চক্র
চোখ মেলা মাত্রই প্রচন্ড আতঙ্কে আবিরের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। একি দেখছে সে! তিনজন অদ্ভুত চেহারার মানুষ তার মুখের একদম কাছে মুখ নিয়ে চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে। মুখ তিনখানা চক্রাকারে ঘুরছে আর আস্তে আস্তে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। হঠাৎ আবিরের মনে হলে দূরে সরে যেতে যেতে মুখ তিনখানা আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আবির দ্রুত বলে উঠল –
– হেই হেই.. তোমরা কারা? কি চাও?
ঐ দূর থেকেই অদ্ভুত চেহারার মানুষ তিনজন একসাথে বলে উঠল –
-হেই হেই.. তোমরা কারা? কি চাও?
কি অশরীরীই না লাগলো এই প্রতুত্তোর!
-আমি কোথায়?
মুখ তিনখানাও একসাথে বলে উঠল
-আমি কোথায়?
যেন আবিরের কথারই প্রতিধ্বনি করল তারা। কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে তাদের তিনজনকে আর দেখা গেল না। ভোজবাজির মতো যেন মিশে গেল কোথায়! একদম অসহায় লাগতে লাগলো আবিরের।
আবির আকাশ দেখতে পাচ্ছে। তার মানে কোথাও সে একদম চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। হ্যাঁ তার তো চিৎ হয়ে শুয়ে থাকারই কথা। নদীর পাশের পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে ছিল সে। হঠাৎ প্রচন্ড ঘুমে চোখ জড়িয়ে গেল। ইচ্ছে করেও চোখ মেলতে পারছিল না। মুহূর্তেই তখন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সে।
শরীরটা খারাপ লাগছে তার। বাসায় যাওয়া দরকার। শুয়ে থাকা থেকে উঠতে যাবে এমন অবস্থায় হঠাৎ সে খেয়াল করলো- যে পার্কের বেঞ্চিতে তার শুয়ে থাকার কথা সেখানে সে নেই। সে এক রাস্তার মাঝ বরাবর এতক্ষণ চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল! অথচ তার স্পষ্ট মনে আছে বিকালে পার্কে বেড়াতে এসে তার ইচ্ছা হলো- পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে আকাশ দেখবার। শুয়ে পড়ার পরই আচমকা ঘুম চলে আসলো। তার মানে যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন পার্কের বেঞ্চিতেই ছিল। অথচ এখন দেখছে রাস্তার মাঝ বরাবর সে শুয়ে আছে। হচ্ছেটা কি এসব…
চারপাশে তাকালো আবির। রাস্তায় কোন মানুষ জন নেই। উঠে দাঁড়াতে যাবে তখন বুঝতে পারলো প্রচন্ড ক্লান্ত আর দুর্বল লাগছে তার। উঠতেও কষ্ট হচ্ছে। পানির তেষ্টায় গলা শুকিয়ে আছে। মনের অজান্তে বলে উঠলো-
-পানি.. পানি..
হঠাৎ তার বন্ধু শুভ্র কে দেখতে পেল আবির। তাকে দেখে বুকে যেন বল ফিরে পেল। পরিচিত কাউকে তো পাওয়া গেল। শুভ্রর হাতে কফির ওয়ান টাইম প্লাস্টিক এর কাপ। কাছে এসে এগিয়ে দিল। ইঙ্গিত স্পষ্ট-
-নে, খা।
এক চুমুকে কাপ খালি করল আবির। এবং সাথে সাথে আবার ঘুমে চোখ জড়িয়ে এলো। চোখ যে কোন সময় বন্ধ হয়ে যাবে আবার। অথচ এ রাস্তায় কোনমতেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তে চায় না সে। কিন্তু পারল না। আবার গভীর ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল সে।
ঘুম ভাঙার পর আতঙ্কে আবিরের শরীর ঘামতে লাগলো। আবার সেই তিনখানা অদ্ভুত চেহারার মুখ। আবার চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে সরে সরে যাচ্ছে। সবকিছুই কি আবার চক্রাকারে ফিরে ফিরে আসছে? ঐ তো আবার শুভ্রকে দেখা যাচ্ছে। কাছে আসা মাত্রই আবির শুভ্রকে অস্থিরভাবে বলল-
-দে, পানি দে।
শুভ্র প্লাস্টিকের গ্লাস এগিয়ে দিল। ঢক ঢক করে গ্লাস শেষ করার পর প্রানপনে জানতে চাইলো-
– কি হচ্ছে এসব, শুভ্র? বলবি আমাকে?
কিছু বলার আগেই আবার শুভ্রর মুখ ঝাপসা হতে শুরু করলো আবিরের কাছে। আবির আবারও তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।
এবার যখন আবিরের ঘুম ভাঙলো, চোখ মেলে ওই অদ্ভুত চেহারার কাউকে দেখতে পেল না সে। পরিষ্কার ঝকঝকে নীল আকাশ দেখতে পেল। গত দুই বারের মত ক্লান্তিও নেই। ঝরঝরে লাগছে শরীর। এদিক ওদিক তাকিয়ে খেয়াল করল সেই নদীর পাড়ের পার্কের বেঞ্চিতে সে। উঠে বসল আবির। হঠাৎ খেয়াল করলো তার পাশেই শুভ্র বসে বাদাম খাচ্ছি। নদীর দিকে সূক্ষ্ম তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
-শুভ্র, কি হচ্ছে এসব বলবি আমাকে?
অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল শুভ্র। শব্দহীন অথচ এক নির্মম হাসি।
-বলবি আমাকে প্লিজ কি হচ্ছে এসব?
-একটা খেলা খেললাম তোর সাথে। আবিরের দিকে না তাকিয়েই বললো শুভ্র। দৃষ্টি এখনও নদীর দিকেই।
-মানে?
-মানে খুব সহজ।
আবার একটা বাদাম খোসা ছাড়িয়ে মুখে পুড়ে চিবোতে লাগল শুভ্র। সেই অদ্ভুত ভঙ্গিতে আবার হেসে বললো-
– বাদাম খাবি আবির?
-রাখ তোর বাদাম। আগে বল কিসের খেলা খেললি? আমার সাথে এমন অদ্ভুত ঘটনাগুলো কেন হচ্ছিলো?
মুখের হাসি দূর করে এবার শুভ্র মুখ ঘুরিয়ে আবিরের দিকে তাকালো। থমথমে মুখে বললো-
– সবসময় ইমুলেট করা ঠিক না, বুঝলি আবির?
– মানে?
– মানে হচ্ছে, তোর স্বভাবই হচ্ছে সবাইকে অনুকরণ করে, ব্যঙ্গ করে কথা বলা।
– কি বলতে চাচ্ছিস?
-মনে কর, ঠাট্টার ছলে তুই কারো খাতা কেড়ে নিলি- অথচ সে সময় সে কোন একটা জরুরী কিছু লিখছিলো। সে বললো- খাতাটা দে, আবির। তুই ও সাথে সাথে হাসতে হাসতে বলিস- খাতাটা দে, আবির। তখন, যার খাতা নিলি- সিরিয়াস মোমেন্ট এ তোর ঐ অনুকরণ করে কথা বলাতে সে অনেক কষ্ট পায়। অসহায় বোধ করে।
– তুই কি তোর কথা বলছিস? সেদিন যে মজা করছিলাম তোর খাতা নিয়ে?
-সেদিনের কথাও বলছি আবার অন্য সবসময়ের কথাও বলছি। তুই যে কোন ইনসিডেন্ট এই এমন কথার রিপিট করিস। তোর হয়তোবা মজা লাগে এমন করতে কিন্তু যার সাথে করিস সে যে কেমন অসহায় বোধ করে সে সময়, তা তুই বুঝিস না। যেন একটু হলেও বুঝিস যে কেমন লাগে এমন করলে এর জন্যই ঐ অদ্ভুত চেহারার তিনখানা মুখ।
মাথা নিচু করে সব শুনছিলো আবির। এবার চমকে শুভ্রের দিকে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকালো।
– হ্যাঁ, ওরা আমার পরিচিত ছোট ভাই। আমিই ওদের অমন করে সাজিয়ে ওই রকম অদ্ভুত আচরণ করতে বলেছি।
– আর কফির কাপে ‘ঘুমের ওষধ’ মিশ্রিত পানি?
– এক্স্যাক্টলি।
রাগে থমথমে মুখ নিয়ে ঝটকা মেরে উঠে গেল আবির। সাথে সাথে উচ্চস্বরে হেসে উঠল শুভ্র।