যুগে যুগে ভন্ড নবী
মোসায়লামাতুল কাজ্জাব ইসলামের ইতিহাসে সর্ব প্রথম ভুয়া নবুওয়াতের দাবি করেছিল । খোদ রাসূলুল্লাহ্ (স.)-এর জবানী সে ‘কাজ্জাব’ অর্থাৎ- মহামিথ্যাবাদী নামে আখ্যায়িত হয়। ‘হাদীকাতুল মওত’- মৃত্যুর বাগান নামক যুদ্ধে (ইয়ামামা) মোসায়লামা মুসলিম বাহিনীর হাতে নিহত হয়। সিদ্দিকী খেলাফত আমলে তার দেখাদেখি মহিলাসহ আরো বিভিন্ন জন মিথ্যা নবুওয়াতের দাবি করে মোরতাদ হয়ে গিয়েছিল এবং প্রথম খলিফা তাদের কঠোর হস্তে দমন করেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে নানাস্থানে ভুয়া নবুওয়াতের দাবিদার কম ছিল না, কিন্তু তাদের করুণ পরিণতিও ইতিহাসে জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে রয়েছে। এসব ভুয়া নবীর কেউ ইসলামের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারেনি বরং নিজেরাই ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু এসব ভন্ড নবীর কেউ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী ছিল বলে জানা যায় না এবং দ্বীন ইসলামকে বাতিল ঘোষণা করেছিল বলেও জানা যায় না।
মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদারদের ন্যায় যুগে যুগে এমন কিছু বিকৃতমস্তিষ্ক লোকেরও সন্ধান পাওয়া যায়, যারা খোদ ‘খোদা’ বলে দাবি করে ইতিহাস কলংকিত করেছে এবং ধ্বংসও হয়েছে। বিভিন্ন সময় এরূপ নানা ফের্কা বা সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল, যাদের বিশদ বিবরণ ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে বিদ্যমান। উদাহরণ স্বরূপ এখানে আব্বাসীয় খলিফা মনসুরের আমলে মাথা উঠানো একটি সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। খোরাসানের কিছু লোকের আকীদা-বিশ্বাস ছিল যে, বাগদাদের খলিফা আবু জাফর মনসুরের আকার-অবয়বে খোদার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এ অন্ধ বিশ্বাসীদের এক বিরাট দল একদিন মনসুরের প্রাসাদের নিকট সমবেত হয় এবং তাওয়াফ অর্থাৎ- পরিভ্রমণের পর কাঁদতে থাকে, বলতে থাকে, এটি আমাদের মাবুদের প্রাসাদ। ভক্তদের এ বাক্য শ্রবণ করার পর খলিফা মনসুর উক্ত সম্প্রদায়ের দশজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে বন্দি করেন। এতে তারা দারুণভাবে উত্তেজিত ও বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। অবস্থা এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে, শাহী লস্কর যদি সে সময় ঘটনাস্থলে না পৌঁছাত, তাহলে হয়তো এ অন্ধ বিশ্বাসীদের দল মনসুরকে হত্যা করে ফেলতো। তাই হিজরী ১৪১ সালে রাজকীয় বাহিনী এ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে দেয়।
ঐতিহাসিক খোরাসানে আরেক ভন্ড খোদা আত্মপ্রকাশ করে খলিফা মোহাম্মদ মাহদীর (১৫৮-১৫৯ হি.) আমলে। এ প্রতারক ‘মোকান্না’ নামে খ্যাত। সে তার প্রতারণা ও কলাকৌশলকে নিজের খোদায়ী বলে আখ্যায়িত করতো। বহু লোক প্রতারণার শিকার হয়ে তার অনুসারী হয়ে যায়। খলিফা মাহদী এ খবর পান এবং তাকে দমন করার লক্ষ্যে একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু প্রতারক মোকান্না মোকাবিলায় অবতীর্ণ হবার পরিবর্তে তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে তকসার দুর্গে আত্মগোপন করে। এমতাবস্থায়ও সে যখন তার প্রাণ রক্ষার কোনো উপায় দেখলো না তখন তার নির্মিত এসিড কূপে নিজেকে নিক্ষেপ করে জ্বলেপুড়ে মরে।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী মিসরের এক খলিফা নিজেকে খোদা বলে দাবি করেছিলেন যিনি শেষ জীবনে নিখোঁজ হয়ে যান, তাঁকে কেউ কেউ পাগল খলিফা নামে অভিহিত করেছেন। এ খলিফার নাম আবু হাসান আলী, তার উপাধি আল-হাকেম বি আমরিল্লাহ্। তার আসল নাম মনসুর এবং তিনি ছিলেন খলিফা আল আজীজের পুত্র। পিতার মৃত্যুর পর মাত্র এগারো বছর বয়সে আল হাকেম বি আমরিল্লাহ্ উপাধিতে তাকে ক্ষমতাসীন করা হয়। কম বয়সের কারণে দুই ব্যক্তি তার সাহায্যকারী হয়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ লাভ করতে থাকে। মনসুর প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর খেলাফতের সমুদয় ক্ষমতা স্বহস্তে গ্রহণ করেন। তার খেলাফতকাল হিজরী ৩৮৬-৪১১ সাল মোতাবেক ৯৯৬-১০২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তার দীর্ঘ খেলাফত আমলে তিনি বহু কল্যাণমূলক কাজ করেছেন। তেমনি বহুমন্দ কাজও করেছেন। তিনি ফরমান জারি করেছেন, প্রত্যাহারও করেছেন, ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে তার বিবরণও রয়েছে।
হাকেম বি আমরিল্লাহ্র ধর্মীয় নির্দেশাবলী তথা সংস্কারগুলোর মধ্যে অদ্ভুত বৈচিত্র্য ও পরস্পরবিরোধী রূপ যেমন রয়েছে, তার মতবাদেও লক্ষ করা যায় নানা আজগুবি কান্ড। এখানে আমরা তার খেলাফতের শেষ দিনগুলোতে তার খোদায়ী দাবির উম্মাদনার বিষয়টি উল্লেখ করতে চাই। কেননা রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থেকে প্রাচীন কালের ফেরাউনের পর মিসরে হাকেম বি আমরিল্লাহ্র নাম ইতিহাসে বর্ণিত হয়ে থাকে, যিনি নিজেকে খোদা বলে দাবি করেছিলেন। তাঁর এ ঘটনার বিবরণ ইতিহাসবিদদের বর্ণনা অনুযায়ী এইরূপ:
আল-হাকেমের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে, খোদা তার দেহে প্রবিষ্ট হয়ে আছে। তাই তিনি স্বীয় ভক্ত-অনুসারীদের নির্দেশ দেন তার পূজা-অর্চনা করার। তার গায়েব জানারও দাবি ছিল। তার খোশামোদকারী ভক্তরা তাদের জীবন মরণকেও তার সাথে সম্পৃক্ত করে রেখেছিল। হাকেমের সোওয়ারী যখন বের হতো, তখন ভক্তরা বলতো, ইয়অ ওয়াহেদু, ইয়া আহাদু অর্থাৎ- হে একক, এক। এরূপ শ্লোগান হাকেম শুনে আনন্দিত হতেন, কিন্তু বাধা দিতেন না।
হাকেমের লুহিয়াত বা খোদায়িত্বের দাবির ব্যাপারে সর্বসম্মত মত নেই, তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, হাকেম এ দাবি করেননি বরং তার কতিপয় দা’ঈ বা প্রচারকের পক্ষ হতে প্রচার করা হয় যে, তারা মনে করে হাকেম খলিফাতুল্লাহ বা আল্লাহর খলিফার স্থলে স্বয়ং (আল্লাহ্) খোদা। হাসান আল আখরাম নামক এক ইরানী বংশোদ্ভুত ইসমাঈলী প্রচারক ৪০৯ হিজরী সালে মিসরে আসে এবং প্রচার শুরু করে যে, হাকেম স্ব-শরীরে খোদা এজন্য হাকেম এ ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করেন। পরে জনৈক তুর্কীর মারপিট সহ্য করতে না পেরে হাসান আল আখরাম মৃত্যু মুখে পতিত হয়।
দ্বিতীয় এক প্রচারক হামজা আহমদ হাদী জুজনী হিজরী ৪১০ সালে মিসরে আগমন করে, সেও পূর্বোক্ত ব্যক্তির মতবাদ প্রচার করে এবং হাকেমকে খোদা বলে বিশ্বাস করে তার পূজা করতে উৎসাহিত করতে থাকে। এক তৃতীয় ব্যক্তি অনওশতিকিন হিজরী ৪১১ সালে বোখারী হতে মিসরে পদার্পণ করে, সেও জুজনীর আকায়েদ তথা বিশ্বাস অনুযায়ী চলার জন্য লোকদেরকে বলে। এভাবে তার অনুসারীদের এক বিরাট দল হয়ে যায়।
এ নিয়ে মিসরবাসীদের মধ্যে প্রায় ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকে। বোখারা হতে আগত প্রচারক দরুজী নামে পরিচিত। জুজনী ও দরুজী এ উভয় প্রচারকের অনুসারীদের পক্ষে হাকেমের সমর্থন ছিল। মিসরের বহুলোককে শুধু এই কারণে শাস্তি প্রদান করা হয় যে, তারা ঐ প্রচারকদের পথে বাধা সৃষ্টি করেছিল। তুর্কী সৈন্যরা জুজনী ও দরুজী প্রচারকদের কার্যকলাপে অসন্তুষ্ট ছিল এবং তাদের হত্যা করতো, কিন্তু তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তারা পালিয়ে সিরিয়ার লেবানন পর্বতে আশ্রয় গ্রহণ করে। সেখানকার গোত্রগুলো তাদের আকীদা বিশ্বাস বা মতবাদ গ্রহণ করে। ফলে দরুজিয়া সম্প্রদায় নিয়মিতভাবে গঠিত হয়ে যায় এবং এর অনুসারীরা পরবর্তী কালেও বিদ্যমান ছিল বলে জানা যায়। মোট কথা, হাকেমের খোদায়িত্বের দাবি কিংবা তাকে খোদা হিসেবে বিশ্বাসী অনুসারীদের ভ্রান্ত মতবাদ সেকালের এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা বলে দাবি করা যায় না।
আল্লামা সূয়ুতীর উক্তি অনুযায়ী আল হাকেম ছিলেন অত্যন্ত নিকৃষ্ট খলিফা। ফেরাউনের পর মিসর তার চেয়ে মন্দ খলিফা আর লাভ করেনি। ফেরাউন যেভাবে ওলুহিয়াতের দাবি করেছিল, অনুরূপ দাবি ছিল তারও। অর্থাৎ- খোদায়ী দাবিতে মিসরের ফেরাউন ও আল হাকেম সমানে সমান।
আরবের পর আজম বা অনারব দেশগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে ভারতবর্ষের নানা স্থানে এ যাবত বিক্ষিপ্তভাবে মিথ্যা নবুওয়াত ভন্ড খোদার দাবিদারদের সংখ্যা কম নয়, যাদের মধ্যে মির্জা কাদিয়ানীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে এই উপমহাদেশে মিথ্যা নবুওয়াত ও ভন্ড খোদায়িত্বের দাবি নিয়ে যিনি নিজেকে উপস্থাপন করেন তার নাম মোগল স¤্রাট জালাল উদ্দিন আকবর। অনেকে মানতে না চাইলেও ঐতিহাসিক তথ্য হচ্ছে, স¤্রাট আকবরকে প্রথমে নবী এবং পরে খোদা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যার নেপথ্যে ছিলেন প্রধানত আকবরী নবরতের আবুল ফজল ফয়জী ভ্রাতৃদ্বয়। এজন্য সম্রাট আকবর যতটুকু দায়ী, তার চেয়ে বহুগুণে দায়ী উল্লেখিত নবরতœদ্বয়।
সম্রাট আকবর তার প্রবর্তিত দ্বীনে এলাহীর প্রণয়ন কাজ কখন থেকে, কীভাবে শুরু করেছিলেন সে বৃত্তান্ত মোল্লা আবদুল কাদের বদায়ূনীর রচনায় বিদ্যমান ‘তারিখে আলফী’ তার উজ্জ্বল স্বাক্ষর বলা হয়ে থাকে। ইসলামের ইতিহাসে জালাল উদ্দিন আকবর প্রথম সম্রাট যিনি নবুওয়াতের দাবি করে ক্ষান্ত হননি, পর পর ভুয়া ওলুহিয়াত দাবি করে দ্বীন ইসলামের পরিবর্তে এক নতুন ধর্ম দ্বীনে এলাহী প্রবর্তন এবং চান্দ্র হিজরী সনেও হস্তক্ষেপ করেন। তার নামের সঙ্গে ব্যবহার হতে থাকে ‘আল্লাহু আকবার জাল্লা জালালুহু’। তার তথাকথিত দ্বীনে এলাহীর প্রচার শুরু হয়েছিল হিজরী ৯৮৮ সালের ১ জমাদিউল আওয়ালে। নানাস্থানে এর কুপ্রভাব প্রতিফলিত হয় যদিও আকবরের দ্বীনে এলাহী দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।