আব্বাসি খিলাফত (The Abbasid Khilafat)
আব্বাসি খিলাফত (The Abbasid Khilafat)উমাইয়া খিলাফতের ধ্বংসস্তূপের ওপর আব্বাসি খিলাফতের উত্থান ইসলামের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ের সূচনা করে। এ বংশের প্রথম শাসক আবুল আব্বাস আস সাফফাহ উমাইয়া নিধনযোগ্য নীতি গ্রহণ করে এ বংশের ভিত স্থাপন করেন।
তাঁর পরবর্তী শাসক আবু জাফর আল মনসুর এ বংশকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন, যার ওপর ভিত্তি করে এ বংশের পরবর্তী শাসকেরা ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসনব্যবস্থা অব্যাহত রেখেছিল।
এ সময় তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, বিদ্রোহ দমন, সাম্রাজ্যবিস্তার নীতি, শিল্প, সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদিতে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এতদসত্ত্বেও ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে হালাকু খানের রোষানলে পড়ে এ বংশের সূর্য অস্তমিত হয়েছে।
আব্বাসিদের পরিচয় ও আব্বাসি আন্দোলন (Introduction of the Abbasids and the Abbasid Movement)
আব্বাসিদের পরিচয়:
আব্বাসিরা মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশের হাশেমি শাখা হতে উদ্ভূত। কুরাইশ বংশের অন্য শাখাটি উমাইয়া নামে খ্যাত। মহানবি (স)-এর পিতৃব্য আল আব্বাস বিন আবদুল মুত্তালিব বিন হাশেমের নাম হতেই আব্বাসি বংশের নামকরণ করা হয়েছে। আল আব্বাস তাঁর চার পুত্রকে (আবদুল্লাহ, ফজল, উবায়দুল্লাহ ও কায়সান) রেখে ৬৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। সিফফিনের যুদ্ধের সময় (৬৫৭ খ্রি.) তারা উমাইয়া গোত্রের মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে হাশেমি গোত্রের হযরত আলী (রা)-এর পক্ষাবলম্বন করেন। আত্মীয়তার দিক থেকে উমাইয়াদের তুলনায় মহানবি (স)-এর নিকটতর হওয়ায় তারা নিজেদেরকে মুসলিম খিলাফতের বৈধ দাবিদার বলে দাবি করত।
আব্বাসি আন্দোলনের ঘটনাবলি (Abbasid Khilafat):
আবদুল্লাহ ও আলীর উমাইয়াবিরোধী তৎপরতা: ইবনে আব্বাস নামে পরিচিত আল আব্বাসের জ্যেষ্ঠপুত্র আবদুল্লাহ ও তাঁর অপর তিন ভ্রাতা উমাইয়াদের অধার্মিকতা ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই সোচ্চার ছিলেন। একই গোত্র হতে উদ্ভূত বলে ভ্রাতাগণ সিফিন (৬৫৭ খ্রি.) ও কারবালার যুদ্ধে (৬৮০ খ্রি.) হযরত আলী (রা) ও তাঁর বংশধরদের সমর্থন করেন।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আলী পরিবারের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দে আলীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মুহাম্মদ পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। মুহাম্মদ বিন আলী সুযোগ্য ও উচ্চাভিলাষী ছিলেন। তিনিই ছিলেন আব্বাসীয় আন্দোলনের প্রধান উদ্যোক্তা এবং উমাইয়া বংশের পতন ঘটিয়ে আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠার প্রথম পরিকল্পনাকারী।
আব্বাসি আন্দোলনের সূচনা (Abbasid Khilafat)
: মুহাম্মদ-বিন-আলী তাঁর পূর্বপুরুষের উমাইয়াবিরোধী অনুরাগকে আন্দোলনে রূপান্তরিত করেন। আব্বাসি আন্দোলনকে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য মুহাম্মদ-বিন-আলী ঘোষণা করেন যে, ইহ হুসাইনের শাহাদত বরণের পর ইসলামের ধর্মীয় কর্তৃত্ব তাঁর পুত্র আলী অথবা জয়নুল আবেদীনের ওপর ন্যস্ত না হয়ে হুসাইনের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা মুহাম্মদ আল হানাফিয়ার ওপর অর্পিত হয়েছে। মুহাম্মদ আল হানাফিয়ার ইন্তেকালের পর তদীয়পুত্র হাশেম নেতৃত্বলাভ করেন। নিঃসন্তান হাশেম মৃত্যুর পূর্বে ইমামতির দায়িত্ব আব্বাসি বংশের তৎকালীন নেতা মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস-এর নিকট অর্পণ করেন।
উমাইয়াবিরোধী সর্বদলীয় জোট গঠন: মুহাম্মদ বিন আলীর সাংগঠনিক শক্তি ছিল প্রবল। তিনি কৌশলে ঘোষণা করেন যে, মহানবি তথা ফাতেমীয় বংশের দাবি প্রতিষ্ঠা করাই আব্বাসি আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য। ফলে উমাইয়াদের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন খারেজি, শিয়া, খোরাসানি, মাওয়ালি প্রভৃতি গোষ্ঠী এই আন্দোলনের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায় এবং উমাইয়াবিরোধী জোট গঠন করে। এই জোট সম্পর্কে পি কে হিট্টি বলেন, “শিয়া, খোরাসানি এবং আব্বাসি শক্তির একত্রীকরণে উমাইয়া বংশের অন্তিমকাল উপস্থিত হলো এবং এটা শেষোক্ত সম্প্রদায়কে তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে সহায়তা করে।” আব্বাসি দাই বা প্রচারকগণকে সুগঠিত ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি নিয়ে একটি সিনেট গঠন এবং সিনেট পরিচালনার জন্য ১২ সদস্যবিশিষ্ট একটি কাউন্সিল যার প্রধান ছিলেন স্বয়ং মুহাম্মদ বিন আলী। অবশ্য উদ্দেশ্য সিন্ধির আগেই ৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ বিন আলী মৃত্যুবরণ করেন। তবে মৃত্যুর পূর্বেই তিনি তাঁর তিন পুত্র ইব্রাহিম, আবুল আব্বাস এবং আবু জাফরকে তাঁর ক্রমান্বয়িক উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান।
আবু মুসলিমের বিপ্লবী প্রচারণা ও খোরাসান দখল: আব্বাসি আন্দোলনকে বিপ্লবে পরিণত করার সেরা কারিগর ছিলেন। আৰু মুসলিম নামক আরব বংশোদ্ভূত এক পারসিক মাওয়ালি। আমীর আলী বলেন, “তাঁর অপরিবর্তনীয় শিষ্টাচার ও সৌজন্য শত্রুগণকে অনুরঞ্জিত করত এবং সমর্থন লাভে সহায়তা করত; অন্যপক্ষে তাঁর সৈন্যদল গঠন এবং শাসনকার্য পরিচালনার দক্ষতা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করত।” মুহাম্মদের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইব্রাহিম আব্বাস আন্দোলনের নেতৃত্বে গ্রহণ করেন।
আবু মুসলিম খোরাসানি তাঁর অধীনে প্রচারকার্য শুরু করেন। আমীর আলী আৰু মুসলিমকে ম্যাক্টিয়েভেলীর মতো চতুর বলে অভিহিত করেছেন। বস্তুত আবু মুসলিমের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে খোরাসান ঊমাইয়াবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। এরপর খোরাসানের উমাইয়া শাসনকর্তা নসর ইবনে সাইয়্যার যখন করিমানে খারিজি বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত ঠিক সেই সময় ৭৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জুন আবু মুসলিম নিজেকে ‘আল হাশিম (হাশিমীয়দের রক্ষক) বলে ঘোষণা করেন এবং আব্বাসিদের কালো পতাকা উত্তোলন করে খোরাসানের রাজধানী মার্চ ও ফারগানাসহ সমগ্র খোরাসান দখল করে নেন। পলায়নপর খোরাৎসানের শাসনকর্তা নসব আব্বাসি বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন।
ইমাম ইব্রাহিমের গ্রেফতার ও হত্যাকাণ্ড: খোরাসানের পতনের পর উমাইয়া খলিফা মারওয়ান ইব্রাহিমকে বন্দি করার আদেশ দেন। উমাইয়াবিরোধী ইব্রাহিমকে বন্দি ও পরে হত্য করা হয়। ইব্রাহিমের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতাগণ ইরাতের রাজধানী কুফায় পলায়ন করেন। মৃত্যুর পূর্বে ইব্রাহিম তাঁর ভ্রাতৃদ্বয় আবুল আব্বাস আস সাফ্ফাহ এবং আবু জাফর আল মনসুরকে ইমাম মনোনীত করেন।
আবু মুসলিমের ইরাক দখল: ইমাম ইব্রাহিমের হত্যার পর আবু মুসলিম তাঁর অধীনস্থ সেনাপতি কাহতাবা এবং খালিদ ইবনে বার্মাককে প্রাচীন রাজেস বা রাই শহর অভিমুখে প্রেরণ করেন। উমাইয়া শাসক ইয়াজিদ আবু মুসলিমের কাছে পরাজিত হলে ইরাকের রাজধানী কুফা আবু মুসলিমের অধিকারে আসে। নিহওয়ান্দ ও মেসোপটেমিয়াও আব্বাসিদের দখলে আসে।
আবুল আব্বাস খলিফা ঘোষিত: কুফা দখলের পর হাসান ইবনে কাহতাবার সাথে আবু সালমা আল খাল্লাল নামক এক ফাতেমি সমর্থক যোগ দেন। তারা দুজনে পরবর্তী জুম্মার দিবসে খলিফা নির্বাচনের জন্য জনগণকে কৃষ্ণা সমবেত হতে আহ্বান জানান।
৭৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৯ নভেম্বর শুক্রবার আবুল আব্বাস কৃষ্ণবস্ত্রে আচ্ছাদিত হয়ে কুফা মসজিদে গমন করলে আবু সালমা আল খাল্লাল ওরফে জাফর তাঁকে খলিফা বলে ঘোষণা করেন। উপস্থিত সকলে উচ্চেঃস্বরে আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে তাদের সম্মতি জ্ঞাপন করে। আবুল আব্বাস উমাইয়াদের নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ এহনার্থে বজ্রকঠিন শপথ নেন।
জাবের যুদ্ধ এবং উমাইয়াদের পতন: আবু মুসলিমের অপর এক সুদক্ষ সেনাপতি আবু আয়ূন দ্বিতীয় মারওয়ানের পুত্র আব্দুল্লাহকে পরাজিত করেন। পুত্র আব্দুল্লাহর পরাজয়ের গ্লানি মোচনের জন্য খলিফা ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে ১,২০,০০০ সৈন্যসহ টাইগ্রিস নদী (দজলা) অতিক্রম করে বড় জাব নদীর দিকে অগ্রসর হন।
ইতোমধ্যে আবুল আব্বাসের পিতৃব্য আবদুল্লাহ ইবনে আলীর নেতৃত্বে একদল সৈন্য আবু আয়ুনের সাহায্যার্থে প্রেরিত হয়। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি একরকম বিনাযুদ্ধেই আব্বাসিদের বিজয় নিশ্চিত হয়। পি কে হিট্টি বলেন, “সমগ্র সিরিয়া এ যুদ্ধের পর আব্বাসিদের পদানত হয়। দ্বিতীয় মারওয়ান দামেস্কে এসে পুনরায় সৈন্যবাহিনী গঠনের চেষ্টা করেন।
কিন্তু ব্যর্থ হয়ে পলায়ন করলে তাকে বর্শাবিদ্ধ করে হত্যা করা হয় (৫ আগস্ট ৭৫০ খ্রি.)। কুফায় আবুল আব্বাসের নিকট মারওয়ানের ছিন্ন মস্তক প্রেরিত হলে তিনি সানন্দে ‘আস-সাফাহ’ বা রক্তপিপাসু উপাধি গ্রহণ করেন। এভাবে আব্বাসিগণ মহানবি (সা.)-এর বংশধর তথা ‘আহলে বায়াত’-এর স্বার্থরক্ষার স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এবং মুসলিম বিশ্বে আব্বাসি নামে নতুন রাজবংশের যাত্রা শুরু হয়।
আব্বাসি খিলাফতের পতন ও ফলাফল (Fall of the Abbasid Khilafat and its Result ) অবনতি ও পতনের কারণ
স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল অতিক্রম: বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুনের (আল-মুকাদ্দিমা) মতে, একশত বছরের মধ্যেই যে কোনো রাজবংশের উত্থান-বিকাশ, চরম উন্নতি ও পতন ঘটে। উমাইয়াদের মতো আব্বাসিদের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয় নি। পাঁচশত বছরব্যাপী (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.) আব্বাসি খিলাফত বজায় থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আল ওয়াসিকের (৮৪২-৪৭খ্রি.) খিলাফতকাল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
খলিফাদের অযোগ্যতা: সর্বমোট ৩৭ জন আব্বাসি খলিফার মধ্যে মনসুর, মাহদী, হারুন ও মামুন পরাক্রমশালী এবং অসাধারণ শাসন দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী খলিফাগণ বিশেষ করে আল-মুতাজিদের (৮৯২-৯০২ খ্রি.) পর অযোগ্য খলিফাগণ রাজকার্যের প্রতি উদাসীনতা ও অবহেলা প্রদর্শন করে ভোগবিলাসে নিমগ্ন থাকতেন। ফলে সাম্রাজ্যে অরাজকতা দেখা দেয়।
বিভিন্ন স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়: আব্বাসি খিলাফতের বিশালতার কারণে প্রদেশের সংবাদ রাজধানী বাগদাদে সময়মতো পৌঁছাত না। ফলে খলিফা সময়মতো বিদ্রোহ দমনের জন্য দূরাঞ্চলে অভিযান প্রেরণ করতে পারতেন না।
এমতাবস্থায় খলিফা হারুনের রাজত্বকালে ৮০০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর আফ্রিকার আগলারী বংশ, মামুনের আমলে (৮১৩-৩৩ খ্রি.) তাঁর সেনাপতি তাহির খোরাসানে স্বাধীন তাহিরী বংশ, এ ছাড়া পরবর্তীকালে ইদ্রিসীয়, সামানীয়, বুয়াইয়া, সেলজুক, গজনবী প্রভৃতি স্বাধীন বংশ গড়ে ওঠে।
কিন্তু সুষ্ঠু যোগাযোগব্যবস্থা ও শক্তিশালী সেনাবাহিনীর অভাবে খলিফাগণ সাম্রাজ্যের ঐক্য ও সংহতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। আব্বাসি সাম্রাজ্যের এ দুরবস্থা সম্পর্কে ঐতিহাসিক পি কে হিট্টি বলেন- “রোগী ইতোপূর্বেই মৃত্যুশয্যায় শায়িত ছিল, তা টের পেয়ে সিঁদেল চোর দরজা ভেঙে অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং রাজকীয় সম্পত্তি থেকে স্ব-স্ব অংশ কেড়ে নেয়।
সামরিক বিভাগের প্রতি অমনোযোগিতা: উমাইয়াগণ একক আরব বাহিনীর সাহায্যে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকায় যে মুসলিম সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন তা আব্বাসি বহুজাতিক বাহিনীর হাতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আব্বাসি খলিফাগণ জাতি ও গোত্রের ভিত্তিতে সৈন্যবাহিনী গঠন করায় সৈন্যবাহিনীর শক্তি হ্রাস পায়।
অনিয়মতান্ত্রিক উত্তরাধিকার নীতি: উমাইয়াদের মতো আব্বাসি খিলাফতেও সিংহাসনের উত্তরাধিকারকে কেন্দ্র করে রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিরোধ, স্বার্থান্বেষী কোন্দল, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও রক্তপাত লেগেই ছিল। হারুনের অদূরদর্শিতার ফলে আমিন এবং মামুনের মধ্যে (৮০৯-১৩ খ্রি.) মর্মান্তিক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। জাতিগত বিভেদ: আব্বাসি খিলাফতে হিমারীয়-মুদারীয়, পারসিক, তুর্কি, সেমেটিক ও বার্বারদের মধ্যে জাতিগত বিভেদ ও
গোত্রকলহ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় আব্বাসি সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে। বিভিন্ন ধর্মমতাবলম্বীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ: আব্বাসি যুগে শিয়া, সুন্নি, দায়লামী কায়মাতিয়ান, মুতাজিলা, ঈসমাইলী গুপ্তঘাতক, আশায়ারী, জিন্দিক সর্বেশ্বরবাদী, বাতিনী, ফাতেমী প্রভৃতি ধর্মমতাবলম্বীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও অনৈসলামিক কার্যকলাপ আব্বাসি বংশের স্থায়িত্বের মূলে কুঠারাঘাত করে।
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি প্রথম পত্র
আব্বাসি খলিফাদের নৈতিক অধঃপত্তন: মদ, নারী ও সংগীত সভ্যতার এ তিনটি পাপ এবং এর সাথে বিলাসী আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রা মিলিত হয়ে পরবর্তী আব্বাসি খলিফাগণ ও অমাত্যবর্গের নৈতিকতাকে ধ্বংস করে দেয়।
অর্থনীতির চরমাবস্তা: আব্বাসি বলিয়াগণ জনগণকে অভারে জন্মরিত করে নিজেরা ভোগ-বিলাসে আর নিমজ্জিত হন। এর ফলে কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যে অচলবস্থার সৃষ্টি হয়। উপরন্তু দুর্ভিক ও কমপক্ষে ৪০ বারের মহামারীতে জনসাধারণের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে।
তুর্কিবাহিনীর দোর্দণ্ড ঔদ্ধতা: তুর্কি ক্রীতদাসীর সন্তান আল-মুতাসিম দুর্ধর্ষ ও বদর তুর্কি যুবকদের দিয়ে যে তুর্কি বাহিনী গঠন করেন তা এক পর্যায়ে আব্বাসিদের পড়নের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ বাহিনীর অত্যাচারে বাগদাদের জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। তাদের সীমাহীন দৌরাত্মো আরব ও পারস্যবাসীর জীবন দুর্বিষণ হয়ে পড়ে এবং তারা এ জন্য আব্বাসিদের পতন ত্বরান্বিত করে।
অন্যান্য কারণ: এছাড়া আমির-উমরাহদের স্বেচ্ছাচারিত, প্রতিদ্বন্দ্বী কাডেমীয় খিলাফতের উত্থান, বাইয়া ও সেলজুকদের বিস্তার, অমুসলমানদের অসন্তোষ, বাইজান্টাইনদের আক্রমণ ও ক্রুসেডের ফলে আব্বাসি সাম্রাজ্যের ভিত নড়বড় করেছিল এমতাবস্থায় ১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মোঙল নেতা চেঙ্গিস খান পৌত্র হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণ করলে পাঁচশ বছরের আব্বাসি শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
ৰাগদাদ ধ্বংসের ফলাফল: বাগদাদ ধ্বংসের পূর্বে এর লোকসংখ্যা ছিল ২০ লক্ষাধিক। কিন্তু হালাকুর ছয় সপ্তাহের ধংসযজ্ঞে ১৬ লক্ষ লোক প্রাণ হারায়। সৈয়দ আমীর আলী বলেন, “তিন দিন ধরে নগরীর রাজপথগুলোতে রক্তস্রোত প্রবাহিত হয় এবং দজলার পানি এর গতিপথে বহু মাইল পর্যন্ত রক্তে রঞ্জিত হয়।
১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে হালাকু খানের আক্রমণে আব্বাসিদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে পাঁচশত বছরের পুরাতন ও ঐতিহ্যবাহী আব্বাসি বংশের চির বিলুপ্তি ঘাটে এবং বাগদাদ মোঙল শাসিত পারস্যের ইলখানি সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। পিকে হিট্টি বলেন, “ইতিহাসে এই প্রথম মুসলিম দুনিয়ায় কোনো খলিফা রইল না যার নাম শুক্রবারের খুৎবায় পাঠ করা যায়। আব্বাসি মিলারে পতনের ফলে সুন্নি ইসলাম বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় এবং সুন্নি মুসলমানরা ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে।
ঐতিহাসিক সৈয়দ আমীর আলী বলেন, “শিক্ষার গৃহ, সভ্যতার ক্ষেত্র এবং সারাসিন জগতের চক্ষু ও কেন্দ্রভূমি ৰাগদাদ চিরতরে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো। ঐতিহাসিক বার্নার্ড লুইস এর মতে, (Bernard Lewis, The Arabs in History) মোঙল বিজয় তাদের অধীনস্থ দুরপ্রাচ্য অর্থাৎ চীনের এবং দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া মধ্যপ্রাচ্যের সভ্যতাকে একত্রিত করে যারা পূর্বে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বাধার দ্বারা পৃথক হয়ে পড়েছিল। বাগদাদ ধ্বংসের ফলে শিয়া-সুন্নি, মালিকী-হাম্বলী, আরব-পারসিক দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে সুযোগ বুঝে তুর্কি জাতি ক্রমে ক্রমে নেতৃত্বের অবস্থায় উন্নীত হয়।