ইসলামইসলামিক বিষয়াদি

আক্দ এর সহিহ্ পদ্ধতি

সহিহ্ পদ্ধতিতে আকদ এর নিয়ম

 

বিবাহ রীতিটি প্রথাগত। প্রথাসমূহ ধর্মের বিভিন্নতায় এবং দেশ ও কাল ভেদে বিবর্তিত হয়েছে।

 

ইসলামে বিবাহের বিধান চুক্তিভিত্তিক।ইসলামই সম্ভবতঃ চুক্তিভিত্তিক বিবাহপ্রথা প্রবর্তক প্রথম ধর্ম।।

 

স্বামী ও স্ত্রী, উভয়েরই, চুক্তিতে সম্মতি আবশ্যক। সাক্ষীদের উপস্ছিতিতে।স্বামীর কর্তব্য হচ্ছে স্ত্রীকে মেহের প্রদান করা। চুক্তি রদ করাও যায়। চুক্তিরদে উভয়েরই অধিকার রয়েছে।চুক্তি মোতাবেক মেহের পরিশোধ স্বামীর অবশ্য পালনীয় কর্তব্য, এমনকি স্ত্রী কর্তৃক চুক্তিরদের ক্ষেত্রেও।

 

পবিত্র কোরাণ শরীফে সুরা বাকারা, সুরা নিসা, সুরা মায়িদা, সুরা নুর, সুরা আহজাব, সুরা মুমতাহেনা ও সুরা তালাকে বিবাহ ও তালাক সম্পর্কে বিধানাবলি বিধৃত রয়েছে। এগুলো মান্য করে হাদিসের অনুসরণে মুসলিম বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।

 

(দিনশা ফারদুনজি মোল্লা প্রণীত ‘মোহামেডান ল’ এবং স্যর রোনাল্ড উইলসনের ‘হ্যান্ডবুক অন মুসলিম ম্যারেজ’ পাঠ করতে পারেন।)

 

তবে পুরুষকে নারীর ওপর বিশিষ্টতা প্রদান করা হয়েছে ( সুরা নিসা আয়াত ৩৪)।

 

আকদ আরবি শব্দ; এর বাংলা প্রতিশব্দ হলো বন্ধন।

 

বংলাদেশে চুক্তি সম্পাদন লক্ষ্যে যে অনুষ্ঠান হয় সেটিকে আকদ বলে।এটি সম্পন্ন হলেই বিবাহবন্ধন ধর্মিয় স্বীকৃতি লাভ করে। সাধারণতঃ সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত কাজী বা মুসলিম বিবাহ রেজিষ্ট্রারের উপস্হিতিতে ঘটে।আকদকালে বর, কনে, সাক্ষীগণ ও কাজী উপস্থিত থাকে।উভয়পক্ষের ঘনিষ্ট জনরাও উপস্থিত থাকেন। এটি কনের অভিভাবকের আবাসে, সাধারণতঃ অনুষ্ঠিত হয়। তখন অভিভাবক খাবারদাবারের/ভোজের ব্যবস্থা করেন। কাজীর অনুপস্থিতিতেও এটি অনুষ্ঠিত হতে পারে।পরে কাজীর অফিসে গিয়ে রেজেষ্ট্রি করাতে হবে ;অন্যথায় বাংলাদেশী আইনি ভিত্তি অনুপস্থিত থাকবে।

 

মোহরাদি ধার্য ইত্যাদি হয়ে থাকলে কাজী বা ইমাম সাহেব সূক্ষ্মভাবে খোঁজ নেবেন যে, অলী কে এবং শরয়ী কিনা? বরের চার স্ত্রীর বর্তমানে এটা পঞ্চম বিবাহ তো নয়? বর মুসলিম তো? পাত্রী ইদ্দতের মধ্যে তো নয়? গর্ভবতী তো নয়? পাত্রের দ্বিতীয় বিবাহ হলে পূর্বের স্ত্রীর বর্তমানে এই পাত্রী তার বোন, ফুফু, বুনঝি বা ভাইঝি তো নয়। এই পাত্রী সধবা হয়ে কারো স্বামীত্বে নেই তো? পাত্রীর দ্বিতীয় বিবাহ হলে তার পূর্ব স্বামী যথারীতি তালাক দিয়েছে তো? পাত্রী রাজী আছে তো? পাত্রীর কোন বৈধ শর্ত তো নেই? দু’জন সঠিক ও উপযুক্ত সাক্ষী আছে কিনা? ইত্যাদি।

 

অতঃপর সহীহ হাদীসসম্মত খুৎবা পাঠ করবেন। খুতবায় উল্লেখিত আয়াত আদির অনুবাদ পাত্রকে বুঝিয়ে দেওয়া উত্তম। প্রকাশ যে, এ খুৎবা আক্দের জন্য জরুরী নয়, সুন্নত। অতঃপর অলীকে বলতে বলবেন অথবা তার তরফ থেকে উকীল হয়ে বরের উদ্দেশ্যে একবার বলবেন, ‘এত টাকা দেনমোহরের বিনিময়ে অমুক গ্রামের অমুকের কন্যা অমুকের (স্পষ্ট নাম উল্লেখ করে) তোমার সাথে বিবাহ দিচ্ছি।’

 

পাত্র বলবে , ‘আমি এই বিবাহ কবুল করছি।’

 

এরপর সকলে বরের উদ্দেশ্যে একাকী এই দুআ করবে,

 

بَارَكَ اللهُ لَكَ وَبَارَكَ عَلَيْكَ وَجَمَعَ بَيْنَكُمَا فِيْ خَيْرٍ.

 

উচ্চারণঃ- বা-রাকাল্লা-হু লাকা অবা-রাকা আলাইকা অজামাআ বাইনাকুমা ফী খাইর।

 

অর্থাৎ, আল্লাহ তোমার প্রতি বর্কত বর্ষণ করুন, তোমাকে প্রাচুর্য দান করুন এবং তোমাদের উভয়কে মঙ্গলের মাঝে একত্রিত করুন।[1]

 

বাহ্যিক আড়ম্বরহীন ইসলামে এইখানে বিবাহের আসল কর্ম শেষ।

 

জ্ঞাতব্য বিষয় যে, আক্দের সময় কনে মাসিকাবস্থায় থাকলেও কোন ক্ষতি নেই। তবে সেই সময়ে বাসরশয্যায় না পাঠানোই উচিৎ।

 

বর বোবা হলে ইশারা ও ইঙ্গিতে কবুল গ্রহণযোগ্য।[2] হাতের লিখা পরিচিত হলে চিঠি আদান-প্রদান করে আক্দ সম্ভব। তবে চিঠি দেখিয়ে প্রস্তাব ও কবুলের উপর ২জন সাক্ষী রাখা জরুরী।[3] বর জ্ঞানশূন্য বা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকলে আক্দ সহীহ নয়।[4] টেলিফোনে ধোঁকার আশঙ্কা থাকার জন্য আক্দ শুদ্ধ নয়।[5]

 

পাত্র-পাত্রী দেখাদেখি না হয়ে কোন ইজতেমায় চোখবন্ধ করে কেবল আবেগবশে বিবাহ যুক্তিযুক্ত নয়।

 

পাকা দলীল রাখার জন্য বিবাহের বর, কনে, অলী, সাক্ষী প্রভৃতির নাম ও স্বাক্ষর এবং মোহর, শর্ত ইত্যাদি (কাবিল বা কবুলনামা) লিখে নেওয়া দোষের নয়।

 

বরের দ্বিতীয় বিবাহ হলে প্রথমা স্ত্রীর অনুমতি জরুরী নয়।[6]

 

এ ছাড়া বর্তমানের ইয্ন নেওয়ার অনুষ্ঠান এবং উকীল ও সাক্ষী সহ কনের ইয্ন আনতে যাওয়ার ঘটার সমর্থন শরীয়তে মিলে না। বিবাহ আক্দের জন্য সাক্ষী জরুরী, কনের ইয্নের জন্য নয়। এর জন্য কনের অভিভাবকই যথেষ্ট। অবশ্য অভিভাবকের পক্ষ থেকে ধোঁকা বা খেয়ানতের আশঙ্কা থাকলে কাযী নিজে অথবা তাঁর প্রতিনিধি পর্দার আড়াল থেকে কনের মতামত জানবে।

 

এছাড়া ইয্ন নেওয়ার জন্য কনেকে যেখানে বসানো হবে সেখানে লাতা দেওয়া, কনেকে উল্ট করে শাড়ি-সায়া-ব্লাউজ পরানো, কনের হাতে চুড়ি না রাখা, মাথার খোঁপা বা বেণী না বাঁধা, (অনেক এলাকায়) সুতির শাড়ি পরা জরুরী মনে করা, কনেকে পিঁড়ের উপর মহিলা-মজলিসের মাঝে পশ্চিম-মুখে বসানো এবং পর্দার আড়াল থেকে তিন বার ‘হুঁ’ নেওয়া, এই সময় কাঁসার থালায় গোটা পান-সুপারী (দাঁড়া-গুয়া-পান) (!) সহ জেওর-কাপড় বিবাহ মজলিস ও কনের কাছে নিয়ে যাওয়া-আসা, বিবাহ না পড়ানো পর্যন্ত কনের মায়ের রোযা রাখা (না খাওয়া) ইত্যাদি বিদআত ও অতিরিক্ত কর্ম।

 

যেমন আক্দের পর হাত তুলে জামাআতী (সাধারণ) দুআ। আক্দের পূর্বে বা পরে মীলাদ (জামাআতী দরূদ) পড়া, বরের দুই রাকআত নামায পড়া, উঠে মজলিসের উদ্দেশ্যে সালাম ও মুসাফাহা করা, নিজের হাতে ইমাম, উকীল ও সাক্ষীদেরকে ওলীমাহ (?) দেওয়া, শরবত ও পান হালাল করা, আক্দে তিন-তিন বার কবুল করানো, বরকে পশ্চিমমুখে বসানো, মাথায় টুপী জরুরী মনে করা ইত্যাদি বিদআত।[7]

 

বিবাহ-বন্ধনের পূর্বে বরকে কলেমা পড়ানোও বিদআত এবং বরের প্রতি কুধারণা। মুসলিম হওয়ায় সন্দেহ থাকলে পূর্বেই খবর নেওয়া দরকার। কারণ, তার সাথে কোন মুসলিম মেয়ের বিবাহ বৈধই নয়। তাছাড়া মুখে কলেমা পড়িয়ে কাজে যেমনকার তেমনি থাকলে মুসলিম হয় কি করে? পক্ষান্তরে পাত্রী কলেমা জানে কি না, তাও তো দেখার বিষয়? কিন্তু তা তো কই দেখা হয় না।

 

প্রকাশ থাকে যে, স্বামী-স্ত্রী উভয়ে একই সাথে ইসলাম গ্রহণ করলে অথবা কুফরী বা রিদ্দাহ থেকে তওবা করলে ইসলাম বা তওবার পূর্বের বিবাহ-বন্ধন পরেও বজায় থাকবে। পক্ষান্তরে দুজনের ইসলাম বা তওবা যদি আগে-পরে হয়, তবে সে ক্ষেত্রে স্ত্রীর আগে স্বামী ইসলাম গ্রহণ বা তওবা করলে তার কিতাবিয়াহ (সাধবী ইয়াহুদী বা খ্রিষ্টান) স্ত্রী ছাড়া বাকী অন্য ধর্মাবলম্বী স্ত্রীর সাথে যে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল, তা ছিন্ন হয়ে যাবে। অতঃপর (বিবাহের পর মিলন হয়ে থাকলে) সে তার ইদ্দতের মাঝে ইসলাম গ্রহণ বা তওবা করলে আর পুনর্বিবাহের প্রয়োজন হবে না। প্রথম বন্ধনেই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বজায় থাকবে। কিন্তু স্ত্রী যদি ইদ্দত পার হওয়ার পর ইসলাম গ্রহণ বা তওবা করে, তাহলে স্বামীর কাছে ফেরৎ যাওয়ার জন্য নতুন আক্দের প্রয়োজন হবে। অন্যথায় স্ত্রী যদি স্বামীর আগে ইসলাম গ্রহণ বা তওবা করে, তাহলে তার স্বামী যে ধর্মাবলম্বীই হোক তার পক্ষে হারাম হয়ে যাবে। অতঃপর তার ইদ্দতকালের মধ্যে স্বামী ইসলাম গ্রহণ বা তওবা করলে তাদের পূর্ব বিবাহ বহাল থাকবে। নচেৎ ইদ্দত পার হয়ে গেলে নতুন আক্দের মাধ্যমেই স্বামী-স্ত্রী এক অপরকে ফিরে পাবে।

 

ইমাম বা কাজীকে খুশী হয়ে আক্দের পর কিছু উপহার দেওয়া যায়। এখানে দাবী ও জোরের কিছু নেই।[8] দাই-নাপিত বিদায়ের সময় জোরপূর্বক পয়সা আদায়ের প্রথা ইসলামী নয়। বিবাহের সময় তাদের কোন কর্ম বা হক নেই।[9]

 

কাযায়ী গ্রহণও এক কুপ্রথা। বিশেষ করে এ নিয়ে ঝগড়া-কলহ বড় নিন্দার্হ। গ্রাম্য চাঁদা হিসাবে যদি এমন অর্থের দরকারই হয়, তবে নিজের গ্রামের বিয়ে-বাড়ি থেকে কিছু চাঁদা বা ভাড়া নেওয়া যায়। যেটা অন্য গ্রামে দিতে হয় সেটা নিজ গ্রামে দিলে ঝামেলা থাকে না।

 

বিবাহ মজলিসে বরের বন্ধু-বান্ধবদের তরফ থেকে অশ্লীল প্রশ্নোত্তর সম্বলিত হ্যান্ড্বিল প্রভৃতি বিতরণ করা ঈমানী পরিবেশের চিহ্ন নয়।

 

[2] (ফিকহুস সুন্নাহ ২/৩৫)

 

[3] (ঐ ২/৩৬)

 

[4] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ৪/৩৪২)

 

[5] (ঐ ৩/৩৭০)

 

[6] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ২৫/৬৭)

 

[7] (ফাতাওয়াল মারআতিল মুসলিমাহ ২/৭১৪)

 

[8] (ইসলামী তা’লীম, আব্দুস সালাম বাস্তবী ৬২৫-৬২৬ পৃঃ)

 

[9] (ঐ ৬২৬ পৃঃ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link