ফাংশনাল ফুড কি? কিভাবে কাজ করে?

বর্তমান আধুনিক জীবনধারায় অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, কায়িক পরিশ্রম বা শরীরচর্চায় অনীহা এবং মানসিক চাপ, স্থূলতা এবং দীর্ঘস্থায়ী বিভিন্ন অসুখ সৃষ্টি করছে, যা মানুষের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলার মাধ্যমে কিছু ক্ষেত্রে করোনার দ্রুত বিস্তারকেও সহজতর করেছে। তাই, করোনার প্রাদুর্ভাবসহ অন্যান্য ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ব্যাপারে নজর দিতে হবে।

 

ফাংশনাল ফুড’-এর ধারণা উদ্ভূত হয় এবং ১৯৯১ সালে এটি জাপানে আইনি ভিত্তি পায়। বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ ২০১৩ সালে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ পাস করে, যেখানে ৩১ নং ধারার অধীনে ‘ফাংশনাল ফুড’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

 

ফাংশনাল ফুড বলতে মূলত প্রাকৃতিক ও নিরাপদ খাদ্যকে বোঝায়, যা আমাদের মৌলিক পুষ্টি চাহিদার ঊর্ধ্বে গিয়ে শরীরের একাধিক কার্যকারিতায় ভূমিকা রাখে এবং বিশেষ কিছু রোগ ও অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। ফাংশনাল ফুড বিভিন্ন বায়ো-অ্যাকটিভ উপাদানের মাধ্যমে শরীরে কার্যকর প্রভাব ফেলে। হলুদ, গোলমরিচ, আদা, মধু, অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার, চিয়াসিড, কাজুবাদাম, দারুচিনি ইত্যাদি ফাংশনাল ফুড হিসেবে পরিচিত। এগুলোর মধ্যে হলুদের অন্যতম সক্রিয় উপাদান কারকিউমিন হৃদরোগ, আলঝেইমার ও ক্যান্সার প্রতিরোধে অত্যন্ত উপকারী। পেটের অসুখ, মাথাব্যথা ও ইনফেকশন সারাতে বহু বছর ধরেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে আদা। স্বাদবর্ধক গোলমরিচে রয়েছে পিপেরিন নামের একটি বিশেষ উপাদান, যা স্কিন ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে ও ব্রেনের বেটা-এন্ডরফিন্স বৃদ্ধি করে। এন্ডরফিন্স প্রাকৃতিক ব্যথানাশক হিসেবে কাজ করতে পারে। এছাড়া গোলমরিচ সেরেটোনিন বৃদ্ধির মাধ্যমে ডিপ্রেশন কমাতেও কার্যকর ভূমিকা রাখে। বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকাসহ পৃথিবীর উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর দেশেও মানুষ বায়ো-অ্যাকটিভসমৃদ্ধ খাদ্যের মাধ্যমে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

 

বর্তমান কর্মব্যস্ত জীবনে মানুষ প্রক্রিয়াজাত খাবারের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কিন্তু প্রক্রিয়াজাত খাবার খাদ্যের পুষ্টিমান হ্রাস করছে। এক্ষেত্রে ফাংশনাল ফুড নিরাপদভাবে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে আধুনিক খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সুস্থ জীবনযাপনে সক্ষম করে তোলে।

 

বর্তমানে মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফাংশনাল ফুড প্রতিনিয়ত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী ফাংশনাল ফুডের বাজার ছিল ১৭০ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২২ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত ৬ দশমিক ৭ শতাংশ সিএজিআরে বৃদ্ধি পাবে এবং ২০২৬ সালের মধ্যে ২৫১ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

 

অর্গানিক শব্দটি সারাবিশ্বেই এখন বেশ আলোচিত। বাংলাদেশেও অর্গানিক ফুডের ব্যাপারে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু অর্গানিক বলতে আসলে কী বোঝায় সেই বিষয়ে অনেকেরই তেমন স্পষ্ট ধারণা নেই। অর্গানিক ফুড হচ্ছে এমন খাবার, যা কোনও ধরনের রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ছাড়া শতভাগ প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদন করা হয় এবং এর রক্ষণাবেক্ষণেও কোনও ধরনের কৃত্রিম উপাদান ব্যবহার করা হয় না। পরিবেশবান্ধব এই উৎপাদন ব্যবস্থা মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি দূষণ রোধ করে বলে এখন সারাবিশ্বেই এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

 

ফাংশনাল ফুডের ৬ টি অতি গুরুত্বপূর্ন উপাদানঃ

 

১) Antioxidant (এন্টিঅক্সিডেন্ট)

 

এমন একটি পদার্থ যা অক্সিজেনের ক্ষয় হ্রাস করে, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলির মধ্যে এনজাইম এবং ভিটামিন ‘সি’ ভিটামিন ‘ই’ ও বিটা ক্যারোটিনের মতো অন্যান্য পদার্থ রয়েছে যা জারণের ক্ষতিকারক প্রভাবগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়তা করে।

 

২) Anthocyanins (অ্যান্থোসায়ানিনস)

 

অ্যান্থোসায়ানিন টিস্যু বা কোষকে অনেকগুলি অ্যাজিওটিক স্ট্রেসের বা বিষাদের বিরুদ্ধে সুরক্ষা কবজের কাজ করে। অ্যান্থোসায়ানিনগুলোর জন্য সুরক্ষার বিভিন্ন প্রক্রিয়া (সানস্ক্রিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ধাতব জিলেটিন) প্রস্তাব করা হয়েছে। অ্যান্থোসায়ানিনস খনিজ ঘাটতির সম্মুখীন কোষের সংবেদনশীলতা বিলম্বিত করে। অ্যান্থোসায়ানিন মানুষ ও জীবজন্তুর শরীর গঠণে কার্যকরি।

 

৩) Niacin (নিয়াসিন)

 

ভিটামিন ‘বি’ এর মতো নিয়াসিন কার্বোহাইড্রেটকে গ্লুকোজে রুপান্তর করতে, চর্বি ও প্রোটিন বিপাক করতে এবং স্নায়ুতন্ত্রকে সঠিকভাবে কার্যকর রাখতে ভূমিকা রাখে। নিয়াসিন শরীরকে যৌন এবং স্ট্রেস সম্পর্কিত হরমোন তৈরি করতে সহায়তা করে এবং উপকারী (HDL) কোলেস্টরল মাত্রাকে বৃদ্ধি করে।

 

৪) Riboflavin (রিবোফ্লাভিন)

 

ভিটামিন ‘বি’-২, প্রোটিন, চর্বি এবং কার্বোহাইড্রেট ভেঙ্গে ফেলতে সহায়তা করে। এটি শরীরের শক্তি সরবরাহ এবং শক্তি বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রিবোফ্লাভিন কার্বোহাইড্রেটকে অ্যাডেনোসিন ট্রাইফসফেটে (এটিপি) রূপান্তর করতে সহায়তা করে। মানব দেহ খাদ্য থেকে এটিপি উৎপাদন করে এবং শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী এটিপি ও শক্তি উৎপাদন করে।

 

৫) Tocopherol (টোকোফেরল)

 

টোকোফেরল একধরণের অ্যান্টিঅক্স্রিড্যান্ট যা ভিটামিন ‘ই’ সমৃদ্ধ। আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিডের ক্ষতির হাত থেকে দেহের টিস্যুগুলিকে রক্ষা করে। দেহের ফ্রী র‍্যাডিক্যাল দ্বারা  ধ্বংসের হাত থেকে দেহকে রক্ষা করে। বার্ধক্য রোধে ভূমিকা পালন করে।

 

৬) Lipid peroxidation (লিপিড পারঅক্সিডেশন)

 

লিপিড পারঅক্সিডেশন হলো লিপিডগুলির অক্সিডেটিভ বা অবক্ষয়। এটি এমন প্রক্রিয়া যেখানে কোষের ঝিল্লিতে লিপিডগুলি থেকে ফ্রি র‍্যাডিক্যালগুলি ‘স্টোলেন’ ইলেকট্রন তৈরি করে ফলে কোষের ক্ষতি হয়। এই প্রক্রিয়াটি একটি ফ্রি র‍্যাডিক্যাল চেইন বিক্রিয়ার মাধ্যমে এগিয়ে যায়। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *