্যক্তিগত ঘটনাগুলো আমাদের জানার কথা নয়। কিন্তু যে সব উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো জনসমক্ষে এসেছে তার ভিতর থেকে চমকপ্রদ কিছু ঘটনা নিয়ে আমাদের এই আয়োজন।

 

 

 

 ১. একই অনুষ্ঠানে প্রতিযোগী থেকে বিচারকঃ

 একবার আইয়ুব বাচ্চু তার ব্যান্ড নিয়ে  গিয়েছেন  কলকাতার যাদবপুরে। কন্সার্ট  করতে। সেই যাদবপরেই একটা পোস্টারে দেখতে পান যে, ব্যান্ডদলের একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন হচ্ছে। সেখানে নতুন নতুন ব্যান্ড দল অংশগ্রহণ করবে। মজা করে ঐ প্রতিযোগিতায়  নিজেদের অর্থাৎ তার ব্যান্ডের নাম দিয়ে দিলেন।  প্রতিযোগিতার আয়োজকরা তাদের কনসার্ট  শুনে, তাদের বাজনায় এতটাই মুগ্ধ হয়ে যান যে, প্রতিযোগী হিসেবে তাদের আর অপমান করতে চাননি।   প্রতিযোগী থেকে তাদের নাম প্রত্যাহার করিয়ে উক্ত প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে নিয়ে নেন।

 

 

 

২. রতনে রতন চিনেঃ

 আইয়ুব বাচ্চু একবার কলকাতায়  তার জন্য বরাদ্দ গোলপার্কের  কাছে একটি গেস্ট হাউস এর সামনে ফুটপাতে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন। কলকাতায় এক কনসার্ট করে ফিরে এসেছেন তিনি। এমন সময় কাঁধে গিটার ঝোলানো ঝাঁকড়া চুলের এক যুবক আইয়ুব বাচ্চুর সাথে দেখা করতে আসলো। তার সাথে কথা বলে আইয়ুব বাচ্চু জানতে পারলেন যুবকটি  বাংলাদেশের গানবাজনা সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখে। এমনকি গান-বাজনার উপর নিয়মিত পত্রিকায় লেখালেখিও করে। রতনে রতন চেনা আইয়ুব বাচ্চু যুবকটির সাথে কয়েক মুহূর্তের আলাপ-আলোচনার পরই বুঝতে পারলেন যুবকটি প্রচন্ড সম্ভাবনাময়। আইয়ুব বাচ্চু যুবকটিকে একটি বড় হল রুম এ নিয়ে যান যেখানে আইয়ুব বাচ্চুর ব্যান্ড  এলআরবি-র সব মেম্বাররা জ্যামিং ও আড্ডা দিচ্ছিলেন। আইয়ুব বাচ্চু হাতে একটি অ্যাক্যুস্টিক গিটার তুলে দিয়ে যুবকটিকে বললেন, ‘গান গা।’  

 

 

 

কাধে গিটার ঝোলানো ঝাকড়া চুলের সেই যুবকটি হলেন কলকাতার মিউজিক সিনের বর্তমান বিখ্যাত রকস্টার  রুপম ইসলাম। রতন আইয়ুব বাচ্চুর রতন রুপম ইসলাম কে চিনতে ভুল হয়নি সেদিন।

 

 

 

৩. সোলস ব্যান্ড এ যোগদানঃ 

তখন আমাদের সবার পরিচিত আইয়ুব বাচ্চু আইয়ুব বাচ্চু হয়ে উঠেন নি। একবার চট্টগ্রামে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে জেকব ডায়াস নামে এক ভদ্রলোকের ব্যান্ডে গিটার  বাজাচ্ছিলেন তিনি। ওই দিনই তাকে প্রথম দেখেন  তৎকালীন  সোলস ব্যান্ড এর সদস্য  নকিব খান এবং তার বাজানো দেখে  খুব পছন্দ হয়ে যায় নকিব খানের। নকিব খান আইয়ুব বাচ্চুকে তার বাসায় আসতে বলেন। তাকে সোলসে নিবেন তখনও জানাননি। ওই সময় সোলস ব্যান্ডের গিটারিস্ট সাজেদ দেশের বাইরে চলে যাওয়াতে একজন গিটারিস্ট এর খুব দরকার ছিল তখন সোলস ব্যান্ড এর। আইয়ুব বাচ্চু ও গিটার খুব ভালো বাজান। সব মিলে তারা তাকে  সোলস ব্যান্ড এ নিয়ে নেন। আর এর পরের গল্প তো সবারই জানা।

 

 আর ও পড়ুনঃ হুমায়ূন আহমেদ আস্তিক না নাস্তিক?

 

৪. দেশকে অপমানিত করায় উপযুক্ত জবাবঃ 

একবার আইয়ুব বাচ্চু যুক্তরাষ্টের নিউইয়র্কের এক গিটার সেন্টারে যান তার ব্যান্ডের সদস্যদের সাথে। আইয়ুব বাচ্চু সেখানকার গিটারগুলো প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে  দেখছিলেন। হঠাৎ একটি আইভানেজ গিটারের ওপর তাঁর চোখ আটকে যায়। কাচের বাক্সে আবদ্ধ ছিল গিটারটি। সেখানকার দায়িত্বে থাকা লোকের সাথে এই গিটারটি কিনার বিষয়ে আলোচনা করতেই লোকটি আইয়ুব বাচ্চুর দিকে কিছুক্ষণ সন্দেহের দৃষ্টিতে  লক্ষ্য করেন। এরপর আইয়ুব বাচ্চুর কাছে জানতে চান যে তারা কোন দেশ থেকে এসেছে। 

 

যখন জানতে পারল আইয়ুব বাচ্চু ও তার ব্যান্ডের সদস্যরা বাংলাদেশ থেকে এসেছে তখন দায়িত্বে থাকা ওই লোকটি এই বলে আইয়ুব বাচ্চুকে অপমান করলো যে এই গিটারটি বাংলাদেশের মতো কোনো দরিদ্র দেশের মানুষের জন্য নয়।  বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের কোন মানুষ এ দামী গিটার এর মূল্য পরিশোধ করার মতো সামর্থ্যই রাখে না এটা ছিল মূলত তার ইঙ্গিত । স্বাভাবিকভাবেই  লোকটির কথায় আইয়ুব বাচ্চু অপমানিত বোধ করলেন । আরো বেশি কষ্ট পেলেন এই ভেবে যে দেশকে অপমান করা হয়েছে। 

 

আইয়ুব বাচ্চু সেই লোকটিকে গিটার টিকে হাতে নিয়ে দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন অনুরোধ করলেন এবং এও বললেন যে তার এবং তার ব্যান্ড মেম্বারদের কাছে যত টাকা আছে সব মিলে সে গিটারটা কিনতে পারবে। অত্যন্ত অনাগ্রহের সাথে সেই দায়িত্বে থাকা লোকটি আইয়ুব বাচ্চুকে ওই গিটারটি হাতে নিয়ে দেখতে দিলেন।

 

জাদুকরের হাতে জাদুর কাঠি। আইয়ুব বাচ্চু গিটারটি  বাজানো শুরু করার পর  মন্ত্রমুগ্ধকর তার বাজানো দেখে আশপাশে লোকজনের ভিড় জমে গেল । গিটার সেন্টারের সেই দায়িত্বে থাকা লোকটিও অবাক। গিটার বাজানো শেষে আইয়ুব বাচ্চু যখন গিটারটি লোকটিকে ফেরত দিতে গেলেন তখন লোকটি বললেন, ‘তুমি দুর্দান্ত ভালো  বাজাও, এই গিটার যেন তোমার জন্যই বানানো হয়েছে! আমি তোমাকে অর্ধেক দামেই দিয়ে দেব গিটারটি।’ আইয়ুব বাচ্চু তখন এমন কথা বললেন যা শুনে প্রত্যেক বাঙালিরই গর্বে বুক ফুলে উঠে যাওয়ার কথা। তিনি বললেন, ‘এটা যদি তুমি আমাকে বিনে পয়সায়ও দাও তবুও আমি নেব না,  আমার দেশকে অপমান করেছ তুমি। দেশ অপমানিত হয় যে গিটারের জন্য, সেই গিটার দ্বিতীয়বার বাজায় না আইয়ুব বাচ্চু ।’

 

 

বাংলাদেশি হিসেবে আমরা গর্ব করতে পারি, আমাদের একজন আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন। গুরু তোমায় অজস্র সালাম।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link