বিশ্বাস
লেখক
মোঃ রিয়াজুর রহমান রিয়াজ
পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ,
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সময়টা বর্ষাকাল। সকাল ৮.০০ঘটিকা
বাস স্টপে ভার্সিটির বাসের জন্য দাড়িয়ে আছে ছাত্রছাত্রীরা। বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে কাকতাড়ুয়া বনে যাওয়া অনুপম বাস স্টপের ছাউনিতে ঢুকতে যাবেই এই সময় পা পিছলে পরে গেলো ছেলেটা। বেচারা!! ছাউনির সবাই বিশেষ করে মেয়েগুলা একটু বেশি মজা নিল। সে দিকে ওর ভূক্ষ্রেপ নাই। এক গাল হাসি দিয়ে বিষয়টা সহজেই মানায় নিল সে। প্যান্টের গোড়ালির কাঁদা গুলা মুছতে মুছতে এমন সময় কানের কাছে ভেসে আসলো হাসির শব্দ। রিমঝিম বৃষ্টিতে সেই খিলখিল হাসি একটু বেশিই মোহময় ঠেকলো গ্রামের সাধাসিধে ছেলেটার কাছে। এক পলক চেয়ে থাকলো সেই রমণীর দিকে। শহরের মেয়ে সে। কিভাবে এরকম ছেলেকে শায়েস্তা করতে হয় তা ওর ভালো করেই জানা।কাছে এসেই কড়া গলায় বলল,
– এই যে মিস্টার কি দেখছেন এভাবে?
– জ্বি! মানে মানে আপু ক্যাম্পাসের বাস কি ছেড়ে গেছে নাকি আসবে?
– ছেড়ে গেছে মানে? ছেড়ে গেলে আমরা কি এখানে ঘাস কাটিতে রহিয়াছি জনাব! হাহা (পাশ থেকে ওর আর এক বান্ধুবি)
– ওও, আচ্ছা।
এই সময় মেয়েটা আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই ভার্সিটির বাস চলে আসাতে এবারের যাত্রায় বেঁচে গেলো ছেলেটা।
ভার্সিটিতে ঢুকে অতি কষ্টে একে ওকে জিজ্ঞেস করে নিজ শ্রেণিকক্ষের ঠিকানা পেল অনুপম।
শহরে এসে প্রথম প্রথম একটু কষ্টই হতো ছেলেটার সবকিছুতে মানিয়ে নিতে। সেই বাস স্টপের মেয়েগুলার বন্ধুমহলে আজ সে জায়গা পেয়েছে। মূলত তার ওই সহজ সরল স্বভাব আর ভালো ছাত্র বলেই। তবে এখনকার যুগে খারাপ অভ্যাস যেটি তা হল সে খুব সহজেই সকলকে বিশ্বাস করতো। আর সে বিশ্বাসের মাত্রাটা ছিল নিজের থেকেও বেশি। যাইহোক, সেই মেয়েটি যার হাসি শুনেই বিমোহিত হয়েছিল সে, তার থেকেও বেশি মুগ্ধ হয়েছিল যেদিন তার নাম শুনেছিল।
নাম তার নিরূপমা। সেই নামে যেন বলে দিচ্ছে এ নামের অধিকারী কোন সাধারণ মেয়ে না বৎস!!
তবে নিরূপমা একটু বেশি দুর্বল ছিল অনুপমের প্রতি তার এই সহজপ্রবৃত্তি এর জন্য। যদিও সে বাইরে বাইরে খুব ক্ষ্যাপাতো ছেলেটাকে। তবে ভেতরে ভেতরে অনেক ভালোবাসতো ওকে।
অনুপম এসব বুঝেও না বোঝার ভান করতো। তাকে যে অনেক বড় হতে হবে জীবনে। গ্রামে মা তার কত কষ্ট করে শহরে পড়াশোনা করাচ্ছে। একটা ছোট বোন তার। কত দায়িত্ব ওর। তাই এসব ভাবে না।
নিরূপমা অনেক বার বোঝাতে চেয়েছে ওকে। গার্লস স্কুলের মেয়ে ছিল কিনা তাই ভাবটা একটু বেশি ছিল তার। সে চাইছিল অনুপম নিজে থেকেই তাকে প্রপোজ করবে। কিন্তু ভাবগতি উলটা দেখে নিজেই প্রপোজ করলো ওকে। সে কি একটা বই খুজতে লাইব্রেরিতে গিয়েছিল সে সময়। এমন পরিস্থিতিতে কি করবে না করবে ভেবে ছেলেটা হ্যাঁ/না কিছুই না বলে লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে সোজা মেসের দিকে যাত্রা শুরু করলো। মেসে এসে একা একা ভাবতে বসে গেল। না বলবে নিরুপমাকে সে??
তা কি করে হয়! সেই মনমাতানো হাসি, গহীন কালো চুলগুলো যখন বাসের জানালায় উড়ায় অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সে। আর অনুপমও চুপিচুপি ইচ্ছে করেই নিরুপমার পেছনের সিটে বসতো। বাতাসে যাতে ওর চুলের ঘ্রাণ নিতে পারে। আরো চশমা পরে ওকে একটু বেশি কিউট লাগে অন্যদের থেকে। আর এখন নিজে থেকেই যখন সে প্রপোজ করছে তখন না কিভাবে বলে! এসব ভাবতে ভাবতেই পেছন থেকে পিঠে একটা চাপড় পরলো বাধনের।
অনুপমের কাছের বন্ধু বাধন। একই ক্লাসে আর একই মেসে থাকে তারা। সে হিসেবে ভোলাভালা অনুপম সব কিছু বাধনের সাথে শেয়ার করতো। বাধন আবার ছোটবেলা থেকেই শহরে থেকে মানুষ হচ্ছে। গার্লফ্রেন্ড এর অভাব নেই ওর। সাথে যখন বাবার অঢেল টাকা থাকে। নিরুপমার ব্যাপারে বলতেই বাধন ওকে নিয়ে দুষ্টুমি শুরু করে দিল। কিন্তু অনুপম যখন ওর পরিবারের কথা তুলে ধরলো সে বললো আরে ভাই শহরের মেয়ে নিরূপমা। টাইম পাস করে কিছুদিন পর ছেড়ে দিস। অত চাপ নেওয়ার কি আছে??
কিন্তু অনুপম আমাদের খাটি গ্রামের ছেলে। শহরের মানুষের মতো প্যাচ তার মনে নেই। সে সব ভুলে নিরূপমার প্রেমে ডুবতে বাধ্য হল। এই প্রেম, বেলি চত্বরে ফুস্কা খাওয়া, খুনসুটি, হুড তোলা রিকশায় চড়ে পুরো শহর ঘুরে বেড়ানো এগুলা ছিল তাদের প্রতি শনিবারের রুটিন। কেননা অন্যান্য দিনগুলো তাদের পড়াশোনা করতেই যেত। যা কথা হতো ক্লাসেই আর কি।
নিজের পকেট খরচ চালাতে একটা টিউশন করায় অনুপম। সেদিন টিউশন থেকে আসতে একটু বেশি রাত হয়ে গেছে। শহিদ চত্বরের পেছনের রাস্তাটা একটু বেশিই নির্জন থাকে সে সময়। হাটতে হাটতে রাস্তায় এক ছেলের সাথে ধাক্কা লাগে তার। সরি বলে কাছে যেতেই দেখে বাধন। যদিও ওর গা থেকে একটা বিশ্রী গন্ধ আসছে তখন। এমন নির্জন জায়গায় অত না ভেবে বন্ধুকে দেখে বুকে সাহস পায় অনুপম।
অনুপমঃ বাধন, এই সময়ে তুই এখানে কি করিস?
বাধনঃ কই নাতো, তেমন কিছু না।
অনুপমঃ মেসে যাবি না? রাত ১০টা বাজে। চল। খালা আসছে তো আজ? নাকি আজকেও উপোস রাখবে আমাদের? হাহা।
বাধনঃ না না, রান্না হয়েছে। তুই যা। আমার কিছু শিট ফটোকপি করতে হবে।
অনুপমঃ ফটোকপিই তো। আমিও যাই চল।
বাধনঃ না না থাক। তুই কষ্ট করবি ক্যান? টিউশন থেকে আসতেছিস। মেসে গিয়ে ফ্রেশ হ যা। আমি ৩০মিনিটের মধ্যেই আসছি।
দেখতে দেখতে ফাইনাল ইয়ারে আজ তারা। এক্সাম চলে এলো। কথা বলা কমতে থাকল দুই টোনাটুনির মাঝে।কেননা ভালো একটা জব পেতে হবে অনুপমকে। ছোট বোনটার বিয়ে দিয়েই নিরূপমাকে নিয়ে সুখের ঘর বাঁধবে সে।
পড়শু থেকে ফাইনাল এক্সাম। দুইদিন বন্ধ থাকবে বলে আজ টিউশনে বাচ্চাদের একটু বেশিই পড়াতে হল ওকে। পড়া শেষে আজকেও হেটেই আসছে সে। শহিদ চত্বরের কাছে আসতেই এক যুবক কাছে এসে কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা ব্যাগ ওর হাতে গুজে দিয়েই দৌড় দেয়। হটাত ঘটনার আকর্ষিকতায় সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রাস্তার মাঝখানে। পেছন থেকে পুলিশের টহল গাড়ি এসে সার্চ করা শুরু করলো ওকে।ব্যাগে ৫০০ প্যাকেট ইয়াবা সহ বন্দী হল অনুপম মেট্রো পুলিশের কাছে। এত করে বলা শর্তেও পুলিশ তাকে চুল পরিমাণ বিশ্বাস করে নি। পরেরদিন বড় বড় পত্রিকায় তার নিউজ ছাপানো হল। মাদক পাঁচারের দায়ে অনুপমকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। আদরের ছেলের এমন সংবাদ শুনে তার মা স্ট্রোক করে সাথে সাথে মারা গেলো। ছোট বোনটি মামা বাসায় থেকে মামিদের শত অপমান সহ্য করে পড়ালেখা চালিয়ে গেল কোনরকম। নিরুপমা এরকম সংবাদ শুনে প্রচন্ড ঘৃণায় বিয়েতে বসলো এক এস.আই এর সাথে। কিন্তু, রাগের বসে বিয়ে করলেও তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে অনুপম এমন কাজ করতে পারে ভেবে।
তাই বিয়ের ১ বছর পর নিরূপমা তার স্বামীকে দিয়ে অনুপমের কেসটা রিওপেন করলো।
তার দক্ষ স্বামীর নিরলস পরিশ্রমে বেড়িয়ে আসলো শহরের পুরো মাদকচক্র। যার আসল হোতা ছিল বাধন অনুপমের প্রাণের বন্ধু!
সেই প্রথম রাতের ঘটনায় বাধনের আসোলে কোন শিট ছাপানোর কাজ ছিল না। মূলত সেদিন সে পাশের বর্ডার এলাকা থেকে চোরাই মাদক নিয়ে লোকজন সহ আসছিল। পুলিশের তাড়া খেয়ে অনুপমের সাথে ধাক্কা লাগে ওর। বাধন ভাবে অনুপম না জানি সব বুঝে ফেলে তার আগেই ওর ছেলেপেলে দিয়ে অনুপমকে পুলিশের হাতে মিথ্যা কেসে ধরিয়ে দেয়।
আজ অনুপম মুক্তি পেয়েছে। সাথে বাধন বন্দী। জেলে ঢুকার আগে কেঁদে কেঁদে বন্ধুকে এসব সত্য বলে মাফ চায় বাধন। বেস্ট ফ্রেন্ড এর থেকে এরকম একটি ঘটনার পর কি বা বলার থাকে অনুপমের। এই একটা ছোট্ট ঘটনা তার সাজানো জীবনের ইতি ঘটিয়েছে। চাইলেই কি সে পারবে তার আদোরের মাকে মা বলে জড়িয়ে ধরতে! তার নিরুপমাকে নিয়ে ঘর বাঁধতে? চুপ চাপ জেল থেকে বের হয়ে নতুন উদ্যোমে সব শুরু করলো আবার।
হ্যাঁ, অনুপম পেরেছেও খুব তাড়াতাড়ি এই ক্ষত সরাতে। গ্রাজুয়েশন শেষ করে একটা প্রাইভেট জব নেয় সে।ছোট বোনকে বিয়ে দেয়। সে যখন জানতে পারলো তাকে মুক্তির পেছনে নিরূপমার স্বামীর অনেক অবদান তখন নিরূপমার স্বামীকে ধন্যবাদ জানাতে অফিসে যায়। নিরূপমার বন্ধু সে। তাকে তাই জোর করেই বাসায় নিয়ে আসলো এস.আই সাহেব।
এস.আইঃ কই গো গিন্নী!!আরে দেখে যাও কে এসেছে??
নিরুপমাঃ এইতো রান্নাঘরে। যাচ্ছি।
এস.আইঃ দেখ তোমার বন্ধু অনুপম এসেছে। তোমার ধারণাই ঠিক ছিল। সে একদম নির্দোষ। আজই ছাড়া পেয়েছে। ওকে, ওসব কথা পরে হবে আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। গল্প কর তোমরা।
আজ টানা তিন বছর পর দেখা দুজনার। অনুপম সেই প্রথম দিনের মতো ড্যাবড্যাব করে আজো চেয়ে আছে নিরূপমার দিকে।
আর নিরূপমা… তার তো ওই হরিণি চোখ দিয়ে টপটপ করে বৃষ্টি ঝড়ছে। (সে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় একদিকে ছিল প্রেমিককে ভুল বুঝে হারানোর কষ্ট আর অন্যদিকে ছিল তার জেল থেকে মুক্তির আনন্দ)
এই বৃষ্টির পানির পেছনের ইতিহাস অজানাই রয়ে যাবে আমাদের গল্পের এস.আই স্যারের কাছে…
বিঃদ্রঃ আজকাল ভার্সিটি গুলো পড়াশোনার সাথে সাথে নেশাখোড়দের আড্ডাখানায় পরিণত হচ্ছে। আসুন ভার্সিটিতে নতুন বন্ধু মহল হতে নিজেকে ও নিজের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করি। সুন্দর জীবন যাপন করি।
যে নড়বড়ে বিশ্বাস নিয়ে ‘বিশ্বাস’ পড়তে শুরু করেছিলাম, গতিময় জীবনের সহজ-সরল উপস্থাপনায় এবং ঘটনার শৈল্পিক রচনায় তা প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো🔥
ধন্যবাদ লেখককে বিশ্বাসের মান রক্ষার্থে ‘বিশ্বাস’ উপহার দেওয়ার জন্য❤
স্বাগতম ভাই ❤️