সলিমুল্লাহ খান বাঙালীর গর্ব
বহুমাত্রিক চিন্তাবিদ সলিমুল্লাহ খানের জন্মদিন ১৮ আগস্ট। তাঁর জন্মদিবসে জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। সৃজনশীল ও মননশীল জ্ঞানচর্চা জগতে সলিমুল্লাহ খান একটি পরিচিত নাম। সলিমুল্লাহ খান একজন বিরল জ্ঞানসাধক ও প্রতিভাবান লেখক। মহামতি সলিমুল্লাহ খানের জন্ম কক্সবাজার জেলায়। তিনি কক্সবাজার জেলার মহেশখালি উপজেলার ছোট মহেশখালি ইউনিয়নের সিপাহীর পাড়া গ্রামে ১৯৫৮ সালে ১৮ আগস্ট জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কলিম উল্লাহ খান ও মাতার নাম মোস্তফা বেগম খান।সলিমুল্লাহ খানের পিতা -মাতা ছিলেন সুশিক্ষিত, জ্ঞান সাধনা ও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী। জ্ঞানবিজ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে সলিমুল্লাহ খানের পরিবারের স্থান বাংলাদেশের প্রথম সারিতে। তাঁর পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। তিনি সিপাহীর পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা করেন। পরে তিনি মহেশখালি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট উচ্চ বিদ্যালয় হতে১৯৭৩ সালে এস. এস. সি পাশ করেন।
১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত মাধ্যমিক স্কুল সাটিফিকেট পরীক্ষায় সলিমুল্লাহ খান কুমিল্লা বোর্ড হতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। তিনি চট্টগ্রাম কলেজ হতে ১৯৭৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করেন। ১৯৭৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বোর্ড হতে মানবিক বিভাগে সলিমুল্লাহ খান প্রথম স্থান অধিকার করেন। এস.এস.সি ও এইচ. এস. সি দুটো তে তিনি কুমিল্লা বোর্ড হতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। এরকম অসাধারণ ও কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল করার জন্য তখনকার বড় মহেশখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী জনাব আনোয়ার পাশা চৌধুরী ১৯৭৬ সালে একটি সংবর্ধনার আয়োজন করেন। এ সংবর্ধনা মহেশখালি উপজেলার সর্বসাধারণের উদ্যোগে বড় মহেশখালি নতুন বাজার মাঠে জনসাধারণের সম্মেলনে মেধাবী ও কৃতিত্বপূর্ণ ছাত্র সলিমুল্লাহ খানকে সংবর্ধনা স্মারকস্বরূপ একটি খাঁটি সোনার পদক উপহার দিয়েছিলেন। পদকের উপর উৎকীর্ণ দুটি শব্দ লিখা আছে, ‘প্রতিভার স্বীকৃতি’। এই প্রতিভার স্বীকৃতি সংবর্ধনা মহেশখালির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। মহেশখালি উপজেলার জনগণ এখনো ১৯৭৬ সালের সেই অসাধারণ প্রতিভাবান ও মেধাবী সলিমুল্লাহ খানের কথা অন্যরকমভাবে স্মরণ করে।
সলিমুল্লাহ খান ছাত্র থাকাকালীন অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী ও সৎসাহসী ছিলেন। তাঁর চট্টগ্রাম কলেজ অধ্যায়নকালীন একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। লেখক ও অনুবাদক আলম খোরশেদ লিখেছেন, “একদিন শোনা গেল, চট্টগ্রাম কলেজের পড়ুয়া, মহেশখালির কোন এক গ্রামের ছেলে নাকি আসন্ন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্ভব্য বোর্ডসেরা শিক্ষাথীর্টিকে চ্যালেঞ্জ করে বসেছে। এই নিয়ে হাসাহাসি হলো শিক্ষক ও ছাত্র মহলে। কিন্তু ফল বেরোনোর পর সত্যি সত্যি দেখা গেল সেই ছেলেটা বিপুল নম্বর পেয়ে আমাদের কলেজের সেরা ছাত্রটিকে ডিঙিয়ে মানবিক প্রথম হয়েছে। প্রবল আত্মবিশ্বাসী, দুর্দান্ত মেধাবী সেই মানুষটিই হলেন আজকের সলিমুল্লাহ খান।”
উচ্চ শিক্ষার জন্য সলিমুল্লাহ খান ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। সলিমুল্লাহ খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ হতে ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে কৃতিত্বের সাথে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
তিনি কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৮৩ সালে। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক হিশেবে যোগদান করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি দিন শিক্ষকতা করেননি। পরবর্তীকালে তিনি ১৯৮৪ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। তিনি ১৯৮৬ সালের ২২ জুলাই উচ্চ শিক্ষার জন্য বৃত্তি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের দ্য নিউ স্কুল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দীর্ঘকাল গবেষণা ও অধ্যয়ন করেন। তাঁর পিএইচডির বিষয় ছিল ‘থিয়োরিস অব সেন্ট্রাল ব্যাংকিং ইন ইংল্যান্ড ১৭৯৩-১৮৭৭’। তিনি এ বিষয়ের উপর পিএইচডি থিসিস ডিফেন্ড করেন ২০০০ সালের ২৪ এপ্রিল। উক্ত অভিসন্দর্ভের জন্য তাঁকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করা হয়। তিনি আমেরিকায় অধ্যয়নকালে লাইব্রেরি, সেমিনার ও পুরানো বইয়ের দোকানে সময় কাটাতেন। তিনি কি পরিমাণ বই পড়েছেন বা পড়েন তা বর্ণনাতীত। উল্লেখ্য যে, তিনি অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন আইনশাস্ত্রের উপর। কিন্তু পিএইচডি করেছেন অর্থনীতির উপর।
সলিমুল্লাহ খান দেশে ফিরে ২০০১ সালের জানুয়ারিতে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। কিন্তু এ বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন চাকরি করার সুযোগ হলো না তাঁর। পরে ২০০২ সালে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব অরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের অর্থনীতি বিভাগের ভিজিটিং ফেলো হিশেবে যোগদান করেন। ২০০৩ সালে ঢাকাস্থ ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভে অর্থনীতির অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। তখন আইন পেশায়ও যোগ দেন তিনি। ২০০৫ সালে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের আইন বিভাগের অধ্যাপক পদে যোগদান করেন সলিমুল্লাহ খান। তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ সাত বছর শিক্ষকতা করেন। ২০১২ সালে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষা বিভাগে যোগদান করেন সলিমুল্লাহ খান। তিনি ২০১৬ সাল হতে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড থিয়োরির পরিচালক হিশেবে নিয়োজিত আছেন। এছাড়াও তিনি আহমদ ছফা রাষ্ট্রসভা, ইতিহাস কারখানা, জাক লাকাঁ বিদ্যালয় ও এশিয়া শিল্প সংস্কৃতি কেন্দ্রসহ নানান সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত।
১৯৭৬ সালে মহাত্মা আহমদ ছফা’র মাধ্যমে জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাথে পরিচয় হয় সলিমুল্লাহ খানের। তাঁর লেখার একটি বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছেন মহাত্মা আহমদ ছফার কথা। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাহচর্য তাকে অনেক দূর এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে। এই দুজন মহামনীষীর কথা সলিমুল্লাহ খান তাঁর লেখায় বণর্না করেছেন। বিশেষ করে সলিমুল্লাহ খানের মেধা ও প্রতিভা কী রকম তা চিনতে পেরেছেন জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। সলিমুল্লাহ খান লেখালেখি শুরু করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হবার আগে থেকেই। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি তো গদ্য লেখা শুরু করেছি ১৯৭৬ সালেই। ১৯৭৬ সালের আগে আমি কখনও গদ্য প্রকাশ করিনি। পদ্য প্রকাশ করেছি ১৯৭২ সাল থেকে।”
সলিমুল্লাহ খান বাংলায় লিখতে পছন্দ করেন। তিনি চলিত ভাষায় কথা বলেন, লেখালেখি করেন সাধু ভাষায়। তিনি বিভিন্ন দেশের ভাষা জানেন। তাঁর লেখার ধরন অন্যদের চেয়ে একেবারেই আলাদা। সলিমুল্লাহ খান বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, মহাত্মা আহমদ ছফা, অধ্যাপক মমতাজুর রহমান তরফদার, কমরেড মুজফফর আহমদ, তারেক মাসুদ, ফিদেল কাস্ত্রো, ফরাসি মনস্তত্ত্ববিদ ও চিকিৎসক জাক লাকাঁ, কার্ল মার্কস, আন্তোনিয় গ্রামসি, তালাল আসাদ, শার্ল বোদলেয়ার, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, মিশেল ফুকো, ফ্রানৎস ফানোঁ, লেভি স্ত্রস, এডওয়ার্ড সাঈদ, দেরিদা, প্লাতোন, জেমস রেনেল, ম্যাকিয়াভেলিসহ নানা বিখ্যাত মানুষের উপর লেখালেখি করেছেন। ডরোথি জুল্লে ও পেন্টিসারকস্কির কবিতা অনুবাদ করেছেন। যে কোন বিষয়ে তিনি পড়তে ভালোবাসেন। তাঁর বিভিন্ন সেমিনার, আলোচনা, টেলিভিশনে টকশো ও তর্ক-বিতর্কে নানান বিষয়ে জ্ঞানের পরিধির বিশালতার ব্যাপ্তি দেখা যায়।
সলিমুল্লাহ খানের উল্লেখযোগ্য বইসমূহ হলো: ১. এক আকাশের স্বপ্ন (১৯৮১) ২.বাংলাদেশ: জাতীয় অবস্থার চালচিত্র (১৯৮৩) ৩.সত্য সাদ্দাম ও স্রাজেরদৌলা(২০০৭) ৪. আমি তুমি সে (২০০৮) ৫. Silence on crimes of power (2009) ৬. আদম বোমা (২০০৯) ৭. আহমদ ছফা সঞ্জীবনী (২০১০) ৮. স্বাধীনতা ব্যবসায় (২০১১) ৯. প্রার্থনা।
অনূদিত: ১. আল্লাহর বাদশাহি : ডরোথি জুল্লের নির্বাচিত কবিতা (১৯৯৮) ২. সক্রাতেসের তিন বাগড়া (২০০৫) ৩. পেন্টিসারিকস্কি : উহারা বাতাসে (২০২১)।
পুরস্কার : ১. ঢাকা থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন ‘লোক ‘ প্রবর্তিত ‘লোক সাহিত্য পুরস্কার ২০১৭’ প্রাপ্তি।
২. নারায়ণগঞ্জের শ্রুতি সাংস্কৃতিক একাডেমি প্রবর্তিত ‘রনজিত পুরস্কার -২০২০’ প্রাপ্তি।
সিনেট সদস্য: ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বর হতে তিন বছরের জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য হিসেবে ছিলেন।
বহুমাত্রিক চিন্তাবিদ অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান একজন বরেণ্য শিক্ষক। তিনি একজন জ্ঞানশীল দূরদর্শী চিন্তাবিদ ও একজন পরিশ্রমী গবেষক। তিনি সত্য কথা বলতে কখনো পিছপা হননি। তিনি একজন সমাজচিন্তক, বিশ্লেষক এবং সাহিত্যের সমালোচক। লেখক ও গবেষক আমিনুল ইসলাম ভূইয়া সলিমুল্লাহ খান সম্পর্কে লিখেছেন, “আমার ধারণা, সলিমুল্লাহ খান বাংলাদেশের জীবিত বিদ্বজ্জনদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান, সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ও সবচেয়ে সাহসী একজন বুদ্ধিজীবী”।
সলিমুল্লাহ খান সর্বদা নিজেকে পড়াশোনা ও লেখালেখির কাজে ব্যস্ত রাখেন। দেশ-বিদেশে বিভিন্ন বিষয়ে সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। এখন তিনি করোনাকালে বিভিন্ন অনলাইন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও আলোচনা করছেন। তিনি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে চালু করার জন্য জোর দাবি করে যাচ্ছেন। অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমি সার্বক্ষণিক লেখক হতে চাই। আমি বুঝতে পেরেছি লেখা ছাড়া আমার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব নয়।” তিনি ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি, সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে লিখে আসছেন। তিনি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তি ও অসাধারণ মেধাবী একজন লেখক। তিনি কথায়, লেখায় ও বক্তৃতায় মুগ্ধ করতে পারেন শ্রোতা ও পাঠকদের। জ্ঞান জগতে আলোকিত শিক্ষাবিদ সলিমুল্লাহ খানকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা।