কী এবং কেন?

বাংলাদেশ যেসব দিক থেকে ভারত ও পাকিস্তান থেকে এগিয়ে

গত এক দশকে বাংলাদেশ অনেক বেশি উন্নয়ন করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অনেক দিক থেকেই বাংলাদেশ প্রতিবেশী পাকিস্তান ও ভারতকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের মাথা পিছু আয় এখন ভারতের থেকে বেশি। উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার, কম বৈষম্য এবং কিছু ক্ষেত্রে ভালো সামাজিক সূচক বাংলাদেশকে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তান থেকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর এই সময়ে বাংলাদেশের মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে এইসব উন্নয়নমূলক সুখবর আগামীতে বাংলাদেশকে একটি টেকসই উন্নত রাষ্ট্রে উন্নীত করতে পথ দেখাবে। ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন সূচক ২০২১ অনুসারে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তান থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। 

চলুন জেনে আসি প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ কোন কোন ক্ষেত্রে এগিয়ে?

 

ভারত থেকে বাংলাদেশ যেসব ক্ষেত্রে এগিয়ে

 

গড় আয়ুঃ একটি দেশের গড় আয়ু থেকে বোঝা যায় সেদেশের মানুষের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের চিত্র। এবছর করা জাতিসংঘের ইউএনডিপি এর সমীক্ষা অনুসারে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৮ বছর। এর মধ্যে পুরুষের গড় আয়ু ৭১ দশমিক ২ বছর। নারীর গড় আয়ু ৭৪ দশমিক ৫ বছর। ভারতের মানুষের গড় আয়ু ৬৮ দশমিক ৮ বছর। মহিলাদের গড় আয়ু ৭০ দশমিক ৩ বছর এবং পুরুষদের গড় আয়ু ৬৭ দশমিক ৪ বছর। বোঝায় যাচ্ছে, গড় আয়ুর বিচারে বাংলাদেশ ভারত থেকে অনেক এগিয়ে।

 

শিশু মৃত্যুহারঃ ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন সূচক ২০২১ অনুসারে বাংলাদেশে বর্তমানে নবজাতকের  মৃত্যুর হার প্রতি এক হাজারে ১৫ জন এবং শিশু মৃত্যুর হার প্রতি এক হাজারে ২১ জন। পাঁচ বছরের নিম্নে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি এক হাজারে ২৮ জন। পক্ষান্তরে ভারতে নবজাতক শিশু মৃত্যুর হার প্রতি এক হাজারে ১১৩ জন। শিশু এবং পাঁচ বছরের নিম্নে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৯৯ জন।

 

টিকাদান কর্মসূচিঃ বাংলাদেশের ৯৮% শিশুই বর্তমানে জন্মের প্রয়োজনীয় টিকাদান কর্মসূচির আওতায় এসেছে এবং শিশুমৃত্যুর হার ৬৩% কমেছে। অন্যদিকে ভারতে শতকরা ১২ জন শিশুই প্রয়োজনীয় টিকাদান কর্মসূচি থেকে বঞ্চিত হয়। 

 

এইচআইভি আক্রান্তের হারঃ ভারতে প্রতি এইচআইভি আক্রান্তের হার ০.৩ শতাংশ। বাংলাদেশে এইচআইভি আক্রান্তের হার ০.১ শতাংশ। 

 

নারী মৃত্যুহারঃ ভারতে প্রতি হাজারে নারী মৃত্যুর হার ১৩৯ জন। বাংলাদেশে এই হার প্রতি হাজারে ১০৭ জন। ভারতে প্রতি হাজারে পুরুষ মৃত্যুর হার ২১৩ জন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই হার ১৪৮ জন। 

 

শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যঃ শিক্ষাক্ষেত্রে ভারতে নারী পুরুষের মধ্যে অনেক বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ নারী শিক্ষায় ভারত পিছিয়ে। শিক্ষাক্ষেত্রে ভারতের এই বৈষম্যের হার ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই বৈষম্যের হার ৩৭ দশমিক ৩ শতাংশ। 

 

কর্মসংস্থানের সুযোগঃ ভারতে মোট জনসংখ্যার ৫১ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়। বাংলাদেশে এই হার ৫৪ শতাংশ। 

 

নিরাপত্তাঃ নিরাপত্তার দিক থেকেও বাংলাদেশ ভারতের থেকে অনেক এগিয়ে। ভারতে প্রতি এক লাখে হত্যার শিকার হয় ৩ দশমিক ২ জন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ২ দশমিক ৪ জন। 

 

প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ভারতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তুহারা হয় প্রতি দশ লাখে চারশো একষট্টি জন। বাংলাদেশে প্রতি দশলাখে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তুহারা হয় মাত্র ১৩১ জন। 

 

রেমিটেন্সঃ ভারতের প্রবাসীর আয় অর্থাৎ রেমিটেন্স জিডিপির ২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই হার মোট জিডিপির ৫ দশমিক ৪১ শতাংশ।

 

দক্ষ শ্রমিকঃ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২৮.২ ভাগ দক্ষ শ্রমিক। ভারতের ক্ষেত্রে এই হার ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ।

 

মোট জাতীয় সঞ্চয়ঃ বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের বিপরীতে সঞ্চয়ের হার ২৬ শতাংশ। ভারতের ক্ষেত্রে এই হার ১৫ শতাংশ।

 

জিডিপিঃ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্য অনুসারে জিডিপির দিক থেকে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হলো বর্তমানে ২ হাজার ১৩৮ দশমিক ৭৯৪ ডলার। ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হলো ২ হাজার ১১৬ দশমিক ৪৪৪ ডলার। 

 

বাংলাদেশ যেসব দিক দিয়ে পাকিস্তানের থেকে এগিয়ে

 

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হওয়ার যৌক্তিকতা এখন স্বতঃসিদ্ধ। অর্থনীতি, মানবিক উন্নয়ন সূচক, সামাজিক উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, বৈদেশিক নির্ভরশীলতা ইত্যাদি সব দিক থেকেই পাকিস্তানকে পিছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। সেই অর্জিত বিজয়ের ৫০ বছরে অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। 

 

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভঃ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার যা পাকিস্তান দ্বিগুণ। পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৭ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। 

 

জিডিপিঃ পাকিস্তানের মাথাপিছু জিডিপি হলো ১ হাজার ৫০০ ডলার, বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হলো ২ হাজার ১৩৮ ডলার। 

 

অর্থনীতিঃ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের থেকে পাকিস্তান ৭০% বেশি ধনী ছিল। আজ বাংলাদেশ পাকিস্তানের থেকে ৪৫% বেশি ধনী। বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি পাকিস্তানের তুলনায় ২৭১ গুণ বেশি প্রবৃদ্ধি লাভ করেছে। বাংলাদেশের জিডিপি পাকিস্তানের তুলনায় আড়াই গুণ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। 

 

গড় আয়ুঃ শুধু অর্থনৈতিক নয়, ইনএনডিপির তথ্যমতে বাংলাদেশ মানব উন্নয়ন সূচকে পাকিস্তানকে অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৮ বছর। পাকিস্তানের মানুষের গড় আয়ু ৬৭ দশমিক ৬ বছর। বাংলাদেশের নারীদের গড় আয়ু ৭৪ দশমিক ৫ বছর। পাকিস্তানের নারীদের গড় আয়ু ৬৭ দশমিক ৩ বছর। পাকিস্তানের পুরুষদের গড় আয়ু ৬৫ দশমিক ৭ বছর যেখানে বাংলাদেশের পুরুষদের গড় আয়ু ৭১ দশমিক ২ বছর।

 

শিশু মৃত্যুহারঃ বাংলাদেশে বর্তমানে নবজাতকের  মৃত্যুর হার প্রতি এক হাজারে ১৫ জন এবং শিশু মৃত্যুর হার প্রতি এক হাজারে ২১ জন। পাঁচ বছরের নিম্নে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি এক হাজারে ২৮ জন। পক্ষান্তরে পাকিস্তানে নবজাতক শিশু মৃত্যুর হার প্রতি এক হাজারে ৫৫ জন। শিশু এবং পাঁচ বছরের নিম্নে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৬৬ জন। 

 

শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশঃ শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশের  দিক থেকে ৫-১৪ বছর বয়সী শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ এগিয়ে। বাংলাদেশের রেটিং ৪.১। পাকিস্তানের রেটিং ৯। 

 

শিক্ষাঃ বাংলাদেশের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার হার ১১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। পাকিস্তানের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার হার ৯৪ দশমিক ৩ শতাংশ।

 

বিদ্যুৎঃ বাংলাদেশের ৮৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ এর আওতায় এসেছে। যেখানে পাকিস্তানের মাত্র ৭১ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ এর আওতায় এসেছে। 

 

গ্রস সেভিংস জিডিপিঃ বাংলাদেশের মানুষের গ্রস সেভিংস জিডিপির পরিমাণ ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ। এরপর আছে ভারত ৩১ দশমিক ১ শতাংশ  এবং সবার শেষে পাকিস্তান, মাত্র ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ। 

 

বৈদেশিক ঋণের পরিমাণঃ বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৪০২ কোটি ডলার। সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মাথা পিছু ঋণ দাঁড়ায় ২৬৬ দশমিক ৮ ডলার, টাকার অঙ্কে যা ২২ হাজার ৬৭৮ টাকা।

পাকিস্তানে মোট সরকারি বৈদেশিক ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩৬.৪ ট্রিলিয়ন রুপি। পাকিস্তানের প্রত্যেক নাগরিকের মাথাপিছু ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার রুপি। 

 

বিগত ৫০ বছরে প্রতিবেশী ভারত পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে গিয়েছে আর্থ সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে তা সত্যিই ঈর্ষনীয়। আশা করা যায়, আগামীর বাংলাদেশ পুরো বিশ্বের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। এটাই ১৬ কোটি বাঙালীর প্রত্যাশা।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link