সাহিত্যছোট গল্প

চেতনায় সুখ

বাবলু দা- একজন বোকা ধরনের সরল মানুষ। সরল মানুষেরা বোধহয় বোকাই হয়।

অন্যরা কিছু বললে সায় ধরে চলেন বেশি, সেটা ঠিক বা ভুল। 

তার গল্প বর্ণনায় পারদর্শীতা আছে বেশ। যেখানে বসবেন গল্প বলে যাবেন – সে শ্রোতা মনোযোগী হোক বা নাহোক। এমন লোক কম ই আছে যে, শ্রোতা অমনোযোগী হলেও সেটা খেয়াল করে, পুরাদমে নিজের সমস্ত ঢেলে গল্প বলে চলে।

গ্রামের এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের লোক বয়স হবে ৩৯ ছুঁই ছুঁই। দুইটা ছেলে (বয়স ওদের ৬বছর, ১২বছর) আর এক বউ নিয়ে সংসার তার। বাবা মা আগেই মারা গেছেন। বাপের জমিজমা যা আছে অল্প ফসল আসে, নিত্য পরিশ্রম করে সংসার চালায়। বউ টা ভালো এবং সরল ও তবে স্বামীর মত অতটা বোকা নয়। শশুর শাশুড়ীর অবর্তমানে ননদদের বেশ আপ্যায়ন করে, খোঁজ খবর রাখে। যদিও বাবলু দা’র টানাটানির সংসার তবু বোনদের বছরে দু বার একসাথে করেন নিজের বাড়িতে।

 

অভাবের সংসার তার। এবার ঈদেও দুই ছেলে তাদের মায়ের কাছে আবদার করে পোশাক এর জন্য। বড় টা বলে দুইটা শার্ট, দুইটা ট্রাউজার আর একটা জুতা কিনে দিতে হবে তাকে। কারণ জমানো সব টাকা নিয়ে নিছে তার মা। বড় ছেলেটা মেধাবী ছাত্র, ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক ভাবনা ও প্রশ্ন তার। ছোট ছেলেটি ও ওমনি করে বলে ভাইয়া কে দিলে আমায় ও সব দিতে হবে। পিচ্চিটার একটা বিশেষ বৈশিষ্ঠ সে প্রচন্ড গরমে সবসময় টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরে থাকে। আর শীতে অতি ক্ষুদ্র বসন তার পরনে থাকে।

 

ফিরে আসি বাবলু দা’র সেদিনের ঘটনায়। বউ কে সাথে নিয়ে মার্কেট থেকে ফিরছিলেন, পথিমধ্যে মনে পরে গরুর ভুসি কিনতে হবে।

৪০০ টাকার ভুসি কিনে দোকানদার কে ১০০ টাকার ৬ টি নোট ধরিয়ে দেয়। বউ খেয়াল করে চিমটি কেটে বলে এই!! টাকা দু’শো বেশি দিলে কেন?

বাবলু দা বোকামি টা বুঝতে পেরে একটু জোরেই দোকানী কে শুনিয়ে বলে, আরে বউ! টাকা বেশি দিয়েছি তো ইচ্ছে করেই সে এলাকার ভাই আমার টাকা আমাকেই দিবে। দেখো তবু স্বীকার করবে না উনি হিসেবে কাঁচা।

 

বউকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে নিজের কাজ সেরে বিকেলে বাড়ি ফিরলেন।

বাড়ি ফিরতেই ঝড় শুরু হয়। ঝড় থেমে এক পশলা বৃষ্টি। টিনের চালায় সে বৃষ্টির মন ভুলানো শব্দ তার ক্লান্ত শরীরে ঘুম এনে দেয়। ছেলে দুইটা মেঝেতে বসে খেলা করছে। সূদুরে বসে বউটি তরকারি কাটছে আর ছেলেদের খেলা দেখতেছে।

বৃষ্টি একটু কমতেই ছেলে দুইটা ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পরে সরকার বাড়ির আমবাগানে আম কুড়াতে। যদিও আম কম ছিলো সেবার, তবুও ব্যাগ ভর্তি করে আম নিয়ে বাড়ি ফিরে। গ্রামের ছেলেদের অন্যতম একটা গুণ আছে যেখানে কিছুই থাকে না সেখান থেকেও সম্ভাবনার দ্বার খুলে ফেলতে পারে।

যখন বাড়ি ফিরে তাদের মা ঘরের জানালার পাশে পাতা বাঁশের চাটাই – এর উপর বসে ছিলো। ওই জায়গাটা তাদের অবসর সময় পার করার স্থান। চারদিকে জঞ্জালে আচ্ছন্ন কয়েকটা বড় মেহগনি গাছের ছায়া মাঝখানে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ। কিছুটা চোখ স্থির করলেই আত্রাই নদীর চলন আর পাখির কলরব সব মিলিয়ে সপ্নের জগতে ভাসে এই পরিবার।

 

ছেলে দুইটা মায়ের সাথে গল্প করছিলো কে কিভাবে আম খাবে, মেখে নাকি আচার করে। আবার কখনও বলছে জানো মা সরকার বাড়ির গিন্নমা নাকি পায়ে ব্যাথা পাইছে আমারে কইলো, এই ছোড়া কাল কিছু কাজ করে দিস তো সবজি বাগানে তোর বাপের টাকার সাথে কিছু টাকা বাড়িয়ে দিবো। যে টাকা দিবে আমরা নানুবাড়িতে দই মিষ্টি নিয়ে ঘুরতে যাবো, কতদিন নিয়ে যাও না। এসব গল্পই চলছিলো। গল্পের মাঝে ওদের মা বলে তোরা যা করিস করবি কথা জোরে বলিস না। জানিস তো তোদের বাবা সারাদিন খাটুনি খেটে এসে শুয়েছে, মানুষটা ঘুমাক একটু।

ওদিকে বাবলু দা’র ঘুম কিছুক্ষণ আগেই ভেঙ্গে গেছে। জানালায় দৃষ্টি রেখে বউ ছেলেদের কথা শুনতেছিলো।

বাবলু দা’র গলা শোনা যাচ্ছে।

তোরা মা-ছেলেতে মিলে আমাকে এক দন্ড আরামে ঘুমাতে ও দিবি না। হয়ত বউ এর সোহাগী আলাপ শুনেই এমন বলার আস্কারা পেয়েছিলো।

 

দুদিন পরে, কাজ শেষ করে একটু রাত বেশি করেই বাবলু দা ঘরে ফিরে। ছেলেগুলা ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে আসে। খাবার খেয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলে, “বউ টা আমার”পানের বাটা নিয়া আসো তো। দাদীমাদের মত পানের বাটা নিয়ে এসে বিছানার এক পাশে বসে পান বানিয়ে দিতে দিতে বলে দেখো,,একটু বড় ছেলেটার দিকে মন দাও তুমি। গ্রামের কত মানুষ আমারে কয় রনির মা, এত মেধাবী ছেলে তোমার। ছেলেটারে ইস্কুলে দিছো প্রাইভেট দাও না কেন?

প্রাইমারিতে না হয় পড়া সহজ ছিলো সবসময় প্রথম হয়েছে। এবার ক্লাস সিক্স এ উঠে গেছে এবার তো দাও।এভাবে অনেক্ক্ষণ অবধি রাজী করানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়।

 

বাবলু দা বলে সবই তো বুঝি রে গিন্নী, কিন্তু এই কটা টাকায় যে আর কুলায় না। এই যে সবাই কয় যে আমার ছেলে মেধাবী, দেখবি এমনেই ভালো করবে। গেরামের শিক্ষিত মানুষের ছেলে মেয়েও পারবো না। 

বউ চুপ রয় চেষ্টায় ব্যাহত আশাহীন হয়ে। বাবলু দা সংসার এর টানাটানি রোধে রাতে ও কাজ করে বাড়িতে বসে।

বউ এর নিরবতা খেয়াল করে। বউ এর মন খারাপ হয়ে গেছে। বাবলু দা বলে, এই বউ আমার ব্যাগটা আনো তো। বউ গিয়ে ব্যাগটা এনে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে বলতেছে কেউ মোবাইল, লাইট ঠিক করার কাজ শেষ করে দ্রুত ঘুমালে ধন্য হই। আপনার আবার এটা নাও জানা থাকতে পারে আমায় রাত ৩ টায় উঠে ধান সেদ্ধ করতে হবে। বাবলু দা’র বুঝতে বাকি রইলো না কতটা বেশি অভিমানে আপনি বলতেছে, সাথে পরোক্ষ কথার টান।বাবলু দা একটা মোড়ানো প্যাকেট বের করে বউকে ডাকে। এক্টু উঠো, কিছুক্ষণ পর ঘুমাও। বউ বলে, এই রাত্তিবেলা কি শুরু করা হইছে আমায় কি কেউ শান্তি তে ঘুমাতে দিবে না বলেই ঠিক করছে। প্যাকেট থেকে একটা গোলাপি রঙের শাড়ি বের করে দিয়ে বলে, বউ জানিস তো আমার সামর্থে কুলায় না একটা ভালো কাপড় দিতে পারি না তোকে। এই নে এই শাড়িটা পরে দেখা তো দেখি কেমন লাগে আমার গিন্নীকে। আরো এনেছে দু আনা দিয়ে তৈরি সোনার দুটো কানের দুল। বউটির দিল তখন এক্টু নরম হয়ে যায়। বলে উঠে, এত টাকা পাইলা কই? বাবলু দা বলে তোমাকে ওত ভাবতে হবে না এটা বিশ্বাস আছে তো তোমার স্বামী নিজের ইনকাম কম হলেও কারো কাছে হাত পাতে না বা অন্যায় করে না। বউ খুব খুশি হয় শাড়ি আর দুল পরে আসে।তাদের মনে পড়ে যায় পুরোনো কথা। বিয়ের পরপর কত ইচ্ছে আহ্লাদের কথা…..

কথার সুরে শেষ হয় তাদের স্মৃতিচারণ।

আমাদের যান্ত্রিক আধুনিকতার জীবনে আজকাল আমরা অফিস, আদালত শেষে পার্টি,বন্ধুদের সাথে আড্ডা, টিভি দেখা, ফেসবুকিং এ সময় দিয়ে কখন ঘুমাই ঠিক থাকে না। কখনও বা নিদ্রাহীনতায় রাত কাটে অথচ বাবলু দা’র মত মানুষ দিনে পরিশ্রম এরই মাঝে চা নাস্তা, কাজের সঙ্গীদের সাথে গল্প বাড়ি ফিরে খেয়ে অনায়াসে একটা শান্তির ঘুম দিতে পারে।আর কি চাই এক জীবনে। 

 

কিছুদিন পরের কথা,,

বাবলু দা সেদিন দুপুরেই  কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে। দুই ছেলেকে নিয়ে ঘুড়ি বানানোর কাজে ব্যস্ত। এর মাঝে বউ এসে দু চারটে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে যে এমনভাবে চললে হবে নাকি, আমি এক মিনিট বসতে সময় পাচ্ছি নে, বলি গরু টাকে একটু খড় দিলেও তো পারে নাকি!!

 

হঠাৎ পাশের বাড়ির মাস্টারের বউ হাসতে হাসতে এলো। হ্যাঁ গো অনিকের মা-জানো না নাকি, আজ তোমার ছেলের পরীক্ষার ফল বের হইছে। বাবলু দা ঘুড়ি রেখে দ্রুত এগিয়ে আসে পিছনে  বড় ছেলে ধীরলয়ে আসছে।কি না কি হয় ভেবে।

বাবলু দা বলে, তা কি ফলাফল আসছে জানো নাকি মাস্টারের বউ? বউটি বলে প্রতিবারের মত এবারও তোমাদের ছেলে প্রথম হইছে। একটা ছেলে হইছে তোমাদের। হাই ইস্কুলে পাশাপাশি কয়েকটা এলাকার ৩০০ জন ছাত্রের মধ্যে প্রথম হইছে কম কথাটি নয় গো।

 

বাবলু দা আর তার বউ এর খুশি যেন ধরে না। ছেলে কে কাছে নিয়ে আদর করে বলছে, দেখো গিন্নী! কইছিলাম না আমার ছেলে এমনেই প্রথম হইবো! হইয়া দেখাইছে। সারাদিন যে কাজই করছে মনে যেন তাদের অন্যরকম ভালো লাগার আবেশ। সবাই বলাবলি করছে, তাদের ছেলের প্রশংসা করে।

 

এই ছোট্ট ছোট্ট খুশিতে চলতে থাকে জীবন। 

কখনো আনাড়ি গল্পে আবার কখনও বা জীবন যুদ্ধে।

অপূর্ণতা যেন কিছুতেই হৃদয় কে ছুঁতে  পারে না। কি নেই সেটা নিয়ে ভাবনা নেই অল্পেই ভালো থাকা তাদের।নেই অট্টালিকায় থাকার স্বপ্ন না আছে বিলাসবহুল জীবনের আশা।

এভাবেই চলছে স্নিগ্ধতায়, মমতায় সিক্ত হয়ে মায়ার এই বন্ধন। 

 

লেখক

নাসরিন আখতার

পদার্থ বিজ্ঞান,

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

5 thoughts on “চেতনায় সুখ

  • Masum Rana Raju

    সুখ বড়ই অদ্ভুত অনুভুতি । কেউ অল্পতেই সুখি কেউবা সব পেয়েও অসুখি। কোন এক গানে শুনেছিলাম “সবাই তো সুখি হতে চাই” কিন্তু আসলেই কি সবাই সুখ খুজে পাই? পাইনা কারন “দেয়ার ইজ সামথিং দ্যাট মানি ক্যানট বাই”। আমাদের যা নেই সেখানে সুখ খুজতে গিয়ে আমদের যা আছে তার সুখকে উপলব্ধি করি না যার কারনে আজ আমরা সুখি নই। পরিপূর্ণ সুখ বলতে কি বোঝায়, তা নির্ভর করে মানুষের চাহিদার ওপর। তবে কোনো সময় মনে হতে পারে, আপনি এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। তখনই হয়তো সুখের মাত্রা পরিপূর্ণতা পায়। এই অনুভূতির চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত আর হতে পারে না।আপনি আপনার গল্পের মাধ্যমে আসম্ভব সুন্দর ভাবে এই বিষয়টিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। আশা করছি এরকম আরও অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প পাব আপনার কাছ থেকে ইনশাল্লাহ।

    Reply
  • ধন্যবাদ আপনাকে🥰ইন শা আল্লাহ আরো লিখবো আপনাদের সাপোর্ট পেলে

    Reply
    • Masum Rana Raju

      দোয়া আপনার জন্য🙂

      Reply
  • Najnin Naj Rita

    Bandhobi darun hoice💖💖💖

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link