হঠাৎ দেখা… – মোঃ রিয়াজুর রহমান রিয়াজ
২৮শে ফেব্রুয়ারি,২০২১
সারাদিন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পরছে।মা কে ডক্টর দেখিয়ে শহর থেকে বাসায় ফিরছি। দূরপাল্লার বাস বলে হয়তো বাসের পরিবেশটা ঠিক আছে। নাহলে এদেশের লোকাল বাসের যা অবস্থা। একে তো দুপুর তার উপর বৃষ্টি, সব যাত্রী দেখি ঘুমে ব্যস্ত। মা কে জানালার সাইডে দিয়ে আমি ডানপাশে বসে শক্ত করে হাতটা ধরলাম তার।বড্ড দূর্বল হয়ে পরেছেন তিনি। একটানা বিশ্রামহীন সারাজীবন যে খেটেই গেছেন আমাদের জন্য। বাবার মতো গরীব ঘরের ছেলেকে বিয়ে করেছেন বলেই হয়তো আজ এ অবস্থায় পরতে হয়েছে।বড্ড ভালোবাসতো কিনা বাবাকে, তাই হয়তো সবকিছু নিয়তি ভেবেই থেকে গেছে।অন্য মহিলা হলে কবেই ছেড়ে চলে যেত!
হায়রে ভালোবাসা!! যে সয় তার রয়।আহ।।এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চোখ পরে পাশের সিটের একজোড়া পিপাসু চোখের উপর। একদৃষ্টিতে সেই চাহনি আমাকে গিলে খাচ্ছে অবিরাম।মুখ ঢাকা,পুরাদস্তুর বোরখায় ঢাকা বদন।।কিন্তু কেন!!একটা অচেনা মহিলা এভাবে তাকায় থাকবে??
হ্যাঁ, চিনেছি সে অপরিচিতা না।তবে পরিচিতের মধ্যেই অপরিচিত একজন এখন। সেই চোখ,সেই ভ্রু,সেই পলকহীন চাহনি কি করে ভুলি আমি??হরিণের মতো মায়াবী বললেও সে চোখের দাম কমে যাবে বুঝি।ঠিক যেন বিশাল আকাশে জ্বলজ্বল করা দুই নক্ষত্র।শরীর স্বাস্থ্য আগে শুটকি ছিল আর একটু খালি মোটা না না স্বাস্থ্যবান মনে হচ্ছে এখন এই যা পার্থক্য । একসময় এই নক্ষত্রজোড়াই যে বড্ড জ্বালাতো এই অবুঝ বালকটাকে।অবাক হয়ে চেয়ে থাকতো আমার পানে।আমার অত্যাধিক লজ্জার কারণে আমি বেশিক্ষণ তাকাতে পারতাম না তার পানে।তবে হ্যাঁ, তারেই ফাঁকেই আমিও তার ওই অবাক চাহনিতে ডুব দিতাম।একটুক্ষণের জন্য হলেও লোকলজ্জা ভুলে হারিয়ে যেতাম দুইজন দু’জনের চোখে।সে হারানোতে একটা অন্যরকম ভালোলাগা ছিল। ভালোবাসাও ছিল।হয়তো সাথে ছেরে যাওয়ার ভয়টাও ছিল!
কি জানি কি হয়ে গেল তার বাসা থেকে হুট করেই তাকে বিয়ে দিল এক বড়লোক সরকারী চাকরিজীবীর সাথে।তার কোলে আর একটা ছোটবোন ছিল।সেই জন্য বিয়েটা বুঝি একটু বেশি জলদি হয়ে গেছে।
আমার তখন ভার্সিটি লাইফের আরো এক বছর বাকি।সেই সময় বাবা-মা,ছোটবোন এদের কথা ভেবে অন্যকিছু আর চিন্তাও করতে পারি নি।
ছেলে সরকারি চাকরি করে-অনেক সুখেই থাকবে হয়তো বুচকিটা(ভালোবেসে বুচকি ডাকিতাম কিনা।যদিও সে পছন্দ করতো না এই নাম,তবে বারণও করতো না)
হয়তো সুখেই আছে।ঘোর ভাঙ্গলো সেই পরিচিত সুরে যদিও আজ বড্ড অপিরিচিত তাহা প্রথমে মনে হল…
সেঃকেমন আছো??
আমিঃহুম ভালোই।আপনি?
আপনি বলাতে হয়তো একটু বিব্রত হল।হোক তাতে কি!!অন্যের বউকে তো আর তুমি বলা যায় না।(তবে সে জেদ বেশিক্ষণ ধরে থাকতে পারলাম না)
আম্মুর দিকে তাকিয়ে(আম্মু ততক্ষণে ঘুমাচ্ছে) সেঃআন্টি??
ঃহুম।
ঃতাকে নিয়া কোথায় গেছলে?
ঃঅসুস্থ একটু। ডক্টর দেখাতে নিয়ে গেছলাম।
ঃরংপুর ছেড়ে ঢাকা কেন?? আর ডক্টর কি বলল?
ঃঢাকায় কাজ ছিল আরো।ওখানেই অসুস্থ হয়ে গেছে।চিন্তার কিছু নাই।বাতের ব্যাথা৷ কিছুদিন রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।
ঃও আচ্ছা।কাকে বিয়ে করেছো যে ঠিকঠাক যত্ন নেয় না আন্টির?
ঃহাহাহাহা….
ঃহাসার কি হল??
ঃবিয়েই তো করলাম না এখনো।তা তোমার কি খবর?
ঃএ কথা শুনে কিছুটা হতাশার আভা ভেসে উঠলো তার চোখে।পাশের সিটে বসা ছোট্ট ফুটফুটে ২ কি ৩ বছরের একটা মেয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।
আমিঃতোমার মেয়ে!!বাহ অনেক কিউট তো।পুরাই তোমার মতো হয়েছে।(আজ আল্লাহ চাইলে এরকম একটা মেয়ে শুধু ওর না হয়ে হয়তো আমাদের হতে পারতো)
সেঃআমি কিউট না আগে ছিলাম, আর না এখন আছি।(অভিমান এখনো ধরে আছে বুঝলাম)
আমিঃহাহাহাহা।কে বলেছে??
সেঃসেটা আমার থেকে তোমার ভালো জানার কথা!!
আমিঃওওও…(ক্ষ্যাপানোর জন্য প্রায় ওকে পেত্নি বলতাম কিনা।কিন্তু সত্যিকার অর্থেই একটা মেয়ে যে এতটা কিউট হয় তা ওকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না,অন্তত আমার চোখে এখন পর্যন্ত সে তাই)
আমিঃতা মেয়ের কি নাম রাখছো?
সেঃরিয়ানা।অন্য নাম তখন আর মাথায় আসে নাই।তাই এটাই রাখছি।(বলেই মুখ ঘুরায় নিল।বুঝলাম-শখের বসে যে নামটা আমাদের বাচ্চার রাখার কথা ছিল সেটা ও ভুলে নাই।মূলত দুজনের নামের আদ্যাক্ষর দিয়েই সেই নামটা পছিন্দ করেছিল)
তা তোমার স্বামীকে দেখছি না??
সেঃ ছুটি পায় নি ও এখনো।পরের সপ্তাহে আসবে।
(ফুড ভিলেজ আসতেই আইস্ক্রিমের দোকান দেখে ওর মেয়ে -আম্মু আইস্ক্রিম, আম্মু আইস্ক্রিম বলে কাঁদতে লাগলো।
সে যতই থামাতে চাচ্ছে থামছেই না।)বড্ড জেদি মেয়ে।আর বইলো না।
আমি ঃমা যেমন মেয়েও তো তেমন হবেই।আম্মুকে দেইখো একটু।আমি আইস্ক্রিম আনছি ওর জন্য।বলেই নেমে গেলাম ও কিছু বলার আগেই।(জানতাম বারণ করবে তাই আগেই নেমে গেলাম বাস থেকে)
(বৃষ্টি কিছুটা কমে গেছে।ওর আর ওর বাচ্চার জন্য দুইটা চকবার নিলাম।ওর খুব পছন্দের ছিল কিনা।আর আম্মু বাসে কিছু খায় না তাই নিলাম না কিছু ওনার জন্য)
কিচ্ছুক্ষণ পর..
আমিঃএই যে রিয়ানা আম্মু তোমার আইস্ক্রিম।(রিয়ানা ড্যাবড্যাব করে আমার পানে চেয়ে হয়তো ভাবছে কে এই আনকেল।হাহাহাহা)
সেঃদুইটা আনলে ক্যান?
আমিঃতোমার জন্য একটা আর একটা তোমার মেয়ের জন্য।আর কে বা আইস্ক্রিম খায় এখানে!!
সেঃআইস্ক্রিম খেতে ভালো লাগে না এখন আর।।
আমিঃও আচ্ছা।তাহলে রিয়ানাই খাবে নাহয় পরে।বড়লোকের বউ বলে কথা।যে শহরে মানুষ বদলে যায় সেখানে পছন্দ তো বদলাবেই।তা সংসার জীবন কেমন যাচ্ছে?হাহাহাহা।
সেঃজীবনে কি একটুও সিরিয়াস হবে না!!
আমিঃযে কারণে সিরিয়াস হতাম সেই যখন নাই….যাই হোক।আমার উত্তর দিলা না কিন্তু? (তাকে বোঝাতে পারি না যে তার চলে যাওয়ার পর এই নকল হাসিটাই একমাত্র সঙ্গী আমার)
সেঃকি বললে?? হ্যাঁ। আছি ভালোই।(এ কথা বলাতেই তাহার নক্ষত্রজোড়া যেন জ্বলজ্বল করে উঠলো)
তুমি কি করছো এখন?
আমিঃএকটা প্রাইভেট কোম্পানিতে আছি।বেতন মোটামুটি ভালোই।তাই সরকারির জন্য অত ভাবছি না
সেঃ বিয়ে কর নাই কেন এখনো!!অন্তত আন্টির কথা ভেবেও তো করতে পার?
আমিঃআর বিয়া।কিছুদিন আগে ছোটবোনটার বিয়ে দিলাম।সরকারি চাকরি না হলে তো ভালো মেয়ে পাওয়া ভার আজকাল।হাহা।
কথাটা গায়ে লাগলো তার মনে হয়।
সেঃআন্টির এই অবস্থায় একজন থাকা খুব জরুরি। বিয়েটা করে নাও জলদি(জ্ঞান দেওয়াটা ছাড়ে নাই এখনো।মনে মনে)
আমিঃঅন্য কেউ যে আর এ হৃদয়ে জায়গা দখল করতে পারবে না।অযথা কি লাভ অচেনা কোন মেয়েকে কষ্ট দিয়ে!!(বিরবির করে কইলাম।জানি না কথাটা কর্ণগোচর হল কিনা তার)
এই রংপুর, রংপুর।কন্ট্রাক্টর এর চিল্লানি…
সেঃথাকো তাহলে। আমি এখানেই নামব।
(একমুহূর্তের জন্য হলেও মনে হল এত দীর্ঘ রাস্তাটাও আজ আমার সাথে ছলনা করল নাকি??এত তাড়াতাড়ি রংপুর এসে গেল??)
আমিঃএখানে কেনো??
সেঃগতবছর এখানে আমরা ফ্লাট নিছি একটা।ছুটিতে এখানেই থাকি।আর যাওয়ার আগে দুইদিন মা-বাবার সাথে দেখা করে চলে যাই।
আমিঃওও আচ্ছা।।তাহলে তোমার তো মনের সব আশায় আল্লাহ পূরণ করাইছে দেখি।আলহামদুলিল্লাহ।। ভালো থেকো।আম্মু ভালো থেকো তুমিও(ওর মেয়ের উদ্দ্যেশ্যে) ।টাটা।।যাও
(আমার পড়াশোনা শেষ হয় নি তখনো, সরকারী জব তো দূরে কথা।ওদিকে ওর বাবা-মা সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া মেয়ে দিবে না।ওর ইচ্ছা ছিল আমার পড়া শেষে জব নিয়ে ওকে বিয়ে করে রংপুরে বাসায় উঠতে।মাত্র তো আর এক/ দেড় বছর অপেক্ষার পালা তখন।খুব উচ্ছ্বসিত ছিল সে আমাদের বিয়ে নিয়ে।সাজানো ছোট্ট একটা সংসারের স্বপ্ন সেই দেখাতো সব।এ করবে, সে করবে কত কি প্লান!!কিন্তু হঠাৎ… যাক ওসব কথা)
সেঃতুমিও ভালো থেকো।বাই
আমিঃওও হ্যাঁ।। হুম।
যেতে যেতে পার্টস থেকে কি যেন বের করল।।ও রুমাল।ওর মায়াবী চোখজোড়া মুছতে মুছতে বাচ্চাকে রেখেই নিচে নেমে গেল।কি মেয়েরে বাবা।আমার রাগ বাচ্চার উপর ঝাড়লো।(নাহ পরে বুঝলাম বাচ্চাকে আমার জন্য রেখে গেল যাতে একটু নয়নভরে দেখতে পারি)
বাচ্চাটাকে কনট্রাকটর হাত ধরে নামায় দিতেই কপালে এই প্রথম আবার শেষবারের মতো একটু চুমু দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কনট্রাকটর এর হাতে দিয়ে বললাম মামা নেন।।মা -মেয়ের চলে যাওয়া গেটে দাড়িয়ে যতদূর সম্ভব দেখলাম।।এখনো কাঁদছে হয়তো সে।বারবার চোখে হাত দিতে দেখা গেল কিনা।
একটা বড় রকমের কালবৈশাখী ঝড় বয়ে গেল বুক দিয়ে।এসে দেখি আম্মুর ঘুম ভেঙে গেছে এতক্ষনে। আর দুই স্টেশন পর আমাদের নামতে হল।। তার হাত ধরে নেমে এলাকার ভ্যান খুঁজতে লাগলাম।
আম্মুঃমেয়েটা কে ছিল রে?
আমিঃকোন মেয়ে? ও বাসে?আমার বান্ধুবী।
আম্মুঃএই সেই মেয়ে??
আমিঃ আরে কোন মেয়ে, কিসের মেয়ে।তুমিও না।।তোমার ছেলের কি বান্ধুবীর অভাব আছে??
ভ্যানচালকের উদ্দেশ্য: ও মশিয়ার ভাই,,ভালোই হইলো এইরাতে একটা ভ্যান পাইলাম শেষ মেস।বাড়িত যাইবেন না??চলেন।।(জীবনে সব প্রশ্নের উত্তর দেতি চাইলেও কেন জানি সম্ভব হয়ে ওঠে না।বুঝলাম আমার চোখ জোড়াও ভিজে ভিজে লাগছে কেন জানি।আমি কাঁদছি নাকি আবার!!নাহ একদম না।”আমার তো হৃদয় বলে কিছুই নাই”,৫বছর আগে যখন আমি ওকে নিয়া পালিয়ে যেতে না করলাম তখন সে এটাই বলে চলে গিয়েছিল।.. এই একটা কথাই আজো ভাবায়…আসোলেই হয়তো আমার হৃদয় বলে কিছু নাই।নাহলে এরকম একটা নিষ্পাপ মেয়েকে কেউ কষ্ট দিতে পারে??)
উপর আল্লাহর বড়ই অদ্ভুত বিচার। যে জিনিসগুলা থেকে মানুষ পালিয়ে বেড়ায় সেসবই কখন, কাকে, কোথায়, কিভাবে যেনো মেলায় দেন সেটা তিনিই ভালো জানেন…
লেখক,
মোঃ রিয়াজুর রহমান রিয়াজ
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়