কী এবং কেন?

প্যারাডক্স কি? এবং প্যারাডক্সের মজার খেলা | Paradox

‘Paradox’ প্যারাডক্স শব্দের বাংলা অর্থ হলো “আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী” অর্থাৎ, যে নিজেই নিজের বিরুদ্ধে যায়। যা কোন কিছুর সম্ভাবনা নাকচ করে দেয়। শুনতে আজব হলেও প্যারাডক্স এমনই এক ঘটনা যা মানুষের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে এবং এর সঠিক কোন সমাধান পাওয়া যায়না। এইবার এর ব্যাখ্যায় আসা যাক।

▪️বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেনঃ “I know that I don’t know anything.” অর্থাৎ তিনি জানেন যে তিনি কিছুই জানেন না।

এ আবার কেমন কথা তাইতো? তিনি প্রথমে বলেছেন যে তিনি জানেন। আবার পরে বলেন যে তিনি কিছুই জানেন না। এখন যদি প্রথম কথাটি ঠিক হয় তাহলে দ্বিতীয় কথাটি ভুল অর্থাৎ তিনি জানেন। আবার দ্বিতীয় কথাটি ঠিক হলে প্রথম কথাটি সঠিক নয় মানে তিনি কিছুই জানেন না!

এটিই ‘সক্রেটিসের প্যারাডক্স’।

▪️এবার ধরুন আমি খাতায় পরপর দুটো লাইন লিখলাম। প্রথম লাইনে লিখলাম যে “দ্বিতীয় লাইনটি মিথ্যা।” আবার দ্বিতীয় লাইনে লিখলাম যে “প্রথম লাইনটি সঠিক নয়”। তাহলে সঠিক কে? এটিই প্যারাডক্স।

▪️একজন লোক আপনাকে বললো ” আমি মিথ্যাবাদী”। এখন আপনি তাঁর কথা বিশ্বাস করবেন নাকি না? এটি হলো ‘লায়ার প্যারাডক্স’।

▪️আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। এর নাম ‘BARBER PARADOX’। আমেরিকান গণিতবিদ Bertrand Russell এটা তৈরি করেছেন এবং তাঁর নামানুসারে একে Russell’s Paradox ও বলা হয়।

একটা গ্রামে একজন নাপিত বাস করে।

১. সে তাদের দাঁড়ি কামায় যারা নিজেদের দাঁড়ি নিজেরা কামায় না।

২. যারা নিজেরা নিজেদের দাঁড়ি কামায় তাদের দাঁড়ি সেই নাপিত কামিয়ে দেয় না।

এখন প্রশ হলো নাপিতের দাঁড়ি কে কামায়? সে নিজে না অন্যকেউ?

আচ্ছা তাহলে প্যারাডক্স কি তা নিশ্চয়ই এখন অনুমান করতে পারছেন? চলুন এবার বিজ্ঞান ভিত্তিক কিছু প্যারাডক্স সম্পর্কে জানা যাক।

বর্তমানে বিজ্ঞানের একটি আলোচিত এবং বিতর্কিত বিষয় হচ্ছে ‘টাইম ট্রাভেল’। আর এই টাইম ট্রাভেল বা সময় ভ্রমণ নিয়েও রয়েছে কিছু প্যারাডক্স। যার সাথে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।

 

দাদার প্যারাডক্স (Grandfather Paradox):

যখন অতীত (যেকোন কারণেই হোক) পরিবর্তিত হয়ে যায়, আর এভাবে পরস্পরবিরোধী যে ঘটনার সূত্রপাত হয় তাকে কন্সিস্টেন্সি (মিলে যাওয়া) প্যারাডক্স বলে। একজন সময় পরিভ্রমণকারী যে ঘটনা ঘটেনি তা ঘটাতে পারবেন না, আর যেটি ঘটেছে তা ঘটাতে পারবেন। যা অতীতে ঘটেনি তা ঘটালে পরস্পরবিরোধী ঘটনার জন্ম দিতে পারে। অতীত পরিবর্তন করা সম্ভবপর হলেই কেবল এই প্যারাডক্সটি ঘটানো সম্ভব।

ধরুন আপনি টাইম ট্রাভেল করে অতীতে গেলেন। যখন আপনার বাবার জন্মই হয়নি। তো আপনি আপনার দাদা-দাদীকে কোনভাবে খুন করে ফেললেন। এর ফলে আপনার বাবার জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা । আর আপনার বাবার যদি জন্ম না হয় তাহলে আপনারতো কোন অস্তিত্ব ই থাকবেনা। কিন্তু আপনার অস্তিত্ব তো ভবিষ্যতে রয়েছে। তাহলে কি এখন আপনার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে? যদি তা নাই হয় তাহলে আপনার দাদা-দাদীকে কে খুন করলো? এটিই গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স।

ক্যাজুয়াল লুপ বা রীতিবিবর্জিত/খাপছাড়া চক্র (Bootstrap/ Predestination/ Ontological Paradox):

যখন ভবিষ্যতের কোন ঘটনার দ্বারা অতীত পরিবর্তিত হয়ে যায়; আবার ঐ অতীত ঘটনার পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতের সেই ঘটনাটা স্বভাবতই পরিবর্তিত হয়ে যায় (অর্থাৎ সেই প্রথমে উল্লেখিত ভবিষ্যতটি অন্য ভবিষ্যৎ হয়ে যায়), এই ঘটনাকে ক্যাজুয়াল লুপ বলে। দুটি ঘটয়াই তখন স্থান-সময়ে সহাবস্থান করে কিন্তু তাদের অতীত নির্দিষ্টভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না। ক্যাজুয়াল লুপটি কোন ঘটনা, ব্যক্তি বা বস্তু, বা তথ্যের কারণে ঘটে থাকতে পারে।

ধরুন আপনি টাইম ট্রাভেল করে অতীতে গেলেন বিজ্ঞানী আইন্সটাইনের কাছে যখন তিনি থিওরি অব রিলেটিভিটি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না অর্থাৎ এখনো তাঁর মাথায় সেটি আসেনি। তো আপনি তাঁকে থিওরি অব রিলেটিভিটি সম্পর্কে সবকিছু বোঝালেন এবং বললেন ভবিষ্যতে সে এই তত্ত্ব আবিষ্কার করবে। তারপর আইন্সটাইন আপনার দেওয়া তথ্য থেকে তাঁর থিওরি অব রিলেটিভিটি তত্ত এবং সূত্র প্রকাশ করে আলোড়ন সৃষ্টি করলেন। এবং তা প্রকাশিত হবার পর আপনার অতীত সেই তত্ত পড়লো এবং টাইম ট্রাভেল করে আইন্সটাইন কে দিয়ে আসলো।

তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে থিওরি অব রিলেটিভিটির আবিষ্কারক কে? আপনি তত্ত্ব সম্পর্কে জানতে পারতেন না যদিনা আইন্সটাইন তা প্রকাশ করতো আবার আপনি যদি টাইম ট্রাভেল না করে অতীতে গিয়ে তাঁকে তত্ত্ব না দিয়ে আসতেন তাহলে আইন্সটাইন ও থিওরি অব রিলেটিভিটি সম্পর্কে জানতোনা।

 

ফার্মির প্যারাডক্স:

“সময় পরিভ্রমণ সম্ভবপর হলে সময় পরিভ্রমণকারীরা কোথায় বা এখনো আসেনি কেন?” – সময় পরিভ্রমণ সংক্রান্ত ফার্মির প্যারাডক্সটি এভাবে বলা যেতে পারে।

টাইম ট্রাভেলের এই প্যারাডক্সগুলোর সমাধান দেওয়ার জন্য কিছু থিওরি রয়েছে। সেগুলো হলোঃ

১) নভিকভের আত্মরক্ষার থিওরি (Novikovs self-consistency theory) :

এই থিওরি অনুযায়ী টাইম ট্রাভেল করে অতীতে ফিরে গেলেও কেউ এমন কোনো কাজের সাথে সংযুক্ত হতে পারবে না (মানে জগতের নিয়ম অনুযায়ী জগৎ সেটা হতে দেবে না) যেটা তার প্রকৃত বর্তমানকে প্রভাবিত করবে। অর্থাৎ কেউ অতীতে গিয়ে তাঁর দাদ-দাদীকে হত্যা করে নিজের অস্তিত্ব বলীন করতে পারবেনা। হয়তোবা সে গিয়ে দেখবে সেখানে কোন বসতি নেই। প্রকৃতি বা জগৎ ই তাঁকে কোন না কোনভাবে তাঁদের সম্মুখীন করবেনা।

ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি এর সেথ লয়েড ও তার গবেষক দল নভিকভের থিওরির একটু বিস্তৃত বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, “প্যারাডক্স থেকে রক্ষা পেতে “সম্ভাবনা” সবসময়ই প্রয়োজন অনুযায়ী বেঁকে (পরিবর্তন) যাবে।

২) প্যারালাল ইউনিভার্স থিওরি (Parralel Universe Theory):

এই তত্ত্ব অনুযায়ী কেউ যদি টাইম ট্রাভেল করে, সে কখনই তার নিজের টাইমলাইনের ইউনিভার্সের অতীতে যেতে পারবে না। টাইম ট্রাভেল করে শুধু মাত্র প্যারালাল ইউনিভার্সে গমন সম্ভব। যদি কেউ অতীতে গিয়ে তাঁর দাদাকে হত্যা করে, সে আসলে তার ইউনিভার্সের প্যারালাল ইউনিভার্সে যাবে; যেখানে তাঁর কোন অস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ, টাইম ট্রাভেলার যে টাইম লাইন থেকে এসেছে সেখানে তার বর্তমান অপরিবর্তিতই থাকবে। কারণ সে ট্রাভেল করছে অন্য আরেক ইউনিভার্সের টাইমলাইনে যেখানে তার অস্তিত্ব কখনই ছিলো না। ফলে তার দাদাকে হত্যা করায় আরেকটা সম্ভাবনার ইউনিভার্সে সে চলে যাচ্ছে।

এই থিওরির সাথে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের আরেকটি বিষয় জড়িত। প্রতিটি সম্ভাবনার সাথে এক একটি ইউনিভার্সের থিওরি। ব্যাপারটা এইরকম যে আপনি আপনার এই জগত বা ইউনিভার্সে হয়তো একজন বিজ্ঞানী। কিন্তু হয়তো এমন একটি প্যারালাল ইউনিভার্স আছে যেখানে আপনি একজন গায়ক। আর অন্য ইউনিভার্সে হয়তো আপনি কর্মক্ষেত্রে যাবার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছেন। একটি গাছের যেমন অনেক শাখা-প্রশাখা রয়েছে তেমনি প্রতিটি সম্ভাবনার জন্য আলাদা ইউনিভার্স রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link