জীবনীজীবন গল্প

সময়ের সেরা ব্যক্তি জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক

প্রাচীন ঋষিদের মতো সমস্ত জীবন যিনি ব্যয় করেছেন জ্ঞান সাধনায় তিনি জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। এদেশে অন্য কোন মানুষ তার মতো এত আলোচিত ছিলেন না ‌, ছায়া দান করেন নি আর কেউ এমনভাবে। তিনি কথা বলতেন খুব সহজ সরল ভাষায়, আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করতেন অবলীলায়। প্রাচুর্য আর সমস্ত প্রলোভন তিনি সব সময় পরিহার করেছেন , পরবর্তী প্রজন্ম কে বুদ্ধিবৃত্তি আর মানস উন্মেষের দীক্ষা দিয়ে গেছেন উদারভাবে।

১৯১৪ সালে বৃটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির নবাবগঞ্জ উপজেলার পাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন আব্দুর রাজ্জাক। মতান্তরে ১৯১২ সালের পহেলা জানুয়ারি ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া  গ্রামে তার জন্ম। মৃত্যু বরন করেন ১৯৯৯ সালের ২৮ নভেম্বর। তিনি অকৃতদার ছিলেন।

                 

তিনি ছিলেন শিক্ষকদের শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনৈতিক অর্থনীতি তে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন প্রথম শ্রেণীতে। তিনি লন্ডন স্কূল অব  ইকনোমিক্স এর অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কীর অধীনে পি এইচ ডি করার জন্য লন্ডনে গিয়েছিলেন। লাস্কী মৃত্যু বরন করায় তিনি থিসিস জমা না দিয়ে ই দেশে ফিরে আসেন। ১৯৩৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান নামে দুটি পৃথক বিভাগ চালু হলে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যোগ দেন।

আজীবন যে মানুষ টি জড়িত ছিলেন শিক্ষার সাথে , জ্ঞান  সাধনার জগতে যিনি একজন কিংবদন্তী তার লিখিত  দলিল বলতে দুটি হারিয়ে যাওয়া অনুবাদ, একটা অসমাপ্ত বই,,, কিছু চিঠি, দুটি বক্তৃতা আর সুপারিশ নামা। কন্যাকুমারী নামে তার একটা উপন্যাসের কথাও জানা যায়।তার স্নেহধন্য ছাত্র আহমদ ছফা তাকে নিয়ে ‘ যদ্যপি আমার গুরু” নামে একটি অসাধারণ বই লিখেছেন।সরদার ফজলুল করিম তার আলাপচারিতার উপর ভিত্তি করে একটি বই লিখেছেন — ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ব বঙ্গীয় সমাজ; অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা।

কিংবদন্তী তুল্য জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক কে গ্রিক দার্শনিক ডায়োজিনিসের সাথে তুলনা করেছিলেন ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক খুশবন্ত শিং। ছাত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন এবং  চাকুরী সুবাদে সেখানেই পেশা জীবনের শুরু ও শেষ করেন।১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেন।

জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে বলা হয় চলমান বিশ্বকোষ। অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান,  সমাজ বিজ্ঞান, ধর্ম, সংস্কৃতি সকল বিষয়ে বিশেষজ্ঞের মতো মতামত  প্রদানের ক্ষমতা রাখতেন তিনি।

অকৃতদার এই মানুষটির সভা সমিতিতে বক্তৃতা দেয়ার অভ্যাস  না থাকলেও জাতির সন্ধিক্ষণে এবং সংকট ময় মুহূর্তে  পথ নির্দেশনা দিয়েছেন সফলভাবে। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন একজন প্রবাদপ্রতিম পুরুষ।

লেখার বিষয়ে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বলতেন —লেখার বিষয়টি অইল পুকুরে ঢিল ছুড়ার মতো।যত বড় ঢিল যত জোরে মারন যাইব পাঠকের মনের তরঙ্গ টি তত জোড়ে উঠব এবং অধিক্ষন থাকব।

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যারের চরিত্রে র এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের দেখা পাওয়া যায় আহমদ ছফার ” যদ্যপি আমার গুরু ”  গ্রন্থে। আহমদ ছফার ভাষায়– “যে সলিমুল্লাহ খান রাজ্জাক স্যার কে বকাঝকা করে আস্ত একটা বই লিখেছিলেন, পরবর্তীতে যখন সলিমুল্লাহ খানের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্জাক স্যার ও ডঃ কামাল হোসেন এর সুপারিশ প্রয়োজন হয়েছিল তখন তিনি প্রশংসা পত্র লিখে দিয়েছিলেন এবং 

ডঃ কামাল হোসেন এর প্রশংসা পত্র সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। এমনকি সলিমুল্লাহ খান যখন আমেরিকা যান তখন প্লেন ভাড়ার একটা অংশ দিয়েছিলেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক।এই ছিলেন রাজ্জাক স্যার।’

বাংলা ভাষার জন্ম সম্পর্কে আব্দুর রাজ্জাক বলতেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পন্ডিতেরা ভাষার স্ট্রাকচার খাড়া করেছিলেন।তার লগে ভাগিরথী পাড়ের ভাষার মিশ্রনে আধুনিক বাংলা ভাষা টা জন্মাইছে। আধুনিক বাংলা ভাষা টা বঙ্গ সন্তানের ঠিক মুখের ভাষা নয়। লেখাপড়া শিইখ্যা লায়েক অইলে তখনই ঐ ভাষাটা তার মুখে আসে।

 

আহমদ ছফা আব্দুর রাজ্জাকের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার  সম্পর্কে বলেছেন — তিনি সব সময়  ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলতেন। ঢাকাইয়া বুলিতে যে একজন সুশিক্ষিত সুরুচি সম্পন্ন ভদ্রলোক মনের গহন ভাব অনুভাব বিভাষ প্রকাশ করতে পারেন এবং সে প্রকাশ টা কতটা মৌলিক গুন সম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে রাজ্জাক সাহেবের মুখের কথা যিনি শোনেননি কোনদিন বুঝতে পারবেন না।

 

শিক্ষা সম্পর্কে আব্দুর রাজ্জাক বলতেন শিক্ষা একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। শুধু তত্ত্ব উপাত্ত দিয়ে শিক্ষার্থীদের মনের ভার বাড়ানো কে শিক্ষা বলা যায় না।শিক্ষার কাজ হচ্ছে এমন প্রক্রিয়া সুচনা করা যার মাধ্যমে প্রত্যেক মানুষের মনের যে চোখ আছে তাকে জ্ঞানের অনিবার্ণ আলোর দিকে ফেরানো।আর মাতৃভাষা ছাড়া কোন জাতি র উন্নতি করা সম্ভব নয়।

 

জ্ঞান তাপস আব্দুর রাজ্জাক একটি নাম, একটি ইতিহাস একটি চলমান বিশ্বকোষ। জ্ঞান চর্চায় তার যুগোপযোগী চিন্তা ভাবনা বিশ্লেষণ,কর্ম পরিকল্পনা, ব্রিটিশ জাতির পোড় খাওয়া শিক্ষা ব্যবস্থা কে খোল নলচে পাল্টে দেওয়া প্রতিটি ধাপে চির অম্লান হয়ে থাকবে।

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যার সম্পর্কে হুমায়ূন আজাদ লিখেছেন– ” এতগুলি বছর জীবন যাপন করে তিনি রয়ে গেছেন চারপাশে উত্তেজিত কলরোলিত জীবনের বাইরে; কম্পিত হননি কামনায়, বাসনা তাকে বিনিদ্র রাখেনি। আমার মুখোমুখি এখন এক কিংবদন্তী।”

আব্দুর রাজ্জাক জ্ঞানের সমুদ্রে ডুবেছিলেন সারাজীবন। যার কাছে জগৎ সংসার ছিল গৌণ।আর জ্ঞান অর্জন ছিল মূখ্য। যিনি ছিলেন শিক্ষকদের শিক্ষক। তিনি ছিলেন রহস্যময়। জীবদ্দশায় যে পরিমাণ জ্ঞান আহরন করেছেন তার সিকিভাগও লিখে রেখে যান নি। কেবলমাত্র তার শিক্ষকতা ও পরবর্তী সময়ে যারা তার সান্নিধ্য লাভ করছেন তারা জানেন আব্দুর রাজ্জাক কতটা মহৎ ব্যাক্তি এবং জ্ঞানী দার্শনিক ছিলেন।

পোশাক আশাকে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের বাঙালিয়ানা প্রকাশ পেতো। তিনি খদ্দেরের পাঞ্জাবি পাজামা আর মাঝে মাঝে একটা চাদর কিংবা লুঙ্গি অথবা কূর্তা তেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।

বিলেত ব্যাতীত কোট টাই পড়তে তার খুব অনীহা ছিল।

জ্ঞানের ভারে ন্যুজ এই ব্যক্তি জ্ঞান বিলাতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।বই পড়াও সংগ্রহের বাইরে তার আরো দুটি নেশা ছিল বাজার করা ও রান্না করা। এমনকি তার অনেক ছাত্রের বউয়ের রান্নার শিক্ষক ছিলেন তিনি। তিনি বলতেন আমি কোন দেশে গেলে দুটি জিনিস দেখি।এক কাঁচা বাজার, দুই বইয়ের দোকান।যে দেশে বেশী বইয়ের দোকান নাই সেই দেশে ভালো পড়ালেখা হয় তা বিশ্বাস করি না।কাঁচা বাজার দেখলে বুঝা যায় দেশের অবস্থা কেমন।

অবসরের বিনোদন হিসেবে দাবা খেলা বেশ পছন্দ করতেন । কাজী মোতাহার হোসেন ছিল তার দাবা খেলার একমাত্র সঙ্গী।দাবার গ্রান্ড মাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ ছিলেন তার স্নেহতুল্য।

 

জাতীয় শিক্ষা কমিশনের খন্ডকালীন সদস্য ছিলেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক।দিল্লী বিশ্ব বিদ্যালয় তাকে ডি লিট প্রদান করে। ১৯৫৯ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তাকে ভিজিটিং ফেলো হিসেবে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।১৯৬৮ সালে অক্সফোর্ড এর আমন্ত্রণে তিনি ব্যালিওন কলেজে যান এবং আঠার ও ঊনিশ শতকের ইন্দো ব্রিটিশ সম্পর্কে র উপর ডকুমেন্টেশন এডিটিং এর কাজ করেন। বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেন ১৯৭৫ সালে।

বিদেশে একদিন বিকেলে বইয়ের  দোকানে একটা বই পছন্দ করে পড়তে শুরু করেন। দোকান বন্ধ করার সময় হলে দোকানী দোকান বন্ধ করে চলে যান। সেই রাত দোকানেই কেটেছিল। লন্ডনে তার অর্থকষ্টের দিনগুলোতে  সারাদিন বিভিন্ন বই ঘাঁটাঘাঁটি করে  সন্ধ্যায় ফিরে  আসতেন  কিছু না খেয়েই। সেই সময় এক দোকানদার তাকে প্রায়ই  খাওয়াতেন বলো জানা যায়।

তিনি কাউকে কখনো তুমি করে বলতেন না। সবাইকে আপনি করে বলতেন।কেউ যদি তার কাছে সাহায্যের জন্য  আসতেন,তখন কাঁদে চাদর ঝুলিয়ে হাঁটা শুরু করতেন। তিনি তার বিরুদ্ধে শ্লোগান  দেওয়া ছাত্রকেও  সহযোগিতা করেছিলেন।

সরদার ফজলুল করিম বলেছিলেন —স্যার শুধু আমাদের স্যার ছিলেন না। তিনি আমাদের দ্বিতীয় পিতা। মিজানুর রহমান শেলী বলেছিলেন— জ্ঞান সমৃদ্ধ চিন্তাশীলতার জীবন্ত রূপায়নে।   মনসুর মুসা  বলেছেন— তিনি গৃহী ছিলেন,গৃহ নির্মাণ করেন নি। তিনি সংসার করেছেন, কিন্তু সংসারী হননি। রাজ্জাক স্যার ছিলেন অসংখ্য রুম বিশিষ্ট এক বিশাল প্রাসাদ। আপাতদৃষ্টিতে সেগুলো বন্ধ। কিন্তু দরজায় তালা নাই। প্রত্যেক টি  জ্ঞানের  ধনদৌলতে পরিপূর্ণ।

তার মৃত্যুর  আগে তার সর্বশেষ সাক্ষাৎকার  নিয়েছিলেন হুমায়ূন আজাদ। তিনি বলেছিলেন আমি যেকোনো মুহূর্তে বিদায়ের জন্য প্রস্তুত।কত বছর বাঁচব জানিনা। জীবন মৃত্যু সম্পর্কে আমি বেশী ভাবি না। আমি অনেক বেঁচেছি। যেকোন মূহুর্তে মরে গেলে দূঃখ নাই। অনেক তো বেঁচেছি।

 

   তথ্যসূত্র:  

                  ১।যদ্যপি আমার গুরু–আহমদ ছফা।

                  ২। আমাদের শিক্ষার নৈতিকতা ও একজন ডায়োজিনিস– জাহিদুর রহিম।

                  ৩। রাজ্জাক আব্দূর — সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

                   ৪। আব্দুর রাজ্জাক স্মারকগ্রন্থ– অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

 

        লেখক:কবি ও প্রাবন্ধিক

এস ডি সুব্রত

পরিদর্শক , জেলা সমবায় কার্যালয় সুনামগঞ্জ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link