মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির ইতিহাস পর্ব – ৫
আজকের পর্বে, শ্রীকৃষ্ণ আচার্যের দ্বিতীয় পুত্র হরিনাম আচার্যের তৃতীয় পুরুষ রামকিশাের এবং তার বংশধরকে নিয়ে আলােচনা চলবে।
রামকিশাের আচার্য চৌধুরী
১৮৩০ সালে জন্ম শ্রীকৃষ্ণের আচার্যের দ্বিতীয় পুত্র হরিনাম আচার্যের তৃতীয় পুরুষ হলেন রামকিশাের। তিনি প্রচণ্ড তেজস্বী ও শক্তিমত্তার অধিকারী ছিলেন। সর্বসাধারণের সুবিধার বিষয়টি তিনি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতেন। বর্তমানে মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ি হিসেবে যে অংশটুকু রয়েছে সেখানেই হরিনাম আচার্যের বংশধর অর্থাৎ রামকিশাের বসবাস করতেন এবং তার অংশের জমিদারী পরিচালনা করতেন।
শ্রীকৃষ্ণ আচার্য তৃতীয় পুত্র, বিষ্ণুরাম আচার্যের চতুর্থ পুরুষ দুর্গাদাস বাবুর তৈরি দেওয়ালে, সর্বসাধারণের যাতায়াতের জন্য রাস্তা বন্ধ করে দিলে রামকিশাের তা ভেঙ্গে ফেলে। যার ফলে দুর্গা দাস এর সাথে রাম কিশােরের মনােমালিন্য ছিল।
তৎকালে মুক্তাগাছার জমিদারগণ এমন এক বৈরীতায় অবস্থান করতেন যে এক পর্যায়ে তারা একে অপদের মুখ দেখাদেখি করতেন না। তারা ধর্মীয় উৎসব আলাদা আলাদা ভাবে উদযাপন করতেন। তাই সরকার ফরমান জারি করলেন যে, রাজরাজেশ্বরী মন্দিরে যখন জমিদাররা পশু বলি দিবেন তখন সরকারি নাজির উপস্থিত থাকবেন। সে আমলে নাজির হলেন সরকারের একজন বিশেষ আমলা।
| রাজরাজেশ্বরী মন্দিরে বলির দিন হঠাৎ বিবাদ শুরু হলাে কে আগে অর্থাৎ কোন জমিদার আগে বলি দেবেন তা । | নিয়ে। হুট করেই সরকারি নাজির, বিষ্ণুরাম আচার্যের বংশধরদের দায়িত্বে থাকা জমিদারির পক্ষে প্রথম বলি হবে। বলে ঘােষণা করেন। এতে উপস্থিত থাকা রামকিশােরের আদেশে শেষ পর্যন্ত সেই নাজির কে বলি দেওয়া হয়েছিল!
| রাম কিশাের ১৮৬০ সালে বিদ্যাময়ী দেবীকে বিয়ে করেন। তার ছােট বড় সব সন্তান অল্প বয়সে মারা যায় বেঁচে থাকেন শুধু জগৎ কিশাের। আসলে রামকিশাের ছিল হরিনাম আচার্যের দ্বিতীয় পুরুষ গৌরিকিশাের আচার্য ও চন্দ্রাবলী দেবীর দত্তক পুত্র। রামকিশাের এর আসল বাবা ছিল গগন চৌধুরী। ফলে রামকিশাের গগন চৌধুরীরও সম্পত্তি লাভ করে। কিন্তু | নিকটাত্মীয়রা অভিযােগ করলাে রামকিশাের অসিদ্ধ। রামকৃষ্ণ ছিল প্রচন্ড জেদী এবং একরােখা মানুষ। তিনি প্রতিপক্ষের সাথে মামলা চালিয়ে যান একা ও নিজ বুদ্ধিতে। কিন্তু মৃত্যুর আগে মামলার ফলাফল দেখে যেতে পারেননি
সাহসী ও সংগ্রামী দুর্জয় ছিলেন রামকিশাের। অনেকটা রাগী দাম্ভিক ও নিষ্ঠুর ছিলেন। জমিদারদের প্রজার | নিপীড়নের দৃষ্টান্ত হিসেবে এবং সরকারি নাজির বলি দেয়ার জন্য রামকৃষ্ণ নামটি সঙ্গে অনেকটা লােমহর্ষক ঘটনা জড়িয়ে আছে।
১৮৭৫ সালে রামকিশাের মৃত্যুবরণ করে।
রাম কিশাের মৃত্যুর পর তার জমিদারী চলে যা কোর্ট অফ ওয়ার্ডস এর অধীনে। বিদ্যাময়ী দেবী তার নিজের জমিদারির অংশে ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্কুল গুলাের মধ্যে একটি। বিদ্যাময়ী দেবী ১৯০৯ সালে কাশীধামের মৃত্যুবরণ করেন!
জগৎ কিশাের আচার্য চৌধুরী
রামকিশাের আচার্যের পুত্র জগঞ্জ, কিশাের ১৮৬৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম লিখে রেখেছিলেন মা বিদ্যাময়ী দেবী। তার বাবা মারা যায় ১৮৭৫ সালে এবং সেও তখন নাবালক। তাই সম্পত্তি চলে যায় কোর্ট অফ ওয়ার্ডস এর কাছে। রামকিশাের এর বংশের অন্যদের সাথে ভালাে সম্পর্ক না থাকায় জগৎ কিশাের বিব্রতকর অবস্থায় বিরাজমান ছিলেন। বিদ্যাময়ী জগৎ কিশােরকে ভর্তি করিয়ে দিলেন কলকাতার বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউট এ। তিনি নিয়মিত ব্যায়াম চর্চা, ঘােড়ায় চড়া, কুন্তি লড়া অভ্যাস রপ্ত করেন। কিছু সময় পর তিনি কলকাতা থেকে এসে | ময়মনসিংহ সরকারি স্কুলে ভর্তি হন। পড়াশােনার পাশাপাশি তিনি বাড়ি ফিরে প্রজাদের কাছে ছিলেন এক নম্বর সারিতে। প্রজাসাধারণের কল্যাণ সাধনের প্রতি তিনি এক ধরনের দায়বদ্ধতা অনুভব করতেন।
১৮৮০ সালে ১৭ বছর বয়সে রাজবালা দেবীকে বিয়ে করেন। ১৮৮৪ সালে জগৎ কিশাের তার বাবার উত্তরাধিকার মামলায় জিতে যায়, এবং ওই দিনই জন্ম লাভ করেন তার সন্তান। তাই তিনি তার নাম দেন জিতেন্দ্র কিশাের।
এছাড়াও জগৎবাবুর আরাে তিন সন্তান ছিল: ১. বীরেন্দ্র কিশাের ২. নৃসিংহ কিশাের | ৩. ভূপেন্দ্র কিশাের
বীরেন্দ্র কিশােরকে শিবরাম আচার্য চতুর্থ পুরুষ সূর্যকান্তকে দত্তক দেন। ১৮৯০ (মতান্তরে ১৮৯৪ সালে নিজ | জমিদারীর উপর বাবার নাম অনুসারে মুক্তাগাছায় আর কে স্কুল” বা “রামকিশাের স্কুল” প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি | যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন পর্যন্ত এই বিদ্যালয়ের সকল ব্যয়ভার এককভাবে বহন করতেন।
ময়মনসিংহের আনন্দমােহন মহাবিদ্যালয়কে তিনি একবার এককালীন ১০ হাজার টাকা প্রদান করেন।
১৯০৪ সালে বীরেন্দ্র কিশােরকে ইংরেজ সরকার রাজা উপাধি দেন। ধর্মের দিক থেকে তিনি ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য বেশি দিতেন। পারিবারিক দেবদেবীর উপর অগাধ বিশ্বাসের বিশ্বাসী ছিলেন এবং প্রচুর দান করতেন। গ্রামের মােড়লদের নিয়ে আজ্ঞা দিতেন। তিনি শ্রীজানলক্ষী নামক এক বাইজির নিকট গানের তালিম এর জন্য গিয়েছিলেন। ফলে মা বিদ্যাময়ী রাগ করেন। তাই বাকি জীবনে তিনি আর কোনদিন মদ ও বাইজি স্পর্শ করেননি। জগৎ কিশাের আচার্য চৌধুরী প্রচুর দান করতেন এবং তার দান ছিলাে গরিব প্রজাদের জন্য। তিনি প্রতিদিন সকালে ঘােড়ায় চড়ে বেড়াতেন।
রাজার জন্য বিভিন্ন জায়গায় গরিব প্রজার অপেক্ষা করতেন গােপন সাক্ষাতের জন্য। এর মাধ্য দান করে যেতেন। রাজা জগৎ কিশাের ৬৫ বছর বয়সেও ঘােড়ায় চড়ে বেরিয়েছেন নিয়মিত। নিজেই হাতি চালনা করতেন একজন দক্ষ মাহুতের মত। বাড়িতে চার-পাঁচজন পাঞ্জাৰি পালােয়ান মাসিক মাহিনা দিয়ে রাখতেন। রাজা ৫৪ বছর বয়স পর্যন্ত কুস্তি লড়েছেন। মহারাজ সূর্যকান্ত যেমন পাকা শিকারি ছিলেন জগৎ বাবু তেমনি শিকারি ছিলেন। হাতি, তাঁবু, ঠাকুর, চাকর-বাকর, গরুর গাড়ি, ওষুধপত্র নানা জিনিসপত্র সহ দুই তিন শত লােক নিয়ে শিকার নাতে যেতেন। তিনি শিকার করতে সিলেটের পশ্চিমে তরাই নামক একটি স্থানে যেতেন।
১৯২৬ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার মা এর প্রতিষ্ঠিত বর্তমানের বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা প্রদর্শন করতে আসেন। ৬৮ বছর বয়সে তার শারীরিক অসুস্থতা দেখা যায় এবং দুঃখজনকভাবে তিনি চোখের দৃষ্টিও হারিয়ে ফেলেন।
১৯৩৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।