যাকাত ফরজ হওয়ার আধুনিক হিসাব
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আপনি তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, এর দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন ও পরিশোধিত করবেন, আপনার দোয়া তাদের জন্য স্বস্তিদায়ক, আল্লাহ সর্বশ্রোত সর্বজ্ঞ।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ১০৩)
আল্লাহ আরো বলেন, ‘তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করো ও জাকাত আদায় করো, তোমরা উত্তম কাজের যা কিছু নিজেদের জন্য আগে পাঠাবে আল্লাহর কাছে তা থাকবে, তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তা দেখেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১১০)
জাকাতের পরিচয় : জাকাত শব্দের আরবি অর্থ হচ্ছে পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি, আধিক্য ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে জাকাত বলতে ধনীদের ধন-মালে আল্লাহর নির্ধারিত অংশকে বোঝায়। জাকাত সম্পদকে পবিত্র করে, বিত্তশালীদের পরিশুদ্ধ করে, দারিদ্র্য মোচন করে, উত্পাদন বৃদ্ধি করে, অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করে এবং সমাজে শান্তি আনে। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয়টি হচ্ছে জাকাত। ইমানের পর নামাজ ও তার পরই জাকাতের স্থান। কোরআন মজিদের ৩২ জায়গায় জাকাতের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে ২৮ জায়গায় নামাজ ও জাকাতের কথা একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
জাকাত প্রদানের শর্ত : জাকাত স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক এমন মুসলিম নর-নারী আদায় করবে, যার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ আছে। তবে এর জন্য শর্ত হলো—এক. সম্পদের ওপর পূর্ণাঙ্গ মালিকানা থাকতে হবে। দুই. সম্পদ উত্পাদনক্ষম ও বর্ধনশীল হতে হবে। তিন. নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে। চার. সারা বছরের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর পর অতিরিক্ত সম্পদ থাকলেই কেবল জাকাত ফরজ হবে। পাঁচ. জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য ঋণমুক্ত হওয়ার পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা শর্ত। ছয়. কারো কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর থাকলেই কেবল সে সম্পদের ওপর জাকাত দিতে হবে।
জাকাতের নিসাব : দেশি-বিদেশি মুদ্রা ও ব্যবসায়িক পণ্যের নিসাব নির্ধারণে সোনা-রুপা হলো পরিমাপক। এ ক্ষেত্রে ফকির-মিসকিনদের জন্য যেটি বেশি লাভজনক হবে, সেটিকে পরিমাপক হিসেবে গ্রহণ করাই শরিয়তের নির্দেশ।
ক. সোনার পরিমাণ হলো : ৭.৫ তোলা=৯৫.৭৪৮ গ্রাম প্রায়। খ. রুপার পরিমাণ হলো : ৫২.৫ তোলা=৬৭০.২৪ গ্রাম প্রায়। (আহসানুল ফতোয়া ৪/৩৯৪, আল ফিকহুল ইসলামী ২/৬৬৯)
সুতরাং মুদ্রা ও পণ্যের বেলায় বর্তমানে রুপার নিসাবই পরিমাপক হিসেবে গণ্য হবে। তাই যার কাছে ৫২.৫ তোলা সমমূল্যের দেশি-বিদেশি মুদ্রা বা ব্যবসায়িক পণ্য মজুদ থাকবে, তার ওপর জাকাত ওয়াজিব হবে। যে সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ, তার ৪০ ভাগের একভাগ (২.৫০%) জাকাত দেওয়া ফরজ। সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে শতকরা আড়াই টাকা বা হাজারে ২৫ টাকা হারে নগদ অর্থ কিংবা ওই পরিমাণ টাকার কাপড়চোপড় বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও জাকাত আদায় হবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৫৭২; সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৬২৩)
যেসব সম্পদে জাকাত ফরজ : সব ধরনের সম্পদে জাকাত ফরজ হয় না। শুধু সোনা-রুপা, টাকাপয়সা, পালিত পশু (নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী) এবং ব্যবসার পণ্যে জাকাত ফরজ হয়।
সোনা-রুপার অলংকার সব সময় বা কালেভদ্রে ব্যবহৃত হোক কিংবা একেবারেই ব্যবহার না করা হোক সর্বাবস্থায় তার জাকাত দিতে হবে। (আবু দাউদ শরিফ : ১/২৫৫; নাসায়ি, হাদিস : ২২৫৮)
অলংকার ছাড়া সোনা-রুপার অন্যান্য সামগ্রীর ওপরও জাকাত ফরজ। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৬১)
মৌলিক প্রয়োজন থেকে উদ্বৃত্ত টাকাপয়সা নিসাব পরিমাণ হলে এবং এক বছর স্থায়ী হলে বছর শেষে তার জাকাত আদায় করা ফরজ। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৯১)
ব্যাংক ব্যালেন্স, ফিক্সড ডিপোজিট, বন্ড, সার্টিফিকেট ইত্যাদিও নগদ টাকাপয়সার মতোই। এসবের ওপরও জাকাত ফরজ।
টাকাপয়সা ব্যবসায় না খাটিয়ে এমনি রেখে দিলেও তাতে জাকাত ফরজ। (আদ্দুররুল মুখতার : ২/২৬৭)
হজের উদ্দেশ্যে কিংবা ঘরবাড়ি নির্মাণ, ছেলেমেয়ের বিয়েশাদি ইত্যাদি প্রয়োজনের জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করা হয়, তাতেও জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ১০৩২৫)
দোকানপাটে যা কিছু বিক্রির উদ্দেশ্যে রাখা থাকে, তা বাণিজ্যিক পণ্য। এর মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত আদায় করা ফরজ। (সুনানে আবু দাউদ : ১/২১৮)
ব্যবসার নিয়তে কোনো কিছু ক্রয় করলে তা স্থাবর সম্পত্তি হোক যেমন—জমিজমা, ফ্ল্যাট কিংবা অস্থাবর সম্পত্তি যেমন—মুদিসামগ্রী, কাপড়চোপড়, অলংকার, নির্মাণসামগ্রী, গাড়ি, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, হার্ডওয়্যার সামগ্রী, বইপুস্তক ইত্যাদি, তা বাণিজ্যিক পণ্য বলে গণ্য হবে এবং মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭১০৩)
যদি সোনা-রুপা, টাকাপয়সা কিংবা বাণিজ্যিক পণ্যের মধ্যে কোনোটি পৃথকভাবে নিসাব পরিমাণ না থাকে, কিন্তু এসবের একাধিক সামগ্রী এ পরিমাণ রয়েছে, যা একত্র করলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমমূল্য বা তার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে সব সম্পদ হিসাব করে জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৮১)
যেসব সম্পদে জাকাত ফরজ নয় : সোনা-রুপা ছাড়া অন্য কোনো ধাতুর অলংকার ইত্যাদির ওপর জাকাত ফরজ নয়। তদ্রূপ হীরা, মণি-মুক্তা ইত্যাদি মূল্যবান পাথর ব্যবসার পণ্য না হলে সেগুলোতেও জাকাত ফরজ নয়। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৬/৪৪৭-৪৪৮)
নিজ ও অধীনস্থ পরিবারপরিজনের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও বাহনের ওপর জাকাত ফরজ নয়। (মুসান্নাফে আবি শায়বা, হাদিস : ১০২০৭)
গৃহের আসবাবপত্র যেমন—খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল, ফ্রিজ, আলমারি ইত্যাদির জাকাত ফরজ নয়। অনুরূপ গার্হস্থ্য সামগ্রী যেমন হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাটি, গ্লাস ইত্যাদির ওপর জাকাত ফরজ নয়। (মুসান্নাফে আবি শায়বা, হাদিস : ১০৫৬০)
পরিধানের বস্ত্র, জুতা যদি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশিও থাকে, তবুও তাতে জাকাত ফরজ হয় না। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৬৫)
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের এমন আসবাবপত্র যা ব্যবসার পণ্য নয়, তার ওপর জাকাত ফরজ নয়।
ঘরবাড়ি বা দোকানপাট তৈরি করে ভাড়া দিলে তাতেও (মূল দামের ওপর) জাকাত ফরজ নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে ভাড়া বাবদ বছরে যে অর্থ পাওয়া যাবে, তা যদি প্রয়োজন অতিরিক্ত হয়ে নিসাব পরিমাণ হয়, তবে সেই ভাড়ার ওপর জাকাত ফরজ।
ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘরবাড়ি বা অন্য কোনো সামগ্রী—যেমন ডেকোরেটরের বড় বড় ডেগ, থালাবাটি ইত্যাদি ক্রয় করলে তার ওপরও জাকাত ফরজ নয়। তবে ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত অর্থের ওপর জাকাত আসবে।