ইতিহাস

ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে যেভাবে

ভারতবর্ষ নামকরণ:

এশিয়া মহাদেশের মধ্যদক্ষিণে অবস্থিত ভারতবর্ষ পৃথিবীর বৃহত্তম উপমহাদেশ। বস্তুত বিশাল আয়তন, বিপুল জনসংখ্যা এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে ভারতবর্ষকে উপমহাদেশ বলা হয়। ভারতবর্ষের নামকরণ নিয়ে ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মধ্যে নানা মতদ্বৈধতা রয়েছে। একটি বর্ণনানুযায়ী প্রাচীনকালে ‘ভরত’ নামে এদেশে এক হিন্দু রাজা ছিলেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী এই রাজা ভরতের নামানুসারেই এদেশের নামকরণ হয়েছে ভারতবর্ষ। কোনো কোনো সূত্র মতে, প্রাচীন ফারসি সাহিত্যে সিন্ধু শব্দটি ‘হিন্দ’ এবং ‘সিন্দ’ এ উভয় নামে উল্লেখ করা হয়েছে। কালক্রমে সমগ্র উপমহাদেশের জন্য এ ‘হিন্দ’ নামটির প্রচলন হয়।

অন্য একটি বর্ণনায় জানা যায়, গ্রিকরা ভারত আক্রমণ করতে এসে প্রথমে সিন্ধু অঞ্চলের সাথে পরিচিত হয়ে এ অঞ্চলকে ‘ইন্ডাস’ নামে অভিহিত করেন। কালক্রমে তারা সমগ্র ভারতবর্ষের পরিচিতি হিসেবে ‘ইন্ডাস’ বা ‘ইন্ডিয়া’ নামের প্রচলন করে বলে অনেকের ধারণা। আবার সিন্ধু নদের ইংরেজি ‘ইন্ডাস’ (Indus) থেকে ‘ইন্ডিয়া’ (India) নামের উৎপত্তির কথাও কেউ কেউ বলে থাকেন। অনেকেই মনে করেন ‘হিন্দু’ শব্দ থেকেই হিন্দুস্থানের ব্যবহার। মূলত ভারতবর্ষ হিন্দুধর্মাবলম্বী, প্রধান দেশ হওয়ায় মুসলমানরা একে হিন্দুস্থান নামে আখ্যা দিয়েছিল এবং এ নামটি এখনো বহুল ব্যবহৃত হয়। মধ্যযুগের মুসলিম বিবরণীগুলোতে ভারতবর্ষকে হিন্দুদের বাসভূমি হিসেবে ‘হিন্দুস্থান’ নামে অভিহিত করা হয়েছে যা এখনও সুবিদিত। ধারণা করা হয় যে, হিন্দুদের বাসভূমি হওয়ায় এ অঞ্চলটি আজও হিন্দুস্থান নামে পরিচিত।

ভারতবর্ষের ভৌগোলিক অবস্থান

ভারতবর্ষ একটি বিশাল দেশ। রাশিয়াকে বাদ দিলে আয়তনে এটি সমগ্র ইউরোপ মহাদেশের সমান। ভারতবর্ষের উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব দিকে হিমালয় পর্বত, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, পূর্বে ব্রহ্মদেশ (মিয়ানমার), পশ্চিমে পারস্য (ইরান) ও আরব সাগর। বর্তমান বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটানের বিস্তৃত অঞ্চল এর অন্তর্ভুক্ত।

পৃথিবীর প্রায় এক-পঞ্চমাংশ লোক এ উপমহাদেশে বাস করে। ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতের জনসংখ্যা ১২৬,৭৪,০১,৮৪৯ জন। ভৌগোলিক দিক দিয়েও ভারতবর্ষ একটি বিচিত্র অঞ্চল। ভারতবর্ষের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বিন্ধ্যা পর্বত দেশটিকে দুটি অসমান অংশে বিভক্ত করেছে। বিন্ধ্যা পর্বতের উত্তর অংশ ‘আর্যাবর্ত’ বা উত্তর ভারত এবং দক্ষিণাংশ ‘দাক্ষিণাত্য’ নামে পরিচিত।

ভারতবর্ষে নৃ-তাত্ত্বিক বিবর্তন

দ্রাবিড় জাতি ভারতবর্ষের প্রাচীনতম অধিবাসী। এরপর আর্য, শক, কুষাণ ও হুনগণ পর্যায়ক্রমে ভারতে আসে। অনেকের মতে, রাজপুত, জাঠ এবং গুর্জরগণ হুন জাতির বংশধর। শুধু বহুজাতি নয়, বহুধর্ম ও ভাষাভাষী জনগণের মহামিলন ঘটেছে ভারতবর্ষে। হিন্দু ও ইসলাম ভারতের প্রধান ধর্ম। তবে বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, জৈন, শিখ, অগ্নি উপাসক ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীও রয়েছে। ভারতে বর্তমানে ২,০০০-এর অধিক উপভাষা (Dialect) প্রচলিত আছে। এ কারণেই ভিনসেন্ট স্মিথ (Vincent Smith) ভারত উপমহাদেশকে ‘নৃতত্ত্বের জাদুঘর’ (Ethological Museum) বলে অভিহিত করেছেন।

কালবিভাজন অনুযায়ী মুসলিম বিজয়ের পূর্বে হিন্দু ও বৌদ্ধ শাসনামলকে ভারতীয় ইতিহাসের ‘প্রাচীন যুগ’ বলা হয়। ভারতবর্ষে মুসলিম অভিযান ও আরবদের সিন্ধু ও মুলতান বিজয় থেকে ভারতে ‘মধ্যযুগের সূচনা হয় বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন। মুঘল শাসনের শেষ পর্যন্ত এ যুগের বিস্তৃতি।

১৭৫৭ সালের পলাশি যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ‘আধুনিক যুগের সূচনা হয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারতবর্ষে ‘পাকিস্তান’ ও ‘ভারত’ নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।

১৯৭১ সালে বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান বিভক্ত হয় এবং স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এভাবে ভারত উপমহাদেশ বর্তমানে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নামক তিনটি দেশে বিভক্ত।

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি দ্বিতীয় পত্র

আরবদের সিন্ধু এবং মুলতান বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের অবস্থা 

রাজনৈতিক অবস্থা 

আরব মুসলমানদের বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতে কোনো রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, মৌর্য সম্রাট মহারাজ অশোক (২৭৩-২৩২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ২৩২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তার মৃত্যুর পর ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য দুর্বল হয়ে পড়ে। 

কোনো হিন্দু রাজা বা রাজনৈতিক নেতা এমনকি সমুদ্রগুপ্ত (সম্ভবত ৩৩০–৩৮১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) এবং চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের (৩৮১–৪১৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) মতো খ্যাতিমান শাসকেরাও সমগ্র উপমহাদেশকে নিজেদের শাসনভুক্ত করতে পারেননি। সপ্তম শতকে সম্রাট হর্ষবর্ধন (৬০৬–৬৪৭ খ্রি.) উত্তর-পশ্চিম ভারতে একটি বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। হর্ষবর্ধনের সমসাময়িক চালুক্য রাজা দ্বিতীয় পুলকেশী সমগ্র দাক্ষিণাত্য মালভূমির ওপর তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। 

কিন্তু এ দুই মহান সম্রাটের মৃত্যুর পর ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য ভেঙে পড়ে। যোগ্য উত্তরাধিকারীর অভাবে তাদের সাম্রাজ্য ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় এবং ভারতবর্ষে অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। এ সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ছিল আফগানিস্তান, কাশ্মির, কনৌজ, দিল্লি ও আজমির, সিন্ধু, মালব, গুজরাট, বুন্দেলখণ্ড, নেপাল, আসাম, বাংলা প্রভৃতি। 

একে অন্যের ওপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা এবং শক্তি বৃদ্ধির জন্য ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকায় রাজনৈতিক ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হয়ে যায়। ঐতিহাসিক ডি. ডি. মহাজনের (V.D Mahajan) মতে, “রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেশে কোনো সার্বভৌম কর্তৃত্ব ছিল না। ভারতবর্ষ ছিল রাষ্ট্রগ্রন্থী, যার প্রতিটি রাষ্ট্র স্বাধীন ও সার্বভৌম ছিল। ২ ফলে কেন্দ্রীয় কোনো শক্তি না থাকায় এসব রাজ্যে অনৈক্য ও পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বজায় থাকায় আরব মুসলমানগণ যখন সিন্ধু বিজয়ে অগ্রসর হয় তখন তাদের বিরুদ্ধে ভারতীয়রা একটি সংহত ও সংঘবদ্ধ শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়।

READ MORE:  মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির ইতিহাস পর্ব – ২

প্রশাসনিক অবস্থা 

আরব বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় রাজতন্ত্র জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রাচীন বৌদ্ধ যুগের প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটিয়ে বংশানুক্রমিক রাজা নিযুক্তির প্রথা চালু হয়। অবশ্য রাষ্ট্রের সংকটজনক অবস্থায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজ্যে অভিজাতশ্রেণি রাজা নিয়োগ করতেন। কোথাও কোথাও সিংহাসনে নারী অধিকার স্বীকার করে নেওয়ারও প্রমাণ পাওয়া যায়। রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। 

ঈশ্বরের প্রতিভূ হিসেবে রাজা আইন প্রণয়ন, শাসনকাজ পরিচালনা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করতেন। রাজকার্য পরিচালনায় ‘মন্ত্রিজ’ এবং ‘সচিব’ নামক দু’শ্রেণির মন্ত্রী রাজাকে সহায়তা করতেন। ‘উপরিক’ পদবিধারী শাসনকর্তা প্রাদেশিক শাসন পরিচালনা করতেন । 

উত্তর ভারতে প্রদেশকে বলা হতো ‘ভূক্তি’ এবং দক্ষিণ ভারতে ‘মণ্ডল’। ‘রাষ্ট্র’ এবং ‘দেশা’ নামেও কোথাও কোথাও প্রদেশগুলো পরিচিত ছিল। বিষয় বা জেলার প্রধান কর্মকর্তার পদবি ছিল ‘বিষয়পতি’। শাসনব্যবস্থার সর্বনিম্নস্তর ছিল ‘গ্রাম’। ‘পঞ্চায়েত’ কর্তৃক গ্রামের শাসন পরিচালিত হতো।

অর্থনৈতিক অবস্থা

প্রাচীনকাল থেকেই বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ ও ঐশ্বর্যের জন্য ভারতবর্ষের বিশ্বজোড়া খ্যাতি ছিল। কৌটিল্যের বিবরণ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় আয়ের মুখ্য উৎস ছিল তিনটি, যথা: (ক) ভূমি রাজস্ব (খ) সামন্ত প্রভু ও জনগণের কাছ থেকে প্রাপ্ত কর এবং (গ) আবগারি ও বাণিজ্য শুল্ক। ভারতবর্ষ ছিল একটি কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষককে তার উৎপাদিত ফসলের এক ষষ্ঠাংশ (ছয় ভাগের এক ভাগ) রাষ্ট্রকে কর হিসেবে দিতে হতো। এ করকে বলা হতো ‘ভাগ’।

ঐতিহাসিক বিবরণ মতে, মৌর্য ও গুপ্ত যুগে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই সন্তোষজনক ছিল। এ আমলে ভারতবর্ষে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের ব্যাপক উৎকর্ষ সাধিত হয়। খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে ভারত পরিভ্রমণকারী চীনা পর্যটক ফা-হিয়েন গুপ্ত যুগে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিবরণ দিয়েছেন। তার বর্ণনা মতে, মগধের লোক সমৃদ্ধিশালী ও ধনী ছিল এবং তাদের মধ্যে সৎকাজ করার প্রবণতা ছিল।

এ যুগে বঙ্গদেশের তাম্রলিপ্তি বন্দর একটি প্রসিদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। এখান থেকে বঙ্গদেশের বণিকেরা বড় বড় জাহাজে সিংহল, মালয়, যবদ্বীপ প্রভৃতি অঞ্চলে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যাতায়াত করত। ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কে আব্দুল করিম বলেন, “আরব সাগরের উপকূলবর্তী মাকরান, সিংহল উপদ্বীপ, মাদ্রাজ উপকূল এবং বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহে আরবীয় মুসলমানদের যাতায়াত ছিল এবং তারা এ দেশের পণ্যদ্রব্যসমূহ বিদেশে চালান দিতেন।”

উল্লেখ্য যে, ভারতবর্ষ অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধ ছিল বটে, তবে সম্পদ বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে ছিল চরম বৈষম্য ও অব্যবস্থা। অভিজাতশ্রেণি ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের মধ্যে অনেক তফাৎ ছিল। সমাজের সাধারণ মানুষ যেমন— কামার, কুমার, ছুতার, স্বর্ণকার এবং কৃষকসহ শ্রমজীবী মানুষ কেবল জীবিকা নির্বাহের জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করত। আর তাদের এ পরিশ্রমের সুফল ভোগ করত অভিজাতশ্রেণির লোকেরা। তারা অত্যন্ত বিলাসবহুল জীবনযাপন করত।

সামাজিক অবস্থা 

সমসাময়িক বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজ, শিলালিপি ও চৈনিক এবং আরব পর্যটকদের বিবরণ থেকে আরব বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের সমাজজীবন সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। প্রাপ্ত তথ্য মতে, তখন ভারতের সামাজিক অবস্থা সন্তোষজনক ছিল না। সমাজে হিন্দুদের প্রবল প্রাধান্য ছিল। তবে হিন্দুসমাজে সংকীর্ণ জাতিভেদ প্রথা বিস্তার লাভ করে এবং অষ্টম শতাব্দীর প্রারম্ভে হিন্দুসমাজ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র এ চারটি বর্ণে বিভক্ত হয়ে পড়ে। চারটি বর্ণের মধ্যে সমাজে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি এবং তারা অন্যদের থেকে বেশি সুবিধা ভোগ করত। 

এ সময় ক্ষত্রিয়গণ যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং শাসনদণ্ড পরিচালনা, বৈশ্যরা ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শূদ্ররা কৃষি ও অন্যান্য সাধারণ বৃত্তি ও পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। সামাজিক পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধার বিবেচনায় বৈশ্য এবং বিশেষ করে শূদ্ররা ছিল অধঃপতিত ও অসহায়। শূদ্ররা সমাজে অপবিত্র ও অস্পৃশ্য বলে বিবেচিত হতো। মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক বলেন, “হিন্দুদের মধ্যে শ্রেণিবিভাগ নীতি নিম্নস্তরের লোকদের ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।” শূদ্রদের বেদ-গীতা পাঠ এমনকি বেদবাক্য শোনারও অধিকার ছিল না। 

সমাজে নানা রকমের ঘৃণ্যপ্রথা ও কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। বহু বিবাহ প্রচলিত থাকলেও অসমবর্ণ বা আন্তঃসাম্প্রদায়িক বিবাহ এবং বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। সহমরণ বা সতীদাহ প্রথা, নরবলি এবং গঙ্গায় শিশু সন্তান বিসর্জন ইত্যাদি অমানবিক কাজকে ধর্মীয় পুণ্যের কাজ বলে বিবেচনা করা হতো। গ্রিকদের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, মৌর্য যুগে সমাজে নারীদের মর্যাদা ছিল এবং তারা সাহিত্য দর্শনে বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী ছিল। “কিতাব-উল-হিন্দ’ গ্রন্থ প্রণেতা আল বিরুনী বৈদিক যুগে ভারতে নারী জাতির উচ্চ মর্যাদার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। 

READ MORE:  বাবরি মসজিদ: সংঘাতের ইতিহাস

তার বর্ণনা মতে, সে সময় মেয়েদের উদার শিক্ষা প্রদান করা হতো এবং তাদের শাসনক্ষেত্র ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল। তবে সম্ভবত এটি সমাজের সার্বিক চিত্র ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীদের গৃহে আবদ্ধ হয়ে থাকতে হতো এবং তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ছিল না। মৌর্য যুগে ভারতে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। এটি তখন সামাজিক অনুশাসনে পরিণত হয়। দাস-দাসী ক্রয়-বিক্রয় এবং প্রাসাদে তাদের নিয়োগ করা হতো।

ধর্মীয় অবস্থা 

প্রাক-মুসলিম ভারতে প্রধানত জৈন, বৌদ্ধ ও হিন্দু এ তিনটি ধর্ম প্রচলিত ছিল। মহাবীর নামক এক ক্ষত্রিয় সন্ন্যাসী জৈনধর্মের প্রবর্তন করেন। বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক ছিলেন গৌতম বুদ্ধ। তিনি সিদ্ধার্থ নামেও পরিচিত। তিনি বিহারের বৌদ্ধগয়ায় মোক্ষলাভ করে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। ভোগ-বিলাস ত্যাগ করে আত্মার শুদ্ধি অর্জন, জীবে দয়া এবং পুনর্জন্ম বৌদ্ধধর্মের মূলমন্ত্র। মৌর্য সম্রাট মহামতি অশোকের সময় বৌদ্ধধর্ম ভারতে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। তবে গুপ্ত শাসনামল থেকে বৌদ্ধধর্মের পতন শুরু এবং হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণ সূচিত হয়।

প্রকৃতপক্ষে মুসলিম বিজয়ের পূর্বে হিন্দুধর্মই ছিল ভারতের প্রধান ধর্ম। ভারতের অধিকাংশ রাজাই ছিলেন হিন্দু। বহু দেব-দেবীর মূর্তিপূজা হিন্দুধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য। জাতিভেদ প্রথা ছিল হিন্দুসমাজের মূলভিত্তি। পুরোহিত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ব্রাহ্মণেরা ছিল উচ্চ মর্যাদা ও ক্ষমতার অধিকারী। একই ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও বৈশ্য ও শূদ্ররা ছিল নির্যাতিত এবং নিষ্পেষিত। তাদের ধর্মীয় শাস্ত্র পাঠ এবং শোনারও অধিকার ছিল না। অধ্যাপক হাবীব বলেন, “ব্রাহ্মণগণ ইচ্ছা করে জনগণকে অজ্ঞ রাখতেন। দুর্নীতিপরায়ণ ব্রাহ্মণেরা জনসাধারণের দুর্বলতা ও ভীতির সুযোগ নিয়ে কেবল জীবিকা নির্বাহই করতেন না, নিজেদের আধিপত্যও প্রতিষ্ঠা করতেন। ড. দীনেশ চন্দ্র সেনও ব্রাহ্মণদের অত্যাচারী ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু ও মুলতান বিজয়: কারণ, ঘটনা ও ফলাফল

 

মানবমুক্তির ধর্ম হিসেবে আরবভূমিতে ইসলামের পুনঃআবির্ভাবের পর মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অনুসারী ও উত্তরাধিকারী মুসলমানগণ নতুন ধর্ম চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ধর্ম ও রাজ্য বিস্তার এবং বাণিজ্য বিকাশে বিশেষ তৎপর হয়ে ওঠে। সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে আরব মুসলমানরা বিজয় অভিযানে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় অষ্টম শতাব্দীর শুরুতে ভারতভূমিতে আরবদের বিজয় অভিযান পরিচালিত হয়। 

সিন্ধু ও মুলতান বিজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে মুসলমানদের সামরিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সূচনা হয়। আরবদের সিন্ধু ও মুলতান বিজয় অষ্টম শতাব্দীর ঘটনা হলেও ভারতবর্ষের সাথে আরবদের যোগাযোগ বহু দিনের। ইসলামের আবির্ভাবের অনেক পূর্ব থেকেই বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আরব বণিকেরা ভারতের উপকূলীয় বন্দর বিশেষ করে পশ্চিম উপকূলীয় বন্দরসমূহে যাতায়াত করত। 

তাদের মাধ্যমে ভারতীয় পণ্যদ্রব্য আরব, মধ্য এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা এমনকি ইউরোপের বাজারে পৌঁছে যেত। ইসলামের আবির্ভাবের পরও আরব মুসলিম বণিকেরা ভারতের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য অব্যাহত রাখে। আরব বণিকেরা ইসলাম প্রচারে বিশেষ কোনো তৎপরতা চালাননি সত্য, তবে তাদের যাপিত জীবন এবং তাদের সাথে আগত সুফি-দরবেশদের প্রচেষ্টায় ভারতের উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহ ইসলাম ধর্মের সাথে পরিচিত হয়। জাতিভেদ প্রথার নির্মম জাঁতাকলে নিষ্পেষিত এবং আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় নিপীড়নে অতিষ্ঠ হিন্দুগণ ইসলামের সাম্য ও শান্তির বাণীতে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। 

কোনো কোনো সূত্র মতে কালিকটের হিন্দু রাজা জামোরিনের পৃষ্ঠপোষকতা ও উৎসাহে সেখানকার নিম্নশ্রেণির বিশেষ করে মৎস্যজীবী ধীবর সম্প্রদায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এখানকার নবদীক্ষিত মুসলমানদের মাধ্যমে মালাবার ও করমণ্ডল উপকূলে ইসলামের সুমহান বাণী প্রচারিত হয়। এমনকি আরব বণিকদের সংস্পর্শে এসে মালাবারের হিন্দু রাজা চেরামন পেরুমল ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেন বলে ঐতিহাসিক আবুল কাশিম ফিরিস্তা উল্লেখ করেন।

ঐশ্বর্যপূর্ণ ভারতবর্ষের প্রতি বিশেষ আকর্ষণের কারণে মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে আরবরা ভারতে বিজয় অভিযান প্রেরণ করেছিল। মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা)-এর সময় (৬৩৪-৬৪৪ খ্রি.) মুসলমানরা ভারত জয়ের প্রথম চেষ্টা করে। কিন্তু ৬৩৬-৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে পরিচালিত অভিযান সফল হয়নি। 

খলিফা উসমান (রা)-এর সময় ৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দে আব্দুল্লাহ বিন উমরের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। খলিফা আলী (রা)-এর সময় ৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে এবং উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়ার সময় ৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে পরিচালিত অভিযানসমূহও সফলতা লাভ করেনি। পরবর্তী কয়েক বছর ভারত আক্রমণে মুসলিম বাহিনী আর উৎসাহ দেখায়নি। সম্ভবত দূরাভিযানের বিপদ এবং নানা প্রতিকূলতার জন্য ভারতে অভিযান প্রেরণ সম্ভব হয়নি।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু ও মুলতান অভিযান ( Muhammad bin Quasim’s expeditions to Sindh and Multan)

উমাইয়া খলিফা আল ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের (৭০৫-৭১৫ খ্রি.) খিলাফতলাভের সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম সাম্রাজ্যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ওয়ালিদের বিখ্যাত সেনাপতি মুসা বিন নুসায়ের সমগ্র উত্তর আফ্রিকা এবং তারিক বিন যিয়াদ স্পেন অধিকার করেন। সেনাপতি কুতায়বা বিন মুসলিমের প্রচেষ্টায় মধ্য এশিয়ায় ইসলামের বিজয় পতাকা উত্তোলিত হয়। প্রায় একই সময় পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশপাল হাজ্জাজ বিন ইউসুফের উৎসাহ ও প্রেরণায় মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে আরবরা ভারতে সিন্ধু অভিযান প্রেরণ করে।

READ MORE:  মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস । History of Liberation war

সিন্ধুর অবস্থান ও পরিচিতি:

‘চাচনামা’ গ্রন্থের তথ্যানুসারে সপ্তম শতাব্দীতে সিন্ধু ছিল ভারতের অন্যতম এক শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর রাজ্য। এ রাজ্যটির পূর্বে কাশ্মির, পশ্চিমে মাকরান, দক্ষিণে সমুদ্রোপকূল এবং উত্তরে কিকানন পর্বত মুহাম্মদ বিন কাসিম দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। সিন্ধু রাজ্যের রাজধানী ছিল আলোর এবং দেবল ছিল এ রাজ্যের প্রধান বন্দর। রাজা রায় সহিরসের সময়ও এ রাজ্যের সমৃদ্ধি সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করে। তখন রাজ্যটি ব্রাহ্মণ্যবাদ, সিস্তান, ইস্কান্দা ও মুলতান ও চারটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। মুসলিম অভিযানের সময় সিন্ধুর রাজা ছিলেন রাজা চাচের পুত্র দাহির।

সিন্ধু ও মুলতান অভিযানের কারণসমূহ (Causes of the expeditions to Sindh and Multan)

মুসলিম ইতিহাসে আরবদের সিন্ধু ও মুলতান বিজয় এক যুগান্তকারী ও চমকপ্রদ ঘটনা। রমেশচন্দ্র মজুমদার মুসলমানদের সিন্ধু ও মুলতান বিজয়কে পরবর্তী যুগের ওপর স্থায়ী প্রভাব বিস্তারকারী ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনাসমূহের অন্যতম বলে অভিহিত করেছেন। আরবদের সিন্ধু ও মুলতান অভিযানের পিছনে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ এ দু’ধরনের কারণই কার্যকর ছিল।

পরোক্ষ কারণ

প্রথমত: আরবদের সিন্ধু ও মুলতান বিজয় ছিল উমাইয়াদের সম্প্রসারণবাদী রাজ্যবিস্তার নীতিরই অংশ। বস্তুত খলিফা আল ওয়ালিদ এবং তার পূর্বাঞ্চলীয় শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ উভয়েই ছিলেন মনে-প্রাণে স্বাম্রাজ্যবাদী। রাজ্যবিস্তারের স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা তাদেরকে সিন্ধু আক্রমণে প্ররোচিত করে। ড. অতুলচন্দ্র রায় বলেন, “ভারতের বাইরে সামরিক সাফল্য আরবদের রাজ্যগ্রাসী করে তুলেছিল এবং ভারত আক্রমণের পশ্চাতে তাদের লক্ষ্য ছিল রাজ্যবিস্তার করা”; দ্বিতীয়ত: ধন-সম্পদ ও ঐশ্বর্য-বৈভবে সমৃদ্ধ ভারতবর্ষের সাথে স্মরণাতীতকাল থেকে আরবদের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল।

ইসলামের আবির্ভাবের পরও এ যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। ভারতের ধনৈশ্বর্য লাভ করার জন্য মুসলিম খলিফাগণ ইতঃপূর্বে বেশকিছু অভিযান প্রেরণ করেন। অষ্টম শতকের সূচনাতে মেকরান এবং বেলুচিস্তান আরবদের হস্তগত হয়। এ বিজয়ের মাধ্যমে তাদের যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হয় তাতে তারা আরও প্রলুব্ধ হয় এবং নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রত্যাশায় সিন্ধু ও মুলতানে অভিযান পরিচালনা করে; তৃতীয়ত: উমাইয়া সম্প্রসারণবাদী নীতির ফলে ইতঃপূর্বে মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমা বেলুচিস্তান ও মেকরান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

সিন্ধুরাজসহ ভারতীয় রাজন্যবর্গের মুসলিমবিরোধী বৈরী মনোভাব ও সামরিক উস্কানি মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল; চতুর্থত: মুসলমানদের পারস্য অভিযানকালে সিন্ধুরাজ সৈন্য দিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে পারসিকদের সহযোগিতা করেছিলেন। সিন্ধুরাজের এ কাজের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মুসলমানরা সিন্ধু ও মুলতান আক্রমণ করে, পঞ্চমত: খলিফা ওয়ালিদের পূর্বাঞ্চলীয় শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছিলেন অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির।

তাঁর কঠোর শাসনের প্রতিবাদে বিদ্রোহী হয়ে কতিপয় আরব সীমান্ত অতিক্রম করে সিন্ধুরাজ দাহিরের নিকট আশ্রয় নেয়। হাজ্জাজ তাদের ফেরত পাঠানোর দাবি জানালে দাহির তা প্রত্যাখ্যান করেন। এতে হাজ্জাজ রাজা দাহিরকে সমুচিত শাস্তিদানের লক্ষ্যে সিন্ধু ও মুলতান অভিযান পরিচালনা করেন; ষষ্ঠত: সিন্ধু ও মুলতান অভিযানের পিছনে ধর্মীয় অনুপ্রেরণারও বিশেষ ভূমিকা ছিল বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন।

তবে সিন্ধু ও মুলতান অভিযানের প্রত্যক্ষ ও অপরাপর পরোক্ষ কারণ বিশ্লেষণ করলে ধর্মীয় উদ্দেশ্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না। তবে প্রাথমিক যুগে বিজেতা আরবদের বিজিত অঞ্চলে ইসলাম বিস্তারের প্রচেষ্টা ধর্তব্যে আনলে সিন্ধু বিজয়ের পিছনে ধর্মীয় উদ্দেশ্যকে উপেক্ষা করার উপায় থাকে না, সপ্তমত: ‘চাচনামা’ এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য সূত্র থেকে জানা যায় যে, মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে দাহির এবং তাঁর ভাই দাহারসিয়ারের মধ্যে রাজ্য ভাগ, রাজা দাহিরের কুশাসন এবং রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ফলে রাজ্যটি দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রতিবেশী কাশ্মিরের সাথে সংঘাতে সিন্ধুর রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ প্রেক্ষাপটে সাফল্যের সম্ভাবনায় আরব মুসলমানগণ সিন্ধু ও মুলতান অভিযানে উৎসাহিত হন।

প্রত্যক্ষ কারণ

সাম্রাজ্যবাদী শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ উপর্যুক্ত কারণসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে সিন্ধু আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তখন একটি ঘটনা তাঁকে সিন্ধু রাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সুযোগ এনে দেয়। আর এ ঘটনাটি হলো সিন্ধুর দেবল বন্দরে জলদস্যু কর্তৃক মুসলমানদের ৮টি জাহাজ লুণ্ঠন। জানা যায় যে, সিংহলের রাজা আটটি উপঢৌকনপূর্ণ জাহাজ খলিফা ওয়ালিদ ও হাজ্জাজের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন।

কোনো কোনো ঐতিহাসিকের বিবরণ অনুযায়ী সিংহলে বাণিজ্যরত মৃত আরব বণিকদের পরিবার-পরিজনও জাহাজগুলোতে ছিল। যাত্রাপথে জাহাজগুলো সিন্ধুর দেবল বন্দরে উপস্থিত হলে সেগুলো জলদস্যু কর্তৃক লুণ্ঠিত হয়। হাজ্জাজ রাজা দাহিরের নিকট এর প্রতিকার ও ক্ষতিপূরণ দাবি করলে দাহির সে দাবি প্রত্যাখ্যান করেন । দাহিরের ঔদ্ধত্যে ক্ষুব্ধ হয়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সিন্ধু ও মুলতান অভিযানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *