আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব যা বিশ্ব তোলপাড় হয়ে গিয়েছিলো
আচ্ছা বলুনতো আপনি বড় নাকি ছোট? বোকা হয়ে গেলেন তো? আচ্ছা এবার বলুন আপনি আপনার ভাই থেকে বড় নাকি ছোট, এখন অবশ্য বুঝতে পেরেছেন।
কোনো কিছুর অবস্থা বা বৈশিষ্ট্য কেমন তা বলার জন্য অন্য কিছুর সাথে তুলনা করতে হয়। তুলনা করার মত কোন কিছু না থাকলে বস্তুর অবস্থা বর্ণনা করা যায় না। কোন কিছুর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার জন্য যার সাথে তুলনা করা হয় তাকে বলা হয় রেফারেন্স ফ্রেম বা প্রসঙ্গ কাঠামো। জেনারেল রিলেটিভিটি কিংবা স্পেশাল রিলেটিভিটি আলোচনার ক্ষেত্রে এর রেফারেন্স ফ্রেম বিষয়টির স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। তাছাড়া গতি, স্থিতি, সময় ইত্যাদি ক্ষেত্রেও রেফারেন্স ফ্রেমের প্রয়োজন পড়ে। এমনকি এ রেফারেন্স প্রসঙ্গ কাঠামো আমাদের জীবনের অনেক অনুভূতির সাথেও সম্পৃক্ত। যেমন যদি আমি প্রশ্ন করি আপনি ভালো আছেন?এই উত্তর হ্যাঁ না দুরকমই হতে পারে। বিষয়টি নির্ভর করবে আপনি নিজেকে কার সাথে তুলনা করেছেন অর্থাৎ আপনি রেফারেন্স হিসেবে কি বিবেচনা করেছেন! যে মানুষটি স্টেশনে ঘুমায় তাকে রেফারেন্স হিসেবে বিবেচনা করলে আপনি ভালো আছেন আবার বিলাসবহুল আর অট্টালিকায় থাকা মানুষকে রেফারেন্স হিসেবে বিবেচনা করলে আপনি ভালো নেই।
যাইহোক এখন মূল বিষয় জেনারেল রিলেটিভিটি অর্থাৎ সাধারণ আপেক্ষিকতার বিষয়ে আসা যাক।
আলবার্ট আইনস্টাইন ছিলেন খুবই প্রখর কল্পনা শক্তি সম্পন্ন একজন মানুষ। তিনি বলেছিলেন, কোন একজন মানুষ ছাদ থেকে পড়ে যাচ্ছে এটা ভাবতে আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। এমন মর্মান্তিক একটি কল্পনা কেন আইনস্টাইনের ভালো লাগতো! এই কল্পনা ছিল মূলত একটি হট এক্সপেরিমেন্ট অর্থাৎ চিন্তার মাধ্যমে পরীক্ষা।
আইনস্টাইন ভাবতেন একজন মানুষ ছাদ থেকে পড়ে গেলে কি ঘটবে বেশিরভাগ মানুষের মনে একটি মর্মান্তিক চিত্র ভেসে উঠবে। কিন্তু আইনস্টাইন যত প্রখর কল্পনা শক্তি সম্পন্ন ছিলেন বলে তিনি বিষয়টিকে ভিন্নভাবে চিন্তা করেন। আইনস্টাইন নিজেকে ওই পড়ে যাওয়া ব্যক্তির স্থানে কল্পনা করেন এবং মাটিতে পড়ে যাবার আগে পর্যন্ত অর্থাৎ পড়ন্ত অবস্থায় সম্পূর্ণ দৃশ্যপট কেমন হবে তা কল্পনা করেন। তিনি যখন পড়ন্ত অবস্থায় থাকবেন তখন তার ওপর শুধুমাত্র গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স অর্থাৎ মহাকর্ষ বল কাজ করবেন। এবং প্রতি সেকেন্ডে তার বেগ 9.8 মিটার করে বৃদ্ধি পাবে মাটিতে আঘাত করার আগে পর্যন্ত। আইনস্টাইনের দৃষ্টিকোণ থেকে পড়ে যাবার সময় যদি বাতাসের ঘর্ষণ না থাকে তবে পড়ন্ত ব্যক্তির অবস্থার সাথে স্পেসে ওজনহীন অবস্থার কোন পার্থক্য থাকবে না কিন্তু আমাদের কাছে মনে হবে ব্যক্তিটি মাটিতে পড়ে যাচ্ছে।
কেন আমাদের কাছে মনে হবে ব্যক্তিটি পড়ে যাচ্ছে!
এর জন্য প্রথমেই উল্লেখ করা রেফারেন্স ফ্রেম বিষয়টি সামনে আসে। এখন আপনি নিজে একটু ভেবে দেখুন তো, আশেপাশে বিল্ডিং যদি না থাকতো কিংবা ব্যক্তিটি যে পড়ে যাচ্ছে এটি তুলনা করার জন্য যদি কোন রেফারেন্স ফ্রেম না থাকতো তবে আপনি কি বুঝতে পারতেন ব্যক্তির পড়ে যাচ্ছে? আপনার কাছে কিন্তু তখন মনে হতো ব্যক্তিটি ভেসে বেড়াচ্ছে। অর্থাৎ মুক্তভাবে পড়ন্ত অবস্থা এবং স্পেস কিংবা মহাকাশ স্টেশনে ভাসা অবস্থার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
আর এই ধরনের ইভেন্টের মাধ্যমে নিউটনের রহস্যময় গ্রেভিটিকে ভিন্নভাবে বর্ণনা করা সম্ভব। একটি ছোট ঘর কল্পনা করুন যাতে জানালা নেই। সেই ঘরে ধরা যাক আপনার ওজন 80 কেজি এখন এই একই রকম একটি ঘর কল্পনা করুন যেটি স্পেসশিপের ভেতরে রয়েছে এবং স্পেসশিপ 9.8 ms2 সমত্বরনে আপওয়ার্ড ডিরেকশনে গতিশীল। এই অবস্থায় আপনি আপনার ওজন মাপলে কি দেখলেন আপনি পৃথিবীর মতোই আপনার ওজন দেখবেন 80 কেজি। অর্থাৎ আপনাকে যদি বলা না হয় যে আপনি স্পেসশিপের ভেতরে রয়েছেন তবে কিন্তু আপনি বুঝতে পারবেন না যে আপনি পৃথিবীতে রয়েছেন নাকি স্পেসশিপের ভেতর রয়েছেন। উল্লেখিত স্পেসশিপ এবং পৃথিবীতে থাকা এই দুইটি অবস্থার মধ্যে পার্থক্য বের করার কোনো সুযোগ নেই। আইনস্টাইন ২ অবস্থার কিভাবে পার্থক্য করা যায় তা ভাবতে থাকেন।
আইনস্টাইন ভাবেন কি ঘটবে যদি স্পেসশিপের মধ্যে থাকা ঘরে টর্চ লাইট অন করা হয়! স্বাভাবিকভাবেই টর্চ লাইটের আলো ঘরের দেয়ালে পড়বে। এখন যদি আমাদের কাছে যদি খুব সেনসিটিভ মেজারমেন্ট টুলস থাকে তবে আমরা দেখতে পাবো যে আলোক উৎসের উচ্চতা এবং দেয়ালে আলোর উচ্চতার সমান নয়। আলো কিছুটা বেঁকে যাবে, কারণ স্পেসশিপ উচ্চ গতিতে ডিরেকশনে গতিশীল কিন্তু পৃথিবীতে তো আমরা এমনটা লক্ষ করি না। যেখানে বলা হচ্ছে 9.8 ms-2 ত্বরনে গতিশীল ওই স্পেসশিপ এবং পৃথিবীতে থাকার বিষয়টি একি বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন অর্থাৎ একই বিষয়।
পৃথিবীতে এই এক্সপেরিমেন্ট করার ক্ষেত্রেও আলো বেকে যাবে। এই বেঁকে যাওয়া খুবই সামান্য যা সাধারণভাবে লক্ষ্য করার কোন সুযোগই নেই। কিন্তু কেন পৃথিবীতে আলো বেকে যাবে? পৃথিবীতে আর স্পেসশিপের মত আপন ডিরেকশনে গতিশীল নয়। আমরা জানি আলো সবসময় একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে সবচেয়ে কম দূরত্বের পথ বেছে নেয়। এমনটাই যদি হয় তাহলে টর্চলাইট থেকে আলো দেয়াল পর্যন্ত সরলরেখায় যাওয়া উচিত, কারণ এটিই হচ্ছে সবচেয়ে কম দূরত্বের পর কিন্তু প্রকৃত অর্থে বা বাস্তবেতো তা ঘটছে না।
তখন আইনস্টাইন ভাবেন আলো অবশ্যই সবচেয়ে কম দূরত্বের পথে যাবে তবে হয়তো সরলরেখা বা স্ট্রেট লাইন সবসময় কম দূরত্বের নয়। পৃথিবীর ক্ষেত্রে চিন্তা করুন, পৃথিবীর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সবচেয়ে কম দূরত্বের পথ কিন্তু সরলরেখা বা স্ট্রেট লাইন নয়, কারণ পৃথিবী পৃষ্ঠ তল সমতল নয় এটি হচ্ছে বক্রতল। এবং বক্রতলের ক্ষেত্রফলের লাইন সবচেয়ে কম দূরত্বের পথ হয়। তখন তিনি ভাবেন, গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষের মূল কারণ হচ্ছে স্পেসের বেঁকে যাওয়া বা স্থানের বেঁকে যাওয়া। ভারী বস্তুর জন্য হয়তোবা স্পেস বেকে যায়, যার কারণে সবচেয়ে কম দূরত্ব বেকে গিয়ে বক্রপথ হয়ে যায়।
তবে স্পেসের বেঁকে যাওয়ার বিষয়টি ম্যাথমেটিক্যালি প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজন ছিল খুবই জটিল বক্রতলের জ্যামিতি। যার ফলে আইনস্টাইন তার কলেজ সময়ের বন্ধু ম্যাথমেটিশিয়ান গ্রোসম্যান এর সাথে যোগাযোগ করেন। বক্রতলের জ্যামিতি কে বলা হয় রিমেনিয়ান জিওমেট্রি। সাধারণত আমরা জানি, ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি 180 ডিগ্রী। কিন্তু বক্রতলের ক্ষেত্রে,ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি 180 ডিগ্রি হবেনা, 180° থেকে বেশি অথবা কম হবে। এটি নির্ভর করবে বক্রতল টি কেমন তার উপর।
আইনস্টাইন তার বন্ধুর সাহায্য নিয়ে স্পেস বেঁকে যাওয়ার ম্যাথ সমাধান করেন। এবং অবশেষে 1915 সালে তার জেনারেল রিলেটিভিটি প্রকাশ করেন। জেনারেল রিলেটিভিটি অনুযায়ী দুটি বস্তুর মধ্যে কোন প্রকার গ্রেভিটি অর্থাৎ মহাকর্ষ বল কাজ করে না। বা অন্যভাবে বললে মহাকর্ষ আসলে কোন বল নয় গ্র্যাভিটি ইজ নট এ ফোর্স । কোন বস্তু অন্য বস্তুর চারদিকে ঘুরে স্পেস বেঁকে যাওয়ার কারণে।
বস্তুর চারদিকে স্পেস বস্তুর কেন্দ্র বরাবর বেকে যায় এবং কতটা দিকে যাবে বা কি পরিমাণ বেঁকে যাবে সেটা নির্ভর করে বস্তুর ভরের উপর।
এখানে কাপড়কে স্পেস ভাবুন। এবার দেখুন বলের মত ভারী বস্তু টি কিভাবে কাপড় কে বাকিয়ে দিচ্ছে অর্থাৎ স্পেস কে বাকিয়ে দিয়েছে। এখন এই কাপড়ের উপর কোন বস্তুকে আপনি সরলপথে ছুড়ে মারলে এর গতিপথ বেঁকে যাবে এবং ভারী বস্তুর চারদিকে ঘুরতে থাকবে। এখানে একটি বিষয়, বস্তুটি কাপড়ের উপর দিয়ে চলার সময় ধর্ষণের কারণে শক্তি হারাচ্ছে। ফলে একসময় মাঝখানে থাকা বস্তুর উপর পতিত হচ্ছে কিন্তু গ্রহ-উপগ্রহ এসবের ক্ষেত্রে এই ঘর্ষণ বলের মান খুবই খুবই সামান্য। যাইহোক তারমানে প্রত্যেক বস্তু সরলরেখা বরাবর চলে। এখন এই সরলরেখা-ই যদি ভরের কারণে বেঁকে যায় তখন বস্তুর গতিপথও বেকে যায় এবং এইজন্যই গাছ থেকে আপেল উপরে না গিয়ে মাটিতে পড়ে।
মনে করুন, দুইজন ব্যক্তি পৃথিবীর বিষুবীয় অঞ্চল থেকে মেরুর দিকে সরলরেখা বরাবর যাত্রা শুরু করলো। যাত্রা শুরু করার পর যতই সময় অতিবাহিত হবে ব্যক্তির দুইজন কিন্তু তথ্যই কাছাকাছি চলে আসবে যদিও তাদের মধ্যে কোন ফোর্স কাজ করছে না। তেমনি একটি বস্তুর চারদিকে অন্য বস্তু ঘুর্ণনের কারনও এটি। বস্তুটি শুধুমাত্র সরল পথ অনুসরণ করে গতিশীল থাকছে। এবং এই সরলপথ মূলত অন্য কোনো ভারী বস্তুর কারণে বেঁকে যাচ্ছে।
আইনস্টাইন তার এই জেনারেল রিলেটিভিটি প্রকাশ করার পর অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হন। কারণ তিনি নিউটনের মহাকর্ষ বলকে অস্বীকার করছেন। যদিও আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটির মাধ্যমে অর্থাৎ স্পেস বেকে যাওয়ার মাধ্যমে বুধ গ্রহের গতিপথ নিখুত ভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল। যা নিউটনের মহাকর্ষ বল দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। কিন্তু তারপরেও অনেক বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের এই নতুন ধারনার উপর আস্থা রাখতে পারছিলেন না। অবশেষে জেনারেল রিলেটিভিটি প্রকাশের চার বছর পর জেনারেল রিলেটিভিটি এর সত্যতা নিশ্চিত ভাবে প্রমানিত হয়।
1919 সালে সূর্য গ্রহনের সময় স্টার বা তারার ছবি তোলা হয়। সূর্য গ্রহন ছাড়া এই পরীক্ষা করা সম্ভব ছিল না কারণ সূর্যের উজ্জ্বলতা কারণে তারার ছবি তোলা সম্ভব ছিল না। যাইহোক আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটি সঠিক হলে, সূর্যের কাছের তারার অবস্থা তার প্রকৃত অবস্থার পরিবর্তে অন্যস্থানে দেখা যায়। কারন তারা থেকে আলো পৃথিবীতে আসার সময় সূর্যের আশেপাশের স্পেস দিয়ে আসবে। সূর্যের ভরের কারণে সূর্যের আশপাশের স্পেস বেঁকে যাবে। যার ফলে আলো সে বক্রপথ অনুসরণ করে বেকে যাবে, যার ফলে তারা কে তার প্রকৃত অবস্থানে না দেখিয়ে অবস্থানে দেখা যাবে। এবং পর্যবেক্ষণে ঠিক সেটাই দেখা গেল যা, আলবার্ট আইনস্টাইন কে রাতারাতি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা এনে দেয়।
তবে জেনারেল রিলেটিভিটি সম্পর্কে জন উইলার সবচেয়ে সুন্দর এবং চমৎকার দুটি লাইন বলেন,
অর্থাৎ স্থান-কাল বস্তুকে বলে, কিভাবে চলতে হবে,,,বস্তু স্থান-কালকে বলে, কিভাবে বাকা হতে হবে। এই দুটি লাইন হচ্ছে জেনারেল রিলেটিভিটি এর সারকথা।
আপনারা হয়ত একটি বিষয় খেয়াল করেছেন সম্পূর্ণ লিখাতেই আমি স্থান বেকে যাওয়ার কথা বলেছি, কিন্তু বিষয়টি প্রকৃত অর্থে হচ্ছে স্পেস-টাইম কার্ভেচার বা স্থান-কালের বক্রতা। অর্থাৎ স্থান বেকে যাওয়ার সাথে সাথে টাইম বা সময় প্রবাহেও পরিবর্তন আসবে।
এবং সময়ের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসলে তখন আর এটিকে জেনেরেল রিলেটিভিটি বলা যাবেনা তখন একে বলা হবে স্পেশিয়াল রিলেটিভিটি বা বিশেষ আপেক্ষিকতা।
সম্ভব হলে বিশেষ আপেক্ষেকতা নিয়ে অন্য আরেকদিন আলোচনা করবো।