এন্ডোমেট্রিওসিস: নারীর জীবনে এক অভিশাপ
এন্ডোমেট্রিওসিস: নারীর জীবনে এক অভিশাপ এর নাম।
এন্ডোমেট্রিওসিস এমনই একটি ডিজিজ, যাকে ক্যান্সারের সাথে তুলনা করা যায়, তবে ক্যান্সারের মতো মৃত্যুঝুঁকি নেই।
[ Endometriosis: A curse in a woman’s life.
Endometriosis is a disease comparable to cancer, but not as deadly as cancer.]
এন্ডােমেট্রিওসিস কী? What is endometriosis in Bengali?
এন্ডােমেট্রিয়াম, জরায়ুর সবচেয়ে ভিতরের স্তর, মাসিক চক্রের সময় রক্তের সাথে অপসারিত হয়ে যায়। এই স্তরটি ডিম্বাশয়ের হরমােন ইস্ট্রোজেন ও প্রােজেস্টেরনের প্রতি সংবেদনশীল হয়। এন্ডােমেট্রিওসিস তখনই হয় যখন এন্ডােমেট্রিয়াল টিস্যু বা শরীরকলা জরায়ুতে না হয়ে ফ্যালােপাইন টিউব, ডিম্বাশয় বা অন্য কোনাে অঙ্গে সৃষ্টি হয়। এটি একটি খুবই যন্ত্রনাদায়ক অবস্থা এবং কখনও কখনও এতটাই গুরুতর হয়ে যায় যে এর ফলে শ্রোণী অঞ্চলের অঙ্গগুলি একে অপরের সাথে আঁটিয়া যায়।
রোগ বৃত্তান্ত: Disease History:
জরায়ুর তিনটি স্তরের ভিতরের স্তরটাই হলো এন্ডোমেট্রিয়াম যেখানে ভ্রুন বসে ধীরে ধীরে বড় হয়। প্রেগন্যান্সি না হলে এর গ্রন্থী এবং রক্তনালীগুলো ভেঙ্গেচুরে মাসিক আকারে বেরিয়ে আসে। সাধারনতঃ প্রতিমাসে এটি হয়ে থাকে। এই এন্ডোমেট্রিয়াম তার স্বাভাবিক অবস্থান ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হতে পারে সেই দূর দূরান্ত মস্তিস্ক পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি হয় ডিম্বাশয়ে, যেখানে প্রতিমাসে রক্ত জমে জমে চকোলেট সিস্ট তৈরী করে। এ ছাড়া পেলভিক ক্যাভিটি, এপেনডিক্ক্স, খাদ্যনালী, নাভী, চোখ, ফুসফুসের পর্দা, মস্তিস্ক, আগের কোন অপারেশনের জায়গা কোথায় না!
এর নির্দিষ্ট কারণ অজানা, তবে কতগুলো তত্ত্ব আছে। যে কোন বয়সেই হতে পারে তবে ৩০-৪০ এর মধ্যে বেশি হয়। বড়লোকের ও সুন্দরী মেয়েদের বেশি হয়ে থাকে (কারন অজানা)। টিনএজ মেয়েদের মাসিকের তীব্র ব্যাথা হলেই সন্দেহ করতে হবে। যাদের মা বা বোনদের এই অসুখ আছে তাদের হবার সম্ভাবনা বেশী থাকে। তলপেটে জরায়ু, ডিম্বাশয়, ডিম্বনালী, খাদ্যনালী, মুত্রথলি, মুত্রনালী সব অঙ্গে অঙ্গে জড়িত থাকে। তাই তলপেটে ব্যথা হয়। চকোলেট সিস্টের জন্যও ব্যথা হয়।
উপসর্গগুলো নিম্নরূপ: The symptoms are as follows:
১. মাসিকের সময় তীব্র ব্যথা।
২. মাসিকে অধিক রক্তক্ষরণ।
৩. সহবাসে ব্যথা।
৪. পায়খানা করতে ব্যথা।
৫. সন্তান ধারনে অক্ষমতা।
চিকিৎসা: Treatment :
ব্যথায় ব্যথায় নীল হয়ে যাওয়া এই মেয়েগুলো এক বিষাদময় জীবন যাপন করে। ৫০-৭০% এন্ডোমেট্রিওসিসের রোগী বন্ধত্ত্বে ভোগেন। ডিম্বাশয়ের সিস্ট অপারেশন করে ফেলে দিলেও শান্তি নেই, কারণ এটি আবার এবং বার বার হয়। কিন্তু বার বার অপারেশনে বাচ্চা হবার সম্ভাবনা আরও কমে যায়। এমনকি বাচ্চা হবার রসদ শেষও হয়ে যেতে পারে। মাসিক বন্ধ করে রাখা এর একটি অন্যতম চিকিৎসা।
সম্পূর্ণ নিরাময়ের জন্য একমাত্র চিকিৎসা দুই ওভারী এবং জরায়ু ফেলে দেয়া। যেটা একমাত্র যাদের ফ্যামিলি কমপ্লিট হয়েছে তাদের জন্যই সম্ভব।
ল্যাপারোস্কোপী ছাড়া সঠিক ডায়াগনোসিস করা যায় না এবং তলপেটে ব্যথার অন্যান্য কারণ থাকার ফলে এন্ডোমেট্রিওসিস ডায়াগনোসিস করতে অনেক সময় লেগে যেতে পারে। প্রায় ৭-৯ বছর লাগে এই রোগটি ডায়াগনোস্টিক পর্যায়ে আসতে। এই রোগ মেয়েদের কর্ম অক্ষম করে দেয়। ৫০ শতাংশ মেয়েরা স্কুল এবং নিজ কর্মক্ষেত্র থেকে বিরতি নিতে বাধ্য হয়। এটি ননকিউরেবল (নিরাময়হীন), রিকারেন্ট (উপযুক্ত চিকিৎসার পরেও ফিরে আসা), প্রগ্রেসিভলি ডেস্ট্রাক্টিভ (ক্রমশই ধ্বংসকারী)। সবকিছু মিলে মানসম্পন্ন জীবন যাপন সাংঘাতিকভাবে বিঘ্নিত হয়।
সারা পৃথিবীতে প্রায় ২০০ মিলিয়ন এন্ডোমেট্রিওসিসের রোগী আছে। প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই মার্চ মাসকে ওয়ার্ল্ড এন্ডোমেট্রিওসিস অবজারভেশন মাস হিসেবে ঘোষনা করা হয়। ২৮ মার্চ ওয়ার্ল্ড এন্ডোমেট্রিওসিস দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এইদিনে পেশেন্ট, সার্ভিস প্রোভাইডার, মিডিয়া সবাই মিলে এর সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আলোচনা করে।
সচেতনতা অভিভাবকের জন্য : Awareness for parents:
১. আপনার স্কুলে পড়া মেয়েটির মাসিকের সময় ব্যথা হলে অবশ্যই গাইনোকলজীস্টের শরনাপন্ন হন।
২. স্কুলে টিচারকে নোটিশ করুন যে, এটি শুধুই স্বাভাবিক মাসিক নয়। এটি ওর অসুস্থতা। স্কুল টিচারকেও এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে মেয়েদের সাহায্য করতে হবে।
৩. চিকিৎসার স্বার্থে জন্ম নিয়ন্ত্রনের বড়ি চিকিৎসক প্রেস্ক্রাইব করতে পারেন। আপনি নিজে প্রতিদিন ওকে খাইয়ে দিন। মেয়ে বড় হলে তাকে বুঝিয়ে বলবেন যে এটি এখানে মাসিক বন্ধ করে রাখার জন্য দেয়া হয়েছে।
৪. মাসিক বন্ধ করে রাখলে এটি আর বাড়তে পারে না। মাসিক না হলে শারিরীক কোন অসুবিধে হয় না। তাই যতদিন চিকিৎসক ওষুধ দিবেন ততদিন চালিয়ে যাবেন।
সচেতনতা বিবাহিতদের জন্য: Awareness for Married:
১. এন্ডোমেট্রিওসিস ডায়াগনোসিস হলে জন্ম নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থা না নেয়াই ভাল। যদি নিতান্তই প্রয়োজন হয় তাহলে জন্ম নিয়ন্ত্রনের জন্য ওসিপি (বড়ি) খাওয়া উত্তম।
২. সম্ভব হলে ৩০ আর তা না হলে ৩৫ বছর বয়সের মধ্যে ফ্যামিলি কমপ্লিট করার চেষ্টা করুন।
সচেতনতা চিকিৎসকের জন্য: Awareness for Physicians:
১. এডোলেসেন্টদের মাসিকের ব্যথা গুরুত্ত্বের সাথে দেখুন। ফ্যামিলি হিস্ট্রী জানুন- মা, খালা, বোনদের এই রোগ আছে কিনা। যদি থেকে থাকে তাহলে এই মেয়েকে অবশ্যই একজন এন্ডোমেট্রিওসিসের পেশেন্ট হিসেবে ফার্স্ট লাইন, সেকেন্ড লাইনের চিকিৎসা দিন। থেরাপিউটিক ট্রায়াল অনেকসময়ে ডায়াগনোসিসে সহায়তা করে। রেগুলার চার বা ছয় মাস অন্তর আল্ট্রাসনোগ্রাফীর মাধ্যমে ফলোআপ করা যেতে পারে কোন সিস্ট আছে কিনা তা ডায়াগনোসিস করার জন্য।
২. যদি সিস্ট থাকে তাহলে দীর্ঘদিনের জন্য মাসিক বন্ধ করে রাখতে হবে। ডাইনোজেস্ট একটানা একবছর পর্যন্ত দেয়া যেতে পারে।
৩. এডোলেসেন্টদের সার্জারী এভয়েড করা বাঞ্চনীয়। নিতান্তই প্রয়োজন হলে (সিস্ট অনেক বড় হলে) ল্যাপারোস্কোপীক সিস্ট এসপিরেশন অথবা মডিফাইড সিস্টেকটোমী করে টানা সাপ্রেসিভ থেরাপী দেয়া বাঞ্চনীয়।
৪. যারা বাচ্চা চায় তাদের জন্য সার্জারী উপযোগী। এডহেশন রিলিজ করে, টিউবোওভারিয়ান রিলেশন ঠিক করে, সিস্ট রিমুভ করে দিলে বাচ্চা হবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। সার্জারীর আগে অবশ্যই অবশ্যই ওভারীয়ান রিজার্ভ চেক করুন। রিজার্ভ খুব কম হলে অপারেশনের সিদ্বান্ত পরিবর্তন হতে পারে।
৫. রিকারেন্স প্রিভেন্ট করার জন্য প্রয়োজনে সাপ্রেসিভ থেরাপী দিতে হবে।
৬. রিপিট সার্জারী বর্জন করা বাঞ্চনীয়। রিপিট সার্জারী ওভারিয়ান ফেইলিউর করতে পারে। ওভারীয়ান রিজার্ভ খুব ভাল থাকলে করা যেতে পারে। তবে সাধারনত খুব ভাল থাকে না। এদের জন্য আইভিএফ উপযোগী।
৭. কোন কারণে কেউ প্রেগন্যান্সি দেরি করে নিতে চাইলে ওভাম, ওভারীয়ান টিস্যু বা এম্ব্রায়ও যার জন্য যেটা উপযোগী ফ্রীজ করে রাখা যেতে পারে।
৮. সিভিয়ার ফর্মে হোলে যার ফ্যামিলি কমপ্লিট তার ডেফিনিটিভ সার্জারী, যার বাচ্চা নেই তার জন্য আইভিএফ এবং অবিবাহিতদের জন্য সাপ্রেসিভ থেরাপী।
নিজ নিজ ক্ষেত্রে সচেতনতাই পারবে এই সমস্যার সুন্দর সমাধান দিতে।