ইফতারের পর মাগরিব নামাজের সময়সীমা
মাগরিবের নামাজে অনেক সময় তাড়াহুড়ো হয়ে যায়। দেখা যায় কোনো কাজ শেষ করে পড়ছি কিংবা পড়া শুরু করছি— করতে করতে দেরি হয়ে পড়ে। তখন কেউ কেউ বলেন যে, মাগরিবের নামাজ অল্প সময় থাকে। তাই এখন আর ওয়াক্ত নেই। তাই জেনে রাখা জরুরি যে, মাগরিবের নামাজের সময় কতক্ষণ থাকে?
এই প্রশ্নে উত্তর হলো- মাগরিবের নামাজের সময় সময় কিছুটা কম থাকে। তবে তা এশার সময় শুরুর পূর্ব পর্যন্ত। তাই মাগরিবের নামাজ ওয়াক্ত থাকতে যত তাড়াতাড়ি পড়া নেওয়া যায় উত্তম। অর্থাৎ সূর্য ডুবে যাওয়ার সাথে সাথে মাগরিবের নামাজের ওয়াক্ত শুরু হয়। তাই তখনই যত তাড়াতাড়ি পড়া সম্ভব হয়— নামাজ আদায় করে নেবে। এতে যত তাড়াতাড়ি পড়তে পারবেন, ততই আপনি সওয়াব বেশি পাবেন।
যদি কোনো একান্ত প্রয়োজনে বিলম্ব করতে হয়— তাহলে আপনি যে জায়গায় আছেন, সেখানে এশার নামাজের সময় ও ওয়াক্ত কখন শুরু হয়; তা দেখে নেবেন। আপনারা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের স্থায়ী ক্যালেন্ডারে যে নামাজের সময়সূচি দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকেও দেখে নিতে পারেন। অতএব, এশার ওয়াক্ত শুরু হওয়ার হওয়ার পর্যন্ত আপনি এশার নামাজ পড়তে পারবেন।
সূত্র : (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৫১; জীবন জিজ্ঞাসা, শায়খ মাহমুদুল হাসান আল-আজহারি, নামাজ অধ্যায়; পৃষ্ঠা : ১৮৩)
মাগরিবের ওয়াক্ত শুরু হয় সূর্যাস্তের পর থেকে। এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই। এতেও কারও দ্বিমত নেই যে, মাগরিবের ওয়াক্ত বহাল থাকে শাফাক অদৃশ্য হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। শাফাক অদৃশ্য হয়ে গেলে মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যায় এবং এশার ওয়াক্ত শুরু হয়। আর এই সবই সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তবে শাফাক কাকে বলে তা নিয়ে দ্বিমত আছে। কেউ বলেন, শাফাক অর্থ সূর্যের লালিমা। কেউ বলেন, শাফাক অর্থ সাদা রেখা; যে রেখাটি সূর্যের লালিমা অন্তর্হিত হওয়ার পর আকাশের প্রান্তে দেখা যায়। এই সাদা রেখা অন্তর্হিত হওয়ার পর আকাশের প্রান্ত কালো হয়ে যায় এবং দৃষ্টি থেকে তখন আকাশের প্রান্ত আর দৃশ্যযোগ্য থাকে না। আকাশের প্রান্ত তখন দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়।
এবার দেখুন, লেখক কী বলেছেন। লেখক বলেছেন, মাগরিবের ছালাতের ওয়াক্ত সম্পর্কেও কিছু যঈফ ও জাল হাদীস বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর এই দাবীর পক্ষে উদাহরণ পেশ করতে গিয়ে তিনি চারটি হাদীস এনেছেন এবং হাদীস চারটি সম্পর্কে তিনি ‘তাহক্বীক্ব’ শিরোনামে হাদীসের মান নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমি আপনার সুবিধার্থে লেখকের লেখাগুলো হুবহু তুলে ধরছি। উদাহরণ পেশ করতে গিয়ে লেখক লিখেছেন, যেমন-
(1) أوَّلُ وَقْتِ الْمَغْرِبِ حِيْنَ تَغْرِبُ الشَّمسُ وَآخِرُهُ حِيْنَ يَغِيْبُ الشَّفَقُ
(1) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, মাগরিবের প্রথম ওয়াক্ত হ’ল যখন সূর্য ডুবে যায়। আর শেষ সময় যখন শাফাকব ডুবে যায়।
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, ‘আমি এরূপ বর্ণনা পাইনি।’ আল্লামা যায়লাঈ বলেন, ‘এটি গরীব। অর্থাৎ ভিত্তিহীন।
(2) رُوِيَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلًّمَ أَنَّهُ قَالَ آخِرُ وَقْتِ الْمَغْرِبِ إِذَا أَسُوْدَ الْاَفَقِ
(2) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করা হয়েছে যে, মাগরিবের শেষ সময় হল, যখন কালো রেখা দেখা যাবে।
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, ‘আমি এরূপ বর্ণনা পাইনি।
(3) عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَال قٌالَ رَسُوْلُ الله صَلًّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَلشَّفَقُ اَلْحُمْرَةُ فَإِذَا غَابَتِ الشَّفَقُ وَجَبَتِ الصَّلَاةُ
(৩) ইবনু ওমর রাঃ বলেন, শাফাক্ব হল, লালিমা। যখন লালিমা দূরীভূত হবে তখন ছালাত ওয়াজিব হবে।
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি যঈফ। এর সনদে আতীক্ব ইবনু ইয়াকুব নামে ত্রুটিপূর্ণ রাবী আছে। তাছাড়া উক্ত বর্ণনা এশার ছালাতের জন্য প্রযোজ্য, মাগরিবের জন্য নয়।
মূলতঃ লালিমা দূর হওয়ার পর মাগরিবের ওয়াক্ত থাকে না। কিন্তু উক্ত বর্ণনাগুলোতে দাবী করা হয়েছে।
(4) عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلًّمَ الشّفَقُ الْحُمْرَةُ
(৪) ইবনু ওমর থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, শাফাক্ব হল লালিমা।
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি যইফ।
পর্যালোচনা : প্রথম হাদীসটি যে শব্দে বর্ণিত হয়েছে সেই শব্দে হাদীসটি আল্লামা যাইলাঈ পাননি বলে মত ব্যক্ত করেছেন। আল্লাম যাইলাঈ-র ভাষায় হাদীসটি গরীব। উল্লেখ্য, গরীব বলে তিনি বোঝাতে চান যে, আমি হাদীসটি পাইনি। এটি তাঁর নিজস্ব পরিভাষা। তবে ঐ শব্দে হাদীসটি পাওয়া না গেলেও হাদীসটির মর্ম সহীহ। তাই আল্লামা যাইলাঈ সঙ্গে সঙ্গে এও বলেছেন,
وبمعناه ما رواه مسلم من حديث عبد الله بن عمرو بن العاص …
অর্থাৎ ‘তবে এর মর্ম রয়েছে সহীহ মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস থেকে বর্ণিত হাদীসে …।’ (নাসবুর রায়াহ, ১/২৩০)
মুসলিম শরীফের সেই হাদীসে বলা হয়েছে : وَوَقْتُ صَلَاةِ الْمَغْرِبِ مَالَمْ يَغِبِ الشَّفَقُ ‘এবং মাগরিবের সালাতের ওয়াক্ত থাকে যতক্ষণ না শাফাক অন্তর্হিত হয়।’ (সহীহ মুসলিম,[1] হাদীস: ১৪১৯)
লেখক ইব্ন হাজার আসকালানী-র দিরায়াহ কিতাবের বরাত দিয়ে বলেছেন যে, ইব্ন হাজার আসকালানী বলেন,‘আমি এরূপ বর্ণনা পাইনি’। কিন্তু ইব্ন হাজার আসকালানীর পরের কথাটুকু তিনি উদ্ধৃত কেন করলেন না তা বুঝতে পারলাম না। ইব্ন হাজার আসকালানী রাহ. বলেছেন:
لم أجده هكذا، لكن من فعل النبى صلى الله عليه وسلم (كذا في المطبوع، والصواب: قول النبي صلى الله عليه وسلم) في حديث عبد الله بن عمرو قال: سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم عن وقت الصلوات فذكر الحديث، وفيه “ووقت صلاة المغرب إذا غابت الشمس ما لم يسقط الشفق” وفي رواية “مالم يغب الشفق”.
অর্থাৎ হাদীসটি আমি এইভাবে পাইনি। কিন্তু আব্দুল্লাহ ইব্ন আমরের হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীরূপে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হল সালাতসমূহের ওয়াক্ত সম্পর্কে। আব্দুল্লাহ ইব্ন আমর অতপর হাদীসটি বর্ণনা করেন। হাদীসটিতে আছে : ‘এবং মাগরিবের সালাতের ওয়াক্ত যখন সূর্য ডুবে যায়, (আর থাকে ততক্ষণ) যতক্ষণ না শাফাক ডুবে যায়।’ অন্য বর্ণনায় আছে : ‘যতক্ষণ না শাফাক অদৃশ্য হয়ে যায়।’ (আদ-দিরায়াহ ১/১০২)
তো ইব্ন হাজার আসকালানী রাহ. বলছেন যে, হাদীসটিকে ঐ শব্দে না পেলেও হাদীসটির মর্ম ভিন্ন শব্দে আব্দুল্লাহ ইব্ন আমর রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে বিবৃত হয়েছে। লেখক ইব্ন হাজার আসকালানী এবং যাইলাঈ রাহ. উভয়ের বক্তব্যকে আংশিক উদ্ধৃত করেছেন। ফলে পাঠক ভুল বার্তা পাবে যে, এই কথাটিই সহীহ নয়। অথচ কথাটি সহীহ। উপরের আলোচনা দ্বারা তা প্রমাণিত হয়েছে। তো এইরূপ অসম্পূর্ণ উদ্ধৃতি ও অসম্পূর্ণ আলোচনা সম্বলিত লেখা -যা পাঠককে ভুল বার্তা দেয়- লেখকের পক্ষে লেখা কতটুকু সমীচীন হয়েছে তা বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।
কোনো কথা সহীহ হাদীসে বিদ্যমান থাকলে ঐ কথার পক্ষের জাল ও যঈফ হাদীসকে অবশ্যই জাল ও যঈফ বলে চিহ্নিত করতে হবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও জানাতে হবে যে, বিশেষ শব্দে বা বিশেষ সনদে ঐ মর্ম বা কথাসম্বলিত হাদীসটি যঈফ বা জাল হলেও মর্মটি বা কথাটি সহীহ সনদ তথা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। কারণ, কোনো কথা সহীহ সনদে বর্ণিত হলে মুহাদ্দিসগণ সেটিকে সহীহ হাদীস বলেন। কিন্তু ঐ একই কথা যখন যঈফ সনদে (একই শব্দে বা ভিন্ন শব্দে) বর্ণিত হয় তখন তাঁরা সেই হাদীসটিকে যঈফ বলেন। তখন তাঁদের কথার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, ঐ বিশেষ সনদটি যঈফ; এই নয় যে, হাদীসের মূল কথাটিই যঈফ। বরং ঐ বিশেষ সনদে হাদীসটি যঈফ হলেও কথাটি সহীহ। কারণ, কথাটি সহীহ সনদেও বর্ণিত হয়েছে।
তদ্রূপ ঐ একই কথা কিংবা একই মর্ম (একই শব্দে বা ভিন্ন শব্দে) যখন মিথ্যাবাদী রাবীসম্বলিত কোনো সনদে বর্ণিত হয় তখন মুহাদ্দিসগণ বলেন, হাদীসটি জাল ও বানোয়াট। তখন তাঁদের কথার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, এই বিশেষ সনদটির কারণে হাদীসটি জাল বা ঐ ভিন্ন শব্দটি জাল। কিন্তু কথাটি সহীহ বা মর্মটি সহীহ। কারণ, কথাটি বা মর্মটি সহীহ সনদেও বর্ণিত হয়েছে।
আরেকটি বিষয়ও সংক্ষিপ্তরূপে বলার প্রয়োজন বলে মনে করছি। আর তা হল, মুহাদ্দিসগণ ও গবেষকগণ যখন বলেন যে, এই হাদীসটি আমি পাইনি তখন এর অর্থ এই দাঁড়ায় না যে, হাদীসটি জাল। কারণ, কোনো হাদীসকে জাল বলে আখ্যায়িত করার অর্থ হল, যেসব নিদর্শন দ্বারা হাদীস জাল বলে প্রমাণিত হয় সেসব নিদর্শনসমূহের কোনো নিদর্শন তাতে বিদ্যমান আছে। আর কোনো হাদীস না পাওয়ার অর্থ হল, না পাওয়ার কথা যিনি বললেন, তিনি হাদীসটির সন্ধান লাভ করতে পারেননি। হতে পারে আসলেই হাদীসটির কোনো অস্তিত্ব নাই। আবার এও হতে পারে যে, কোথাও না কোথাও হাদীসটি আছে; তা সে সহীহ সনদেই হোক কিংবা যঈফ সনদে; কিংবা এমন কোনো সনদে যা দ্বারা হাদীসটি জাল বলে প্রমাণিত হয়। উদাহরণত আল্লামা যায়লাঈ যেসব হাদীস সম্পর্কে বলেছেন যে, হাদীসটি গরীব তথা হাদীসটি আমি পাইনি, সেসবের অনেক হাদীস পরবর্তীতে মুহাদ্দিসগণ পেয়েছেন এবং সেগুলোর সংকলনও তৈরী হয়েছে। সেরূপ একটি সংকলন তৈরী করেছেন আল্লামা কাসেম ইব্ন কুতলূবুগা। তাঁর ঐ সংকলনটির নাম
منية الألمعي فيما فات من تخريج أحاديث الهداية للزيلعي
অতএব, হাদীসকে ‘জাল’ আখ্যায়িত করতে শুধু আল্লামা যায়লাঈ বা ইবন হাজার আসকালানীর ‘আমি পাইনি’ কথাটিকে ভিত্তি বানানো লেখকের পক্ষে সমীচীন হয়নি। তাছাড়া আল্লামা যায়লাঈ যখন বলেন হাদীসটি ‘গরীব’ তখন তার অর্থ হল, হাদীসটির সন্ধান তিনি পাননি। যেমনটা আমি পূর্বে বলে এসেছি। লেখক ‘অর্থাৎ ভিত্তিহীন’’ বলে আল্লামা যায়লাঈ-র ‘গরীব’ কথাটির অর্থ করেছেন ‘ভিত্তিহীন’। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, লেখকের জ্ঞানের ভিত্তি কতটা দুর্বল।
দ্বিতীয় হাদীসটি সম্পর্কে ইব্ন হাজার আসকালানী রাহ. বলেছেন,
لم أَجِدهُ، لكِن فِي حَدِيث أبي مَسْعُود عِنْد أبي دَاود وَيُصلي الْمغرب حِين تسْقط الشَّمْس وَيُصلي الْعشَاء حِين يسود الْأُفق.
অর্থাৎ ‘হাদীসটি আমি পাইনি। তবে আবূ দাঊদে আবূ মাসঊদের হাদীসে আছে, ‘এবং তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাগরিব আদায় করতেন যখন সূর্য অস্ত যেত এবং এশা আদায় করতেন যখন আকাশের প্রান্ত কালো হয়ে যেত।’
আবূ দাঊদের যে হাদীসটির উদ্ধৃতি হাফেজ ইবনে হাজার দিলেন সেই হাদীসটি সম্পর্কে ফজরের ওয়াক্তের আলোচনায় বলে এসেছি যে, হাদীসটি উসামা ইব্ন যায়দ আল-লাইছীর শায বা দল-বিচ্ছিন্ন বর্ণনা। আমরা হাদীসটিকে দলীল হিসাবে ব্যবহৃত হওয়ার উপযুক্ত মনে করি না। কিন্তু লেখক যেহেতু হাদীসটিকে তাগলীস বিল ফাজরের পক্ষে দলীল হিসাবে উল্লেখ করেছেন সেহেতু এখানেও তাঁর উচিত ছিল দ্বিতীয় হাদীসটির পরে এটিকে উল্লেখ করা। সম্ভবত উল্লেখ করেননি হাদীসটি এখানে তাঁর মতের বিপক্ষে যায় বলে। কারণ, এই হাদীসে লালিমার পরে সাদা রেখাও যখন অন্তর্হিত হয়ে আকাশের প্রান্ত কালো হয়ে যাবে তখন এশার সালাত আদায় করার কথা বলা হয়েছে: যদ্দারা বোঝা যায় যে, মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ হয় আকাশের সাদা রেখা অন্তর্হিত হলে। আর এটি লেখকের মতের বিরুদ্ধে যায়। পূর্ব থেকেই একটি মত ও ধারণা নির্দিষ্ট করে রেখে সুবিধামত সেই মত ও ধারণার পক্ষে হাদীস ব্যবহার করার এই মানসিকতা পরিহার করা উচিত। কারণ, এইরূপ মানসিকতা শরীয়ত-অনুসরণের দ্বারকে রুদ্ধ করে দেয় এবং প্রবৃত্তির অনুসরণের সহস্র দ্বারকে উন্মুক্ত করে দেয়।
উল্লেখ্য, দ্বিতীয় হাদীসের শেষ শব্দদুটোতে লেখক যেভাবে হরকত লাগিয়েছেন আমি হুবহু তার অনুসরণেই হরকত লাগিয়েছি। কিন্তু সঠিক হরকত হবে এইরূপ: إِذَا اسْوَدَّ الْاُفُقُ
তৃতীয় ও চতুর্থ হাদীসে ব্যক্ত হয়েছে যে, শাফাক অর্থ লালিমা এবং তা রাসূলের উক্তি হিসাবে বর্ণিত হয়েছে, ইব্ন ওমরের নয়। অথচ লেখক তৃতীয় হাদীসের তরজমা করেছেন এইভাবে: ইবনু ওমর রা. বলেন, শাফাক্ব হল লালিমা। যখন লালিমা, দূরীভূত হবে তখন ছালাত ওয়াজিব হবে। তরজমাটি ভুল। তরজমা হবে এইরূপ: ইবনু ওমর বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, শাফাক্ব হল লালিমা। লেখকের তরজমায় পাঠক ভুল বার্তা পাবে। কারণ, হাদীসটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্তি হিসাবে সহীহ না হলেও ইবন ওমর রা.-এর উক্তি হিসাবে সহীহ। হযরত ইব্ন উমর রা.-এর মতে শাফাক হল লালিমা। তো লেখক যখন তরজমায় ‘ইবন্ ওমর রাঃ বলেন’ লেখার পর মন্তব্যে হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন তখন পাঠক মনে করবে যে, ইবন ওমর রা.-এর উক্তি হিসাবেও কথাটি সহীহ নয়।
লেখক যেসব কিতাবের বরাত দিয়ে থাকেন সেগুলোও তিনি ভালোরূপে পাঠ করেন না, বা বোঝেন না। তানকীহুল কালামের লেখক বলেছেন, ‘হাদীসটিকে মারফূ‘রূপে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে আতীক বিন ইয়াকূব ভুল করেছেন। সঠিক হল, উক্তিটি ইব্ন ওমরের ।’
তারপর দেখুন, লেখক মন্তব্য করেছেন : ‘বর্ণনাটি যঈফ।…। তাছাড়া উক্ত বর্ণনা এশার ছালাতের জন্য প্রযোজ্য মাগরিবের জন্য নয়।’ আমার বক্তব্য হল, এরূপ কোনো নির্বোধ আছে নাকি যিনি হাদীসটিকে মাগরিবের সালাতের জন্য প্রযোজ্য বলে বলতে পারেন বা বলেছেন? সূর্যাস্তের পর শাফাক দূরীভূত হওয়ার পর যে সালাত ওয়াজিব হবে তা যে এশার সালাত তা একজন ইবতিদায়ী শ্রেণীর ছাত্রেরও বোঝার কথা। তাছাড়া হাদীসটি মাগরিবের সালাতের জন্য যখন প্রযোজ্য নয় এবং সেইরূপ দাবীও কেউ করেননি তখন হাদীসটিকে মাগরিবের সালাতের অনুচ্ছেদে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য কী? নিজের পান্ডিত্য জাহির করা? তাহলে লেখকের জন্য তা বুমেরাং হয়ে গেছে। সচেতন পাঠক তাঁর পান্ডিত্যের পরিমাপ ঠিকই করে ফেলেছেন।
এরপর লেখক ‘মাগরিবের ছালাতের সঠিক সময়’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘সূর্য ডুবার পরেই মাগরিবের ছালাতের সময় শুরু হয়। আর সূর্যের লালিমা থাকা পর্যন্ত এর সময় অবশিষ্ট থাকে।’ তাঁর এই কথার বরাত তিনি দিয়েছেন মুসলিম শরীফের ১৪১৯ নং হাদীসের। আমার প্রশ্ন হল, মুসলিম শরীফের ঐ হাদীসে কোথায় বলা হয়েছে যে, লালিমা থাকা পর্যন্ত এর সময় অবশিষ্ট থাকে? হাদীসটিতে শাফাকের কথা বলা হয়েছে, সুনির্দিষ্টভাবে লালিমার কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে :
وَوَقْتُ صَلَاةِ الْمَغْرِبِ مَا لَمْ يَغِبِ الشَّفَقُ
(এবং মাগরিবের সালাতের ওয়াক্ত থাকে যতক্ষণ না শাফাক অন্তর্হিত হয়।)
লেখক শাফাকের অর্থ গ্রহণ করেছেন লালিমা। কিন্তু এর পক্ষে কোনো সহীহ হাদীস তিনি উদ্ধৃত করেননি। যেসব হাদীসে লালিমার কথা বলা হয়েছে সেসব হাদীসকে তিনি যঈফ বলেছেন। তাহলে শাফাক অর্থ যে লালিমা তা তিনি কোত্থেকে পেলেন?
মুহতারাম,
আসলে শাফাকের অর্থ লালিমাও হতে পারে এবং লালিমার পরে দৃশ্য সাদা রেখাও হতে পারে। শব্দটি ঐসকল শব্দের একটি যেগুলো একাধিক অর্থ দান করে। অভিধান বিশারদদের কেউ কেউ শাফাকের অর্থ ব্যক্ত করেছেন লালিমা। কেউ কেউ এর অর্থ ব্যক্ত করেছেন সাদা রেখা। শাফাক বলে এখানে লালিমা বোঝানো হয়েছে না সাদা রেখা বোঝানো হয়েছে তা নিয়ে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যেও মতভেদ ছিল। ইব্ন ওমর রা.-এর মতে শাফাক হল লালিমা। কিন্তু হযরত আবূ হুরায়রা রা.-এর মতে শাফাক হল সাদা রেখা। এ সম্পর্কে বিশদ বিবরণে না গিয়ে আল্লামা খাত্তাবী রাহ.-এর একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করছি। আল্লামা খাত্তাবী রাহ. বলেন :
وَلَمْ يَخْتَلِفُوْا فِيْ أَنَّ أَوَّلَ وَقْتِ الْعِشَاءِ الآخِرَةِ غَيْبُوْبَةُ الشَّفَقِ، إِلَّا أَنَّهُمْ اخْتَلَفُوْا فِي الشَّفَقِ مَاهُوَ، فَقَالَتْ طَائِفَةٌ : هُوَ الْحُمْرَةُ، رُوِيَ ذلِكَ عَنْ ابْنِ عُمَرَ وَ ابْنِ عَبَّاسٍ، وَهُوَ قَوْلُ مَكْحُوْلٍ وَطَاؤسٍ، وَبِهِ قَالَ مَالِكٌ وَسُفْيَانُ الثَّوْرِي وَابْنُ أَبِي لَيْلَى وَ أَبُوْ يُوْسُفَ وَمُحَمَّدٌ وَالشَّافِعِيُّ وَأَحْمَدُ وَإِسْحَاقُ، وَرُوِيَ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّهُ قَالَ : الشَّفَقُ الْبَيَاضُ، وَ عَنْ عُمَرَ بْنِ عَبْدِ الْعَزِيْزِ مِثْلُهُ ، وَ إِلَيْهِ ذَهَبَ أَبُوْ حَنِيْفَةَ وَهُوَ قَوْلُ الْأَوْزَاعِي، وَحُكِيَ عَنِ الْفَرَّاءِ أَنَّهُ قَالَ : الشَّفَقُ الْحُمْرَةُ ، وَأَخْبَرَنِي أَبُوْ عُمَرَ عَنْ أَبِي الْعَبَّاسِ أَحْمَدَ بْنِ يَحْيى قَالَ : الشَّفَقُ الْبَيَاضُ وَأَنْشَدَ لِأَبِي النَّجْمِ : حتى إذا الليل جلاه المجتلي = بين سماطي شفق مهوّل ، يُرِيْدُ الصُّبْحَ، وَقَالَ بَعْضُهُمْ الشَّفَقُ إِسْمٌ لِلْحُمْرَةِ وَالْبَيَاضِ مَعًا، إِلَّا أَنَّهُ إِنَّمَا يُطْلَقُ فِي أَحْمَرَ لَيْسَ بِقَانِي وَأَبْيَضَ لَيْسَ بِنَاصِعٍ ، وَإِنَّمَا يُعْلَمُ الْمُرَادُ مِنْهُ بِالْأَدِلَّةِ لَا بِنَفْسِ اللَّفْظِ، كَالْقُرْءِ الَّذِي يَقَعُ إِسْمُهُ عَلَى الطُّهْرِ وَالْحَيْضِ مَعًا وَكَسَائِرِ نَظَائِرِهِ مِنَ الْأَسْمَاءِ الْمُشْتَرِكَةِ.
অর্থাৎ এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই যে, এশার শুরু ওয়াক্ত শাফাক অন্তর্হিত হওয়া। তবে তাঁরা দ্বিমত করেছেন এই ব্যাপারে যে, শাফাক কী? তো একদল বলেন, শাফাক হল লালিমা। মতটি বর্ণিত হয়েছে ইব্ন ওমর ও ইব্ন আববাস হতে। মাকহূল ও তাঊসের মতও তা-ই। এই মতই পোষণ করেছেন মালেক, সুফইয়ান ছাওরী, ইব্ন আবূ লায়লা, আবূ ইউসুফ, মুহাম্মাদ, শাফিঈ, আহমাদ ও ইসহাক। পক্ষান্তরে আবূ হুরায়রা হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, শাফাক হল সাদা রেখা। ওমর ইব্ন আব্দুল আযীয হতেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। এই মতের পক্ষে গিয়েছেন আবূ হানীফা। আওযাঈ-র মতও তা-ই। ফার্রা হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, শাফাক হল লালিমা। আর আবূ ওমর আমাকে জানিয়েছেন যে, আবুল আববাস আহমাদ ইব্ন ইয়াহ্ইয়া বলেছেন, শাফাক হল, সাদা রেখা এবং এর পক্ষে তিনি আবুন নাজমের একটি কবিতাংশ আবৃত্তি করেছেন। তা হল :
حتى إذا الليل جلاه المجتلي
بين سماطي شفق مهول
এবং কেউ বলেন, শাফাক হল লালিমা ও সাদা রেখা উভয়টির নাম। তবে তা টকটকে লাল নয় এবং ধবধবে সাদা নয়। তবে শব্দটি কোথায় কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা জানা যাবে প্রাসঙ্গিক লক্ষণ দ্বারা। শুধু শাফাক শব্দ দ্বারা নয়। যেমন القرء শব্দটি হায়েয ও পবিত্রতা উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়। (দ্রষ্টব্য: মাআলিমুস সুনান, ১৩৫ নং হাদীসের অধীনে আলোচনা)