ইতিহাস

কৃষকদের জন্য অভিশপ্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চুক্তির ইতিহাস

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হলো বৃটিশ আমলে প্রবর্তিত এমন একটি আইন যা দ্বারা সেকালে জমিদাররা অনেক লাভবান হয় এবং একইসাথে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের পথ সুগম হয়। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনটি ছিল বাংলার কৃষকদের জন্য অভিশাপ। আমরা আজকের দিনে সাহিত্যে জমিদার পরিবারের দ্বারা যে কৃষক লুণ্ঠনের চিত্র দেখতে পাই তার সূচনা হয়েছিল ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চুক্তির মধ্যে দিয়ে। 

 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হল এক ধরণের ভূমি রাজস্ব বা কর ব্যবস্থা। ১৭৯৩ সালে, লর্ড কর্ণওয়ালিস বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় এই ব্যবস্থা চালু করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হচ্ছে কর্নওয়ালিস ও বাংলার ভূমি মালিকদের মধ্যে সম্পাদিত একটি স্থায়ী চুক্তি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন লর্ড কর্ণওয়ালিস।

 

চুক্তির ফলে জমিদারগণ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভূ-সম্পত্তির নিরঙ্কুশ স্বত্বাধিকারী হন। জমির স্বত্বাধিকারী ছাড়াও তারা চিরস্থায়ীভাবে অপরিবর্তনীয় এক নির্ধারিত হারে জমিদারিস্বত্ব লাভ করেন। নিম্মে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণ ও ফলাফল বর্ণনা করা হল।

 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণ

 

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৭৬৫ সালে প্রথম দেওয়ানি লাভ করে। কিন্তু দ্বৈত শাসন, একশালা বন্দোবস্ত, পাঁচশালা বন্দোবস্ত ইত্যাদি ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলেও যখন আশানুরুপ রাজস্ব সংগ্রহ হচ্ছে না, তখন ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিস বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করেন। রাজস্ব ছাড়াও আরো বিভিন্ন কারণে কর্ণওয়ালিস এই ব্যবস্থা নেয়। যেমন, 

 

১. বাজেট তৈরির সুবিধা: প্রতি বছর সুনিশ্চিত রাজস্ব সংগ্রহ হলে সরকারের পক্ষে বার্ষিক আয়-ব্যয়ের বাজেট তৈরির কাজ সহজ হবে। 

 

২. কৃষি ও কৃষকের উন্নতি: জমিতে স্থায়ী অধিকার পেলে জমিদাররা কৃষি ও কৃষকের উন্নতির জন্য চেষ্টা করবে। এতে দেশের সমৃদ্ধি বাড়বে এবং পরােক্ষভাবে কোম্পানিরই লাভ হবে।

 

৩. কোম্পানীর সমর্থক গোষ্ঠীর উদ্ভব:  চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের মাধ্যমে ভারতে ইংরেজদের একটি নতুন অভিজাত সমর্থক গোষ্ঠীর উদ্ভব হবে।

 

 ৪. নির্ধারিত আয়ের যোগান: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করলে কোম্পানী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব পাবে। যার ফলে তাদের আয়ের অনিশ্চিয়তা দূর হবে।

 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এর ফলাফল 

 

১. বছরের শেষে চড়া রাজস্ব শােধ করা অনেক জমিদারের পক্ষেই সম্ভব হত না। ফলে, সূর্যাস্ত আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিন অতিক্রান্ত হওয়া পর বহু জমিদার তাদের জমিদারি হারান। এইভাবেই বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারির অবসান ঘটে।

 

২. চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিভিন্ন পর্যায়ে ইজারাদার, দর ইজারাদার পত্তনিদার প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের মধ্যস্বত্বভােগীর উদ্ভব ঘটে। কোম্পানির সঙ্গে জমিদারের যেমন চুক্তি হত তেমনি জমিদারদের সঙ্গেও মধ্যস্বত্বভােগীদের চুক্তি হত।

 

৩. চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে। মধ্যস্বত্বভােগী সুদখাের ও মহাজনরা মিলে গ্রামীণ কৃষিজ অর্থনীতিকে একবারে সর্বশান্ত ও পঙ্গু করে দেয়।

 

৪. মধ্যস্বত্বভােগীরা অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের নামে কৃষক প্রজাদের ওপর ব্যাপক অত্যাচার শুরু করে। ফলে কৃষকরা বাধ্য হযয়ে মহাজনশ্রেণির কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে টাকা পরিশোধ করত। কিন্তু মুনাফা ও আসল মিলিয়ে মােট দেনার পরিমাণ যা দাঁড়াত তা কখনােই কৃষক প্রজারা শােধ করতে পারত না। ফলে মহাজনরা তাদের সর্বস্ব গ্রাস করে নিত।

 

৫. সূর্যাস্ত আইনে যেসব জমিদার জমিদারি হারান, তাদের জমিদারি ক্রয় করে নতুন এক জমিদার শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঢাকার নবাব পরিবার, রানাঘাটের পালচৌধুরী পরিবার প্রভৃতি যারা কোম্পানীর পৃষ্ঠপোশকতা করত।

 

৬. জমিদারদের জমি বিক্রয়, বন্ধক, দান ইত্যাদি অবাধে হস্তান্তরের অধিকার দেওয়া হয়।

তবে, প্রজা বা রায়তদের জমি বিক্রয়, বন্ধক, দান ইত্যাদির অধিকার দেওয়া হয়নি।

 

৭. জমিদারগণ নির্ধারিত তারিখে কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে সকল জমি নিলামে বিক্রয় করা হবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়।

 

৮. চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সবথেকে বেশি ক্ষতি হয় কৃষক। কারণ জমির ওপর জমিদাররা মালিকানা স্বত্ব পেলেও কৃষকরা তা পায়নি। জমিদার তাদের খেয়ালখুশি মতাে কৃষক প্রজাকে তার জমি থেকে উৎখাত করতে পারতেন।

 

৯. জমিদারেরা অধিক খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে কৃষকদের শােষণ করতে থাকে। ফলে কৃষক সমাজে ক্ষোভ ও অসন্তোষ জন্মায়। পরিণতিতে, উনিশ শতকে সংঘটিত হয় একের পর এক কৃষকবিদ্রোহ।

 

১০. জমিদারগণ ভূ-সম্পত্তির নিরঙ্কুশ স্বত্বাধিকারী হন। ফলে, আরও বেশি করে কৃষিব্যবস্থায় মূলধন বিনিয়ােগ করে কৃষিকাজের সম্প্রসারণ ঘটানাের সম্ভব হয়েছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link