সালামি কি হারাম?
সাধারণত ছোটর পক্ষ থেকে বড়কে দিলে তা হাদিয়া বা উপহার। আর বড়র পক্ষ থেকে ছোটকে দিলে তা ‘আতিয়া’ বা উপঢৌকন তথা ভেট বা প্রীতি উপহার। আতিয়া বা উপঢৌকনের একটি অংশ হলো সালামি।
উপহার ও সালামি
সাধারণত ঈদের চান্দে ও বিশেষ অনুষ্ঠানে ছোটরা বড়দের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে, সালাম বা কদমবুসি করে এবং বড়রা ছোটদের টাকা বা অন্য কোনো বস্তুসামগ্রী উপহার দেন, একে সালামি বলা হয়। আকিকা অনুষ্ঠানে, সুন্নতে খতনা বা মুসলমানি অনুষ্ঠানে যে শিশুর আকিকা বা খতনা, সে আগত অতিথিদের সালাম করে, এতে অতিথিরা তাকে টাকা বা কোনো বস্তু উপহার দেন, একেও সালামি বলা হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানে বা বউভাত অনুষ্ঠানে বর বা কনে অভ্যাগত মেহমানদের সালাম করে থাকেন। এতে অতিথিরা টাকা বা অন্য কোনো সামগ্রী উপহার দিয়ে থাকেন, এটিও সালামি নামে পরিচিত। হাদিস শরিফে আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা হাদিয়া বা উপহার দাও, তোমাদের মধ্যে প্রীতির বন্ধন দৃঢ় হবে।’ (তিরমিজি)।
উপহার কোনো ঋণ বা পাওনা নয়
হাদিয়া বা উপহার একটি সুন্নত বিষয়। এর জন্য কোনো উপলক্ষের প্রয়োজন যেমন নেই, তেমনি নেই কোনো অনুষ্ঠান বা উপলক্ষে এর বাধ্যবাধকতাও। হাদিয়া বা উপহারের পরিমাণ বা মূল্যমান বড় বিষয় নয়। কারণ, প্রকৃত উপহার লৌকিকতানির্ভর নয়; বরং হাদিয়া বা উপহার হলো আন্তরিকতার বিষয়। আন্তরিকতা ছাড়া লৌকিক উপহার নিষ্প্রাণ দেহসম। লৌকিকতা ছাড়া আন্তরিক উপস্থিতি, শুভেচ্ছাবিনিময় ও শুভকামনা শ্রেয়তর। তাই হাদিয়া বা উপহারসামগ্রীর কারণে আমাদের বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে সানন্দ উপস্থিতি যেন বিঘ্নিত না হয়। আল্লাহ তাআলা আল-কোরআনুল করিমে বলেন, ‘উত্তম বাক্য ও ক্ষমাপ্রার্থনা ওই দান অপেক্ষা শ্রেয়তর, যে দানের পর কষ্ট অনুগামী হয়। আল্লাহ মহা ধনবান ও চিরপ্রশংসিত।’ (সুরা: ২ বাকারা, আয়াত: ২৬৩)।
উপহার কোনো বিনিয়োগ বা ঋণদান নয়। যিনি কাউকে কোনো উপলক্ষে উপহার বা হাদিয়া দিলেন, তাঁর কখনো এমন আশা পোষণ করা সমীচীন হবে না যে ওই ব্যক্তি আমার বা আমাদের কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে অনুরূপ হাদিয়া বা উপহার দেবেন। উপহার বা হাদিয়া কোনো পাওনা বিষয় নয় যে কেউ না দিলে মন খারাপ করতে হবে।
হাদিয়া বা উপহার দেওয়ার জন্য বিশেষ কোনো পর্ব বা উপলক্ষ জরুরি নয়। যখন খুশি তখন যাকে ইচ্ছা তাকে যেকোনো পরিমাণ হাদিয়া বা উপহার দেওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা তাদের সম্পদ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করে, অতঃপর খোঁটা বা তুলনা দিয়ে এবং কষ্ট দিয়ে তার অনুগমন করে না। তাদের জন্য তাদের রবের কাছে রয়েছে তাদের বিনিময়, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।’ (সুরা: ২ বাকারা, আয়াত: ২৬২)। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘খোঁটাদানকারী বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (মুসলিম)।
উপহার ও দাওয়াত
আমাদের দেশে দাওয়াতের বিভিন্ন ধরন বিদ্যমান রয়েছে। এসব দাওয়াতে আমরা উপহার দিয়ে থাকি, তবে একে বাধ্যতামূলক বা জরুরি মনে করা যাবে না। উপহার, উপঢৌকন ও হাদিয়া ছাড়া মেহমান এলে তাকে অবজ্ঞা বা অবহেলা এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যাবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে এবং কিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে, তারা যেন তাদের অতিথিদের সম্মান করে।’ (তিরমিজি শরিফ)। আর অতিথির হক বা অধিকার হলো তিন দিবস, তিন রজনী। ষোলো আনার দাওয়াত হলো পরিবারের সবার দাওয়াত। সাধারণত কোনো অনুষ্ঠানে ষোলো আনার দাওয়াত না হলে পরিবারের প্রধান বা যেকোনো একজন দাওয়াতে অংশগ্রহণ করে থাকেন। আজকাল এই ষোলো আনার দাওয়াতকে সপরিবারে দাওয়াত বলা হয়। এ ধরনের অনুষ্ঠানে শরিয়তের সীমা লঙ্ঘিত না হলে বা সাংস্কৃতিক সীমা অতিক্রম না করলে কোনো দোষ নেই।
শিশুদের উপহার ও মালিকানা
উপহার ও সালামি প্রাপকের প্রধান অংশ হলো শিশু। জন্মের পর থেকে শিশু পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও নানাজনের কাছ থেকে উপহার পেয়ে থাকে। শিশুর উপহারসামগ্রীর মালিকানাও শিশুরই। তাই শিশুর মালিকানার কোনো বস্তু, তা খেলনা হোক বা পোশাক, টাকাপয়সা হোক বা ধনসম্পদ; কোনো অবস্থাতেই শিশুর অনুমতি বা সম্মতি ছাড়া কাউকে দেওয়া যাবে না। যেসব জিনিস শিশুর ব্যবহারের অনুপযোগী তা কাউকে দিতে হলে তার বিক্রয়মূল্য ধার্য করে তা শিশুর জন্য সঞ্চয় হিসেবে রাখতে হবে। অথবা শিশু সাবালক হওয়ার পর সব বিষয় তাকে অবগত করিয়ে তার পক্ষ থেকে দানের অনুমোদন নিতে হবে। শিশুদের সালামির টাকা তাদের জন্য ভবিষ্যৎ সঞ্চয় হিসেবে রাখাই বিধেয়। তবে পরিবার অসচ্ছল হলে ওই অর্থ শুধু ওই শিশুর জন্যই ব্যয় করতে পারবে। পুনরায় সচ্ছলতা ও সামর্থ্য এলে তাকে তা ফেরত দিতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা অনাথ শিশুদের সম্পদের কাছেও যেয়ো না; বরং সৎ উদ্দেশ্য ছাড়া; যত দিনে তারা যৌবনে সামর্থ্যে দৃঢ়তায় পৌঁছায়।’ (সুরা: ৬ আনআম, আয়াত: ১৫২ ও সুরা: ১৭ ইসরা, আয়াত: ৩৪)।
উপহার ও আনুষ্ঠানিকতা
হাদিয়া বা উপহার যেমন কোনো অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত বা শর্তযুক্ত নয়, তেমনি কোনো অনুষ্ঠানে বা উপলক্ষে হাদিয়া বা উপহার নিষিদ্ধও নয়। কিন্তু হাদিয়া বা উপহারকে অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করা যেমন অন্যায়, তেমনি একে বিনা কারণে নিবারণচেষ্টারও প্রয়োজন নেই। অনুষ্ঠান হলেই উপহার দিতে হবে, অনুষ্ঠান না হলে উপহারও দেওয়া যাবে না, বিষয়টি মোটেও এমন নয়।
হাদিয়া বা উপহার হতে পারে স্মৃতিস্মারক, হতে পারে প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য বস্তু, হতে পারে জীবনচলার সহায়ক। হাদিয়া বা উপহার কী হবে তা দাতার ইচ্ছা, রুচি ও সামর্থ্যের ওপরেই নির্ভর করে। কিন্তু যাকে হাদিয়া বা উপহার দেওয়া হবে, তার প্রয়োজনীয়তা, চাহিদা ও রুচি বিবেচনা করাও বাঞ্ছনীয়। কারণ, উপহারসামগ্রীর মালিকানা ও ব্যবহারকারী তিনিই হবেন, যিনি বা যাঁকে কেন্দ্র করে উপহার দেওয়া হয়েছে।