কারবালার ইতিহাস সংক্ষিপ্ত | History Of Karbala
কারবালার (Karbala) ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে একটি মর্মান্তিক অন্ধকারময় অধ্যায়। কারবালার প্রান্তরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.) কে। দিনটিকে আশুরা বলা হয়। এদিনই এই নির্মম ঘটনা ঘটে।
পৃথিবীর শুরুলগ্ন থেকেই ১০ মহররম অর্থাৎ আশুরা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে আসছে। তবে ৬১ হিজরির ১০ মহররম কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর মর্মান্তিক শাহাদাত বরণ মুসলিম সমাজের হৃদয়কে আজও ভারাক্রান্ত করে।
ইরাকের ফোরাত নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত কারবালা (Karbala) মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। এই জনপদ প্রসিদ্ধিলাভ করেছে জান্নাতে যুবকদের নেতা, প্রিয় নবী (সা:)-এর প্রিয় নাতি এবং জান্নাতে নারীদের নেত্রী হজরত ফাতেমাতুজ জেহারা (রা:)-এর দ্বিতীয় পুত্র হজরত ইমাম হুসাইন (রা:)-এর সপরিবারে শাহাদতের মর্মান্তিক ঘটনাকে স্মরণের জন্য।
হযরত ইমাম হোসাইন (রা:) সত্য ন্যায় ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজে প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন কোনো কোরবানিই বৃথা যায় না।
এই মর্মান্তিক ঘটনার সূত্রপাত যেখান থেকে শুরু হয়, তাহলো- বিশ বছর খলিফা হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনার পর হিজরির ৬০ সালে হজরত মুয়াবিয়া (রা.) ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে বসরার শাসনকর্তা হযরত মুগিরার প্ররোচণায় মুয়াবিয়া তাঁর জেষ্ঠ্য পুত্র ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মনোয়ন দিয়ে যান। এই নিয়োগ ইসলামের গণতান্ত্রিক নিয়মের পুরোপুরি বহির্ভূত ছিল। ইয়াজিদ ছিলেন নিষ্ঠুর প্রকৃতির, মদ্যপ, ধর্মে অবিশ্বাসী এক ব্যক্তি। যার কারণে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এটিকে ভালোভাবে মেনে নেয়নি।
পক্ষান্তরে মদিনা ও কুফার জনগণ ইমাম হোসাইন (রা.) কে খলিফা হিসেবে দেখতে চেয়েছে। এরই এক সময় কুফার লক্ষাধিক মানুষ ইমাম হোসাইন (রা.) কে পত্র প্রেরণ করেন। এই পত্রে তারা দাবি জানান, সুন্নাহ পুনর্জীবিত এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে অবিলম্বে তার দায়িত্ব গ্রহণ করা প্রয়োজন।
যদিও এ সময় হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াজিদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ইরাক থেকে চলে গিয়ে মক্কা-মদিনায় অবস্থান করছিলেন। মদিনায় অবস্থানরত সাহাবিগণ এবং ইমাম হোসাইনের আপনজনরা এ সময় ইমামকে কুফায় যেতে বারণ করেন। কারণ তারা আশঙ্কা করছিলেন, ইয়াজিদের পক্ষ থেকে বাধা আসলে ইরাকবাসীরা ইমাম হোসাইনের পক্ষ ত্যাগ করবে।
কুফাবাসীর ডাকে সাড়া দিয়ে হযরত হোসাইন (রা.) তার চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে ইরাকের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠান। আর বলে দেন, যদি সে পরিস্থিতি অনুকূল দেখে এবং ইরাকবাসীদের অন্তর সুদৃঢ় ও সুসংহত মনে হয় তাহলে যেন তাঁর কাছে দূত প্রেরণ করে।
মুসলিম ইবনে আকিল কুফায় পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে ১৮ হাজার কুফাবাসী তার কাছে এসে ইমাম হোসাইনের পক্ষে বাইয়াত গ্রহণ করে এবং তারা শপথ করে বলে, অবশ্যই আমরা জানমাল দিয়ে ইমাম হোসাইনকে সাহায্য করব।
তখন মুসলিম ইবনে আকিল ইমাম হোসাইন (রা.)-এর কাছে পত্র পাঠিয়ে জানান যে, কুফার পরিস্থিতি সন্তোষজনক, তিনি যেন আগমন করেন। এই সংবাদের ভিত্তিতে ইমাম হোসাইন (রা.) তার পরিবারের ১৯ জন সদস্যসহ প্রায় ৫০ জন সঙ্গী নিয়ে কুফার উদ্দেশে রওনা হন। যুলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখে হোসাইন (রা:) মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন।
এই খবরে ইয়াজিদ উত্তেজিত হয়ে কুফার গভর্ণর নোমান ইবনে বশিরকে (রা.) পদচ্যুত করে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে কুফার দায়িত্ব প্রদান করেন। ইমাম হোসাইন (রা.) যেন কোনোভাবেই কুফায় প্রবেশ করতে না পারে সে নির্দেশও দেন ইয়াজিদ।
ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ কুফায় পৌঁছে সেখানকার জনগণকে কঠোর হস্তে দমন করে এবং মুসলিম বিন আকিলকে হত্যা করে। এরপর ইমাম হোসাইনকে (রা.) প্রতিরোধ করতে চার হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী প্রেরণ করে।
পরিবার ও সঙ্গীদের নিয়ে ইমান হোসাইন (রা.) ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে পৌঁছালে ইবনে জিয়াদের বাহিনী তাদের অবরোধ করে ফেলে।
এ সময় হোসাইন (রা.) বললেন, আমি তো যুদ্ধ করতে আসিনি। তোমরা আমাকে ডেকেছ বলে আমি এসেছি। এখন তোমরা কুফাবাসীরাই তোমাদের বাইয়াত পরিত্যাগ করছ। তাহলে আমাদের যেতে দাও, আমরা মদিনায় ফিরে যাই অথবা সীমান্তে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি। অন্যথায় ইয়াজিদের কাছে গিয়ে তার সঙ্গে বোঝাপড়া করি। কিন্তু হযরত হোসাইন (রা.) কে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে আদেশ দেয় ইবনে জিয়াদ। ঘৃণা ভরে এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন ইমাম হোসাইন (রা.)।
মহররমের ১০ তারিখ সকাল থেকে ইবনে জিয়াদের নেতৃত্বে প্রায় ৪ হাজার ইয়াজিদ বাহিনী হোসাইন (রা.)-এর ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। হোসাইন (রা.) সাথীদের নিয়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকেন। এই যুদ্ধে একমাত্র ছেলে হজরত জায়নুল আবেদিন (রহ.) ছাড়া পরিবারের শিশু, কিশোর ও নারীসহ সবাই একে একে শাহাদাতের বরণ করেন।
মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ইমাম হোসাইন একাই লড়াই চালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত নির্মম ও নির্দয়ভাবে ইমাম হোসাইনকে শহীদ করা হয়। শিমার বিন যুল জাওশান নামক এক পাপিষ্ঠ তার মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
শাহাদাতের পর ইমাম হোসাইন (রা.)-এর ছিন্ন মস্তক বর্শা ফলকে বিদ্ধ করে এবং তাঁর পরিবারের জীবিত সদস্যদের দামেস্কে ইয়াজিদের কাছে প্রেরণ করা হয়। ইমামের খণ্ডিত মস্তক দেখে ইয়াজিদ ভীত ও শঙ্কিত হয়ে পরে।
ইয়াজিদের এই জয়লাভ বেশি দিন টিকে থাকেনি। মাত্র চার বছরের মধ্যে ইয়াজিদের মৃত্যু হয়। এর কয়েকদিনের মধ্যে মৃত্যু হয় ইয়াজিদ পুত্রের। কারবালার এই মর্মান্তিক হত্যায় জড়িত প্রতিটি ব্যক্তি কয়েক বছরের মধ্যেই মুখতার সাকাফির বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়। এরপর ইয়াজিদের বংশের কেউ শাসন ক্ষমতা লাভ করেনি।
ইমাম হোসাইন (রা.) আজও বেঁচে আছেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে। তার ত্যাগ যুগের পর যুগ মুসলিম বিশ্ব শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে স্মরণ করবে।
আশুরার দিনে সৃষ্ঠ আরও কিছু ঘটনা: সৃষ্টির আদিকাল থেকে যুগে যুগে বিভিন্ন নবী-রাসূলের জীবনে নানা রকম ঘটনা ঘটেছে।
আল্লাহ হজরত মুহাম্মদ (সা:)-এর নূর মোবারক সৃষ্টির মাধ্যমে যেদিন সৃষ্টি জগতের সূচনা করেন সেদিন ছিল আশুরা।
পৃথিবীতে যেদিন প্রথম বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছিল সেদিন ছিল আশুরা।
মানব জাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ:)-এর দেহে প্রাণ সঞ্চারিত করেছিলেন সেদিন ছিল আশুরা।
হজরত আদম (আ:)-এর তত্তবা যেদিন আল্লাহ কবুল করেছিলেন সেদিন ছিল আশুরা।
হজরত নূহ (আ:) মহা প্লাবনের সময় ৪০ দিন ভাসমান থাকা অবস্থায় কিস্তি থেকে যুদী পাহাড়ের চূড়ায় সদলবলে যেদিন অবতরণ করেছিলেন সেদিন ছিল আশুরাভ
যেদিন হজরত ইবরাহীম (আ:) নমরুদের অগ্নিকুণ্ডু থেকে আল্লাহর রহমতে মুক্ত হয়েছিলেন সেদিন ছিল আশুরা। আল্লাহ তায়ালা আগুনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন : হে আগুন, তুমি ইবরাহীমের জন্য শান্তিপ্রদ শীতল হয়ে যাও।
হজরত মূসা (আ:) যেদিন বনী ইসরাইলের কয়েক হাজার মানুষকে ফেরাউনের কারগার থেকে মুক্ত করে লৌহিত সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন সেদিন ছিল আশুরা।
হজরত আইয়ূব (আ:) ১৮ বছর কঠিন রোগে ভোগার পর সেদিন আল্লাহর রহমতে রোগমুক্ত হয়েছিলেন সেদিন ছিল আশুরা।
হজরত ইউনুস (আ:) চল্লিশ দিন মাছের পেটে থাকার পর আল্লাহর রহমতে যেদিন দজলা নদীর তীরে অবতরণ করেছিলেন সেদিন ছিল আশুরা। এমনিতরো অসংখ্য ঘটনার সরব সাক্ষী আশুরা।
প্রিয় নবী (সা:) ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে আল্লাহর নির্দেশে মক্কা মোকাররমা থেকে হিজরত করে মদীনা মনোয়ারায় এসে জানতে পারলেন, মদীনার ইয়াদিরা আশুরাতে সিয়াম পালন করে।
তিনি তাদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা আশুরাতে সিয়াম পালন করো কেন? তারা জানালেন তাদের নবী হজরত মুসা (আ:) ফেরাউনের কবল থেকে হাজার হাজার বনি ইসরাইলকে উদ্ধার করে যেদিন লৌহিত সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন সেদিন ছিল আশুরা। হজরত মুসা (আ:) কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ এবং মুক্তির দিবস হিসাবে আশুরাকে সিয়াম পালন করতেন তারই অনুসরণে আমরাও আশুরায় সিয়াম পালন করি।
প্রিয় নবী (সা:) তাদের এই কথা শুনে বললেন, মুসা (আ:)-এর ওপর তোমাদের যতটুকু অধিকার রয়েছে আমার তার চেয়ে বেশি অধিকার রয়েছে। এর প্রায় সাত মাস পর ১০ মহররমে তিনি আশুরার সিয়াম পালন করলেন। তার অনুসরণে সাহাবায়ে কেরামও এই সিয়াম পালন করলেন।
এর কয়েক মাস পর আল্লাহ তায়ালা রমজান মাসকে সিয়ামের জন্য নির্ধারণ করে দিয়ে সিয়াম বিধান নাজিল করেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন : রমজান মাস নাজিল হয়েছে মানুষের হেদায়েতের জন্য। সৎপথে সুস্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী আল-কোরআন। অতত্রব তোমরা যারা এই মাস পাবে তারা এই মাসে সিয়াম পালন করবে।
রমজান মাসে সিয়াম বিধান নাজিল হওয়ার ফলে তা পালন করা ফরজ হয়ে গেল আর আশুরার সিয়াম নফল সিয়াম হিসাবে পরিণত হলো। নফল সিয়ামের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ নফল সিয়াম হচ্ছে আশুরার সিয়াম।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, কারবালায় ইমাম হোসাইন (রা:) সপরিবারে শাহাদাতের ঘটনা যেদিন ঘটেছিল সেদিন ছিল ১০ মহররম বা আশুরা। কারবালা সেদিন ছিল ধু ধু মরু প্রান্তর বর্তমানে সেখানে গড়ে উঠেছে এক অত্যাধুনিক নগরী। প্রতিদিন হাজার হাজার জিয়ারতকারীর সমাবেশ ঘটে কারবালায়। তারা হজরত ইমাম হোসাইনের (রা:) মাজার শরীফ জিয়ারত করে শহীদী চেতনা উজ্জীবিত করেন।
হজরত হোসাইন (রা:) কারবালার যুদ্ধের সূচনাতে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন। দীর্ঘ ভাষণে তিনি বলেছিলেন, আমার নানা হজরত মুহাম্মদ (সা:) বলেছিলেন হোসাইন, আমার থেকে এবং আমি হোসাইন থেকে, কিন্তু ইয়াযিদ বাহিনী তার সেই ভাষণের তোয়াক্কা না করে তাঁকে হত্যা করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি।