সত্যিই কি গোপাল ভাড় নামে কেউ ছিল?
গোপাল ভাড় নিয়ে ইতিহাস ভীষণ চুপচাপ। গোপাল ভাড় কে ছিলেন, তিনি সত্যিই ছিলেন কি না, তার জন্ম মৃত্যু সবকিছুই ইতিহাসে বিভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বহুচর্চিত এই রসিক সম্বন্ধে ইতিহাসের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের দেহরক্ষক হিসেবে শঙ্কর তরঙ্গ নামে এক ব্যক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। হয়ত তিনিই পরবর্তীকালে গোপাল ভাঁড় হিসেবে কল্পিত হয়েছেন।
রস সম্রাট গোপাল ভাড় এমনই এক হাস্যকর গল্প চরিত্র, যা বাঙালির কাছে চিরণবিন। যার গল্প পড়লে হাসতে হাসতে আজও বাঙালির পেটে খিঁচ ধরে। ছোট থেকে বড় সকলেই ভালোবাসে গোপালের হাস্যকর এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধির গল্প পড়তে।
গোপাল ভাঁড় বিখ্যাত হাস্যরসিক যিনি হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে অন্যদের আনন্দ দিতেন। বাংলার লোকসংস্কৃতিতে তাঁর একটি বিশেষ স্থান আছে। তিনি নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের (১৭১০-১৭৮৩) সভার অন্যতম সভাসদ ছিলেন বলে কথিত হয়।
গোপাল ছিলেন খুব বুদ্ধিমান এবং তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি ছিল অত্যন্ত প্রখর। তিনি হাস্যরস সৃষ্টির মাধ্যমে রাজাকে সর্বদা খুশি রাখতেন এবং তাৎক্ষণিক যে-কোনো ব্যাপারে বাস্তব ঘটনাশ্রিত গল্পের মাধ্যমে গভীর শিক্ষণীয় বিষয় তুলে ধরতেন।
গোপাল ভাড়ের জীবনের পরিচয়
কৃষ্ণনগরের উত্তর দিকে ঘুর্নি নামের এক গ্রামে গোপাল ভাঁড়ের জন্ম। নয় বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। গরীব বলে লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি। কিন্তু অল্পশিক্ষা আর তাঁর নিজের অসীম বুদ্ধি ও প্রতিভার গুনেই তিনি আজও বাচ্চা বুড়ো সকলের মনে রয়ে গেছেন।
গোপাল ভাঁড় ছিলেন মধ্যযুগের একজন রম্যগল্পকার। তাঁর অপর নাম গোপাল ভাণ্ড। অষ্টাদশ শতাব্দিতে নদিয়া জেলার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় তিনি ভাঁড় বা মনোরঞ্জনকারী ছিলেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে সভাসদদের মধ্যে অন্যতম নবরত্ন হিসেবে মর্যাদা দিয়েছিলেন।
অনেকে মনে করেন গোপাল নামে কেউ আদৌ ছিলেন না। তবে কোনো না কোনো বিদূষক রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রিয়পাত্র হয়েছিলেন। সেরকম গোপাল নামে কোনো নাপিত বংশীয় কোনো ব্যক্তি থাকতে পারেন বলে অনেকের বিশ্বাস। গোপালের জন্ম বা জন্মস্থান কোথায় সেবিষয়ে কোথাও সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায় নি। এমনকি কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা হিসেবে তার অবস্থানের বিষয়ে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। প্রায় দুইশো বছরের অধিক আবহমানকাল ধরে প্রচলিত তাঁর জীবনরসসমৃদ্ধ গল্পগুলো দুই বাংলার বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মুখরোচক গল্প হিসেবে সমাদৃত হয়ে আসছে। তাঁর বেশ কয়েকটি গল্প প্রবাদের মতো ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মধ্যযুগে খনার বচন যেমন প্রসিদ্ধ, তেমনই প্রসিদ্ধ গোপালের জীবনমুখী গল্পগুলো।
বলা বাহুল্য, হুগলির খানাকুল থেকে গোপালকে নবরত্ন হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। দুই বাংলার রসের হাঁড়ি খ্যাত এই গোপাল ভাঁড় ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ। তিনি তাঁর হাস্যরসের মধ্য দিয়ে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে সবসময় খুশি রাখতেন। উনবিংশ শতাব্দির বটতলার সাহিত্যে প্রথম গোপাল ভাঁড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। দুই বাংলার ইতিহাসে, এমনকি সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসেও, অল্প হলেও দেখা যায় যে, সমষ্টিগতভাবে জনগণের উপস্থিত বুদ্ধি ও জ্ঞান কোনো অতীত লোকের নামে প্রচলিত হয় এবং কালক্রমে তিনিই হয়ে ওঠেন নায়ক। গোপাল ভাঁড় হয়ত এমনই কাল্পনিক ব্যক্তি। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দেহরক্ষী হিসেবে শঙ্কর তরঙ্গ নামে এক ব্যক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁর সাহস, উপস্থিত বুদ্ধি ও জ্ঞানের জন্য রাজা অনেক সময় তাঁকে বিশেষ মর্যাদা দিতেন। হয়ত তিনি পরবর্তী কালে গোপাল ভাঁড় হিসেবে কল্পিত হয়েছেন।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সব সভাসদদের সামনে গোপালকে জব্দ করার উদ্দেশ্যে বলছেন, “বুঝলে গোপাল, আমার সাথে তোমার চেহারার কিন্তু দারুণ মিল ! তা বাবার শাসনামলে তোমার মা কি এদিকে আসতেন-টাসতেন নাকি?” গদগদ হয়ে গোপাল বললেন, ‘আজ্ঞে না রাজামশাই। তবে মা না এলেও বাবা কিন্তু প্রায়শই আসতেন!’
গোপাল ভাঁড় এর আসল পরিচয়
বাংলা অঞ্চলের প্রবল প্রতাপশালী চরিত্র নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের (১৭১০–৮৩) রাজত্বকাল ৫৫ বছরের। ১৮ বছর বয়সে তিনি যখন সিংহাসনে বসেন, তখন ১৭২৮ সাল। শাক্ত ধর্মে বিশ্বাসী কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও শিল্প–সাহিত্যানুরাগী। যদিও ১৭৫৭–তে পলাশীর প্রেক্ষাপটে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে উৎখাতের দায়ে ইতিহাসে তিনি ‘বেইমান’ হিসেবে চিহ্নিত, তবু এতে শিল্প–সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগের কাহিনি মুছে যায় না। তাঁর সভাসদ ছিলেন মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ সেন, জগন্নাথ তর্ক পঞ্চানন, হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত প্রমুখ।
এই কৃষ্ণচন্দ্রের সভার অনেক রত্নের এক রত্ন ছিলেন গোপাল ভাঁড়—এমন বক্তব্য পণ্ডিতদের। এ বিষয়ে তাঁরা স্থির সিদ্ধান্তে না এলেও এই মতের পক্ষেই রয়েছে অধিকাংশের সায়। যেমন বঙ্গসাহিত্যে হাস্যরসের ধারা বইয়ে অজিতকুমার ঘোষ লিখেছেন, ‘গোপাল রসিক–চূড়ামণি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের রাজসভার ভাঁড় ছিলেন।’
রস সম্রাট গোপাল ভাড় এমনই এক হাস্যকর গল্প চরিত্র, যা বাঙালির কাছে চিরণবিন। যার গল্প পড়লে হাসতে হাসতে আজও বাঙালির পেটে খিঁচ ধরে। ছোট থেকে বড় সকলেই ভালোবাসে গোপালের হাস্যকর এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধির গল্প পড়তে। সেই গোপাল ভাঁড় বলে কি সত্যিই কেউ ছিলেন?
নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় বিদূষক হিসেবে গোপালের উপস্থিতি বাস্তবে ছিল বলে একাংশের ধারণা। আবার অনেকে বলে এমন কেউ বাস্তবে ছিলোনা। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় ছিল একাধিক ব্যক্তি । সেখান থেকেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে গোপাল ভারের চরিত্রটি। কিন্তু নগেন্দ্রনাথ দাস নামক এক বেক্তি দাবি করেছেন গোপাল ভারের কাহিনী আসলে সত্যি। ‘নবদ্বীপ-কাহিনী বা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়’ নামে একটি বইও লিখে ফেলেন তিনি। এ বইয়ে তিনি জানাচ্ছেন, ‘ভাঁড়’ নয়, গোপালের পদবি ছিল ‘নাই’। তাঁর ঠাকুর্দা ছিলেন ‘আনন্দরাম নাই’ নামে এক পরম তান্ত্রিক সাধক। আর গোপালের বাবা দুলালচন্দ্র নাই, পেশায় ছিলেন নাপিত।
তবে, গোপালের বুদ্ধিতে মুগ্ধ হয়েই রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে সভার অন্যতম রত্ন হিসেবে স্থান দেন এবং তাকে ‘ভাণ্ডারী’ উপাধি উপহার হিসেবে দেন। ‘ভাণ্ডারী’ থেকেই সেটা হয় ‘ভাঁড়’। গোপাল ভাঁড়। নগেন্দ্রনাথ দাস বলেন, গোপাল ভারের একটি মেয়ে ছিল যার নাম ছিল রাধারানী। ভাঁড়ের বংশ লতিকাও তিনি তার সেই বইয়ে রেখেছেন। নগেন্দ্রনাথের বক্তব্য, তিনি গোপালের দাদা কল্যাণের পরবর্তী প্রজন্ম। সেই হিসেবে গোপালের একমাত্র বংশধর তিনি। তবে এই মত এখনো সব ঐতিহাসিক পুরোপুরি মেনে নিচ্ছেন না।