পৃথিবীর পরিধি কিভাবে পরিমাপ করা হয়েছিল?
পরিধি কি?
পরিধি কাকে বলে তা আমরা সবাই জানি। একটি বদ্ধ বক্ররেখার সীমান্ত বরাবর দৈর্ঘ্যকে পরিধি বলে। অর্থাৎ, একটি বক্র রেখা দ্বারা যদি একটি ক্ষেত্র বা অংশ আবদ্ধ থাকে তবে সেই বক্র রেখাটি আবব্ধ ক্ষেত্রটির পরিধি। তাই গোলাকার যে কোন বস্তুরই পরিধি থাকবে। শুধু পরিধি নয় এর সাথে ব্যাস, ব্যাসার্ধ, কেন্দ্র, চাপ ও থাকবে।
এ তো গেলো পরিধির কথা। আমরা খুব সহজেই পরিধি মাপতে পারি। আমাদের কেউ একটি বৃত্ত দিলে আমরা সেই বৃত্তের ব্যাসার্ধ মেপে সহজেই বলে দিতে পারবো এর পরিধি কত। আমাদের যে বৃত্তটি দেয়া হয়েছে এর আকার খুবই ছোট বলে আমরা সহজেই আমাদের খাতায় একে এর ব্যাসার্ধ নির্ণয় করতে পারছি এবং পরবর্তীতে পরিধি নির্ণয় করে ফেলছি।
কিন্তু একটি পিপড়ে কে যদি বলা হয় ফুটবলের সম কোন বস্তুর পরিধি পরিমাপ করতে হবে তবে এ বিষয়টি কেমন হয়ে দাঁড়াবে! কারণ পিঁপড়ের জন্য ফুটবলটির আকার অনেক বড়। ঠিক তেমনি একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল মানুস যখন তাদের সামনে প্রশ্ন এসেছিল পৃথিবীর পরিধি কত? আজ মজার এই বিষয়টির বিস্তারিত ইতিহাস জানব কিভাবে সর্বপ্রথম মানুষ পৃথিবীর পরিধি নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিল।
পরিধি পরিমাপের মজার ইতিহাস
গ্রীক পণ্ডিত ইরাটোস্থিনিস তার সময় অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৬ সনে জ্যামিতি ব্যবহার করে পুরো পৃথিবীর পরিধি প্রায় নির্ভুলভাবে মেপে ফেলেছিলেন। তিনি বাস করতেন গ্রীসের সিরীন শহরে বর্তমান লিবিয়ার আসোয়ান শহর।
সেই সময় একটা বিখ্যাত লাইব্রেরী ছিলো আলেকজান্দ্রিয়া শহরে। ছাপা খানা না থাকায় বইয়ের একটি কপিই ছিল সম্বল। তাই লাইব্ররীতেই বই গুলো জমা থাকত। পেশাগত ভাবে এই লাইবেরিতে কাজের সুযোগ পান ইরাটোস্থিনিস। সেই কাজের সুযোগকে তিনি দারুণভাবে কাজে লাগিয়ে জ্ঞানের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। প্রথম অবস্থায় তিনি বিভিন্ন ভ্রমণ গাইড গুলো পড়ে নিজের মত করে পৃথিবির একটি মানচিত্র এঁকেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন শখের কবিও। সবখানে দেরি করে আসতেন বলে তাকে ডাকা হতো গ্রীক বর্ণের দ্বিতীয় অক্ষর বিটা(β)নামে।
ইরাটোস্থিনিস ক্যালেন্ডার সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং সংখ্যা পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর ছিল মৌলিক ধারণা। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে সিরীন শহরে সূর্য ঠিক মাথার উপর অবস্থান করে। কোণ লাঠি খাড়াভাবে রাখলে তার ছায়া পড়ত না। এখন আমরা জানতে পেরেছি দিনটি হচ্ছে ২১ শে জুন। সূর্যের রশ্মি সরাসরি পতিত হতো বলে সেদিন কুয়োর তল পর্যন্ত সূর্যের রশ্মি পৌঁছাত। তিনি এটিও লক্ষ্য করেছিলেন যে সেই একই দিনে একই সময় আলেকজান্দ্রিয়া শহরের একটি লাঠির পুঁতে রাখলে সে লাঠির ছায়া মাটিতে পড়ত। এর কারণ আমরা জানি, সূর্য পৃথিবীকে সমান্তরালভাবে আলো দিয়ে থাকে আর পৃথিবীর আকার গোলাকার হওয়ায় একই সময়ে দুটি স্থানে সূর্যের সরাসরি অবস্থান সম্ভব নয়।
ইরাটোস্থিনিস জ্যামিতি বিষয়ে অবগত ছিলেন বলে তিনি জানতেন তার পরীক্ষিত লাঠিগুলো এঁকে সামনে প্রসারিত করা হলে সেগুলো নির্দিষ্ট বিন্দুতে এসে মিলিত হবে এবং সেটাই হবে পৃথিবীর কেন্দ্র। এবং লাঠি দুটির মিলন স্থানে একটি কোণ উৎপন্ন হবে।
আবার আলেকজান্দ্রিয়াতে যে লাঠি খাড়া ভাবে মাটিতে পোঁতা হয়েছিল সেটি তার ছায়ার সাথে সমকোণী ত্রিভুজ উৎপন্ন করে। এখানে লাঠি এবং ছায়ার মধ্যবর্তী যে কোন পণ্য হয়েছিল সেটি পৃথিবীর কেন্দ্রে উৎপন্ন কোণের সমান কারণ তারা একান্তর কোণ।
চিত্রিত লাঠি গুলি কেন্দ্রে মিলিত স্থানে যে কোন উৎপন্ন করে সেটি পৃথিবীর কেন্দ্রে গিয়ে পরিমাপ করা কখনোই সম্ভব নয়। কারণ পৃথিবীর কেন্দ্রে আজ পর্যন্ত কেউ যেতে পারেনি।
ইরাটোস্থিনিস তার আলেকজান্দ্রিয়াতে পোতা লাঠিটি এবং তার দ্বারা সৃষ্ট ছায়ায় উৎপন্ন কোণের পরিমাণ নির্ণয় করতে পেরেছিলেন ৭ ডিগ্রি ১২ মিনিট। ঠিক একই সময়ে পৃথিবীর কেন্দ্র ৭ ডিগ্রি ১২ মিনিট কোণ উৎপন্ন হওয়ার কথা।
পৃথিবী একটি গোলক বিধায় এর কেন্দ্রে উৎপন্ন কোণের পরিমাণ ৩৬০ডিগ্রি। ইরাটোস্থিনিস তার পরিমাপ থেকে বের করতে সক্ষম হয়েছিলেন ৩৬০ ডিগ্রির ৫০ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ৭ ডিগ্রি ১২ মিনিট।
আলেকজান্দ্রিয়া এবং সিরীনের দূরত্ব সেই সময় ছিল ৫০০০ স্টেডিয়া (১ স্টেডিওন = ১৫৭ মিটার প্রায়) মিশরীয় স্টেডিয়ার হিসাব অনুসারে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ৭ ডিগ্রি ১২ মিনিট হচ্ছে ৫০০০ স্টেডিয়া দূরত্বের পৃথিবীর ওপর দুটি স্থান। তাহলে পুরো পৃথিবীর দূরত্ব পরিমাপ করতে হলে ৩৬০ ডিগ্রী জন্য যত দ্রুত পাওয়া যাবে সেটি হবে পৃথিবীর পরিধি।
অর্থাৎ গণনাটি এরূপ হবে,
৭.১২ ডিগ্রির জন্য দুরত্ব= ৫০০০ স্টেডিয়া
৩৬০ ডিগ্রির জন্য দুরত্ব= ৫০*৫০০০ স্টেডিয়া= ২৫০০০০ স্টেডিয়া
( যেহেতু, ৩৬০ ডিগ্রির ৫০ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ৭ ডিগ্রি ১২ মিনিট )
অর্থাৎ, পৃথিবীর ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে আসলে ২৫০০০০ স্টেডিয়া পথ অতিক্রম হবে যা হবে পৃথিবীর পরিধি।
আশ্চর্যজনকভাবে তার হিসেবটি ছিল মাত্র ০.১৬% ভুল! মাইল হিসাবে তার পরিমাপ ছিল ২৪৬৬০ মাইল। যা নিখুঁত পরিধির মান ২৪৯০০ এর খুবই কাছাকাছি।
ইরাটোস্থিনিস আর ও চমৎকার মজার কিছু হিসেব করেছিলেন। তিনি পৃথিবী থেকে চাঁদ এবং সূর্যের দুরত্ব, সূর্যের পরিধি নির্ণয় করেছিলেন। তার হিসেবে সূর্যের পরিধি পৃথিবীর প্রায় ২৭ গুন। তবে দুঃখজনকভাবে সঠিক হিসেবে সূর্যের পরিধি পৃথিবীর ১০৯ গুন বড়।