নরখাদক বাঘিনীর হিংস্রতা
সাধারণত বাঘের খাদ্যতালিকায় মানুষের উপস্থিতি নেই। কিন্তুঅনেক সময় বাঘ সত্যিই মানুষখেকো হয়েওঠে।
একটি বাঘ যখন বুড়ো হয়ে যায় অথবা কোন যুদ্ধে শরীরের কোন অঙ্গহানি হয়- যার ফলে খাদ্যতালিকায় থাকা পছন্দের প্রানীগুলো শিকারে অক্ষম হয়ে পড়ে, তখন সে অপেক্ষাকৃত সহজ শিকার খুঁজতে থাকে।
আজ আমরা জানবো এক দুর্ধর্ষ পিশাচ বাঘিনীর কথা যে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে স্থান করে নিয়েছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মানুষখেকো বাঘ হিসেবে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে নেপালে এক মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব শুরু হয়। পেশাদার শিকারি ও লেখক পিটার বার্ন লিখেছিলেন, বাঘটি প্রথমে পশ্চিম নেপালের হিমালয় অঞ্চলের রুপাল নামের একটি গ্রামে মানুষ শিকার শুরু করে।
পরবর্তীতে জানা যায় এটি একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার বাঘিনী। প্রকাশ্য দিবালোকে অতর্কিত আক্রমন করার অভ্যাসে গ্রামবাসীকে পৈশাচিক আতঙ্কে ফেলে দেয় এই নরখাদক।
এভাবে ধীরে ধীরে একটি দক্ষ শিকারি হিসেবে বেশ পরিচিতি লাভ করতে থাকে সে। একে একে দুইশোর মতো মানুষ প্রাণ হারায় এই বাঘিনীর থাবায়।
এরপর নেপালের রাজসভা একে থামানোর সিদ্ধান্ত নেয়। একদল দক্ষ শিকারি পাঠানো হয় একে হত্যা করতে। কিন্তু এই পিশাচিনী এতটাই দুর্ধর্ষ ও নিপুন শিকারি হয়ে উঠেছিল যে গেরিলা কৌশলে পুরো শিকারি দলকেই একে একে হত্যা করে মানুষের মনে অদ্ভুত আতঙ্ক জুড়ে দেয়।
শেষমেষ নেপালের সেনাবাহিনীকে এই বাঘিনী হত্যার দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়। সেনারা তাকে হত্যা কিংবা বন্দী করতে না পারলেও বেদম এক দৌড়ানি দিতে সমর্থ হয়েছিল। এর ৩৪ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা কুখ্যাত ডেরা থেকে খেদিয়ে তাকে সীমান্ত পার করে দেয়া হয়।
নেপাল থেকে বিতাড়িত হয়ে শুরু হয় মানুষখেকো বাঘিনীর আসল নারকীয় তাণ্ডব। সে আস্তানা গাড়ে ভারতের কুমায়ুন জেলায়। প্রতিনিয়ত এর থাবায় প্রান হারাতে থাকে মানুষ।
মূলত নারী এবং কিশোর-কিশোরীরাই ছিল এর প্রধান টার্গেট। এই বাঘিনী দিনের বেলা শিকারে অভ্যস্ত ছিল। কেউ বনে কাঠ আনতে গেলে, গরু-মহিষ চড়ানো রাখাল কিংবা ফসলের ক্ষেতে কাজ করা পুরুষরাও তার হাত থেকে নিরাপদ ছিলনা।
বাঘিনীটি ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের দক্ষ শিকারি। জাতে বেঙ্গল টাইগার হলেও এর স্বভাব চরিত্র হয়ে উঠেছিল সাইবেরিয়ান বাঘদের মতো। অপেক্ষাকৃত বড় ব্যাস নিয়ে ছিল তার বিচরণ এলাকা।
প্রধান ডেরা গড়েছিল চম্পায়াত শহরের আশপাশের গ্রামগুলোতে। তাই সে চম্পায়াতের বাঘিনী হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে কুমায়ুনের এই পিশাচ বাঘিনীর আতঙ্কে চম্পায়াত সহ আশেপাশের বিশাল এলাকার জনজীবন পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। দিনের বেলায়ও মানুষ ঘরের আশে পাশে থেকে দূরে কোথাও যাওয়া বন্ধ করে দেয়।
অবশেষে বিখ্যাত ব্রিটিশ শিকারি জিম করবেট চম্পায়াতের এই কুখ্যাত প্রেতাত্মার বিষয়ে আগ্রহী হন। ১৯০৭ সালে তিনি মানুষখেকো এই বাঘিনীকে হত্যা করতে সফল হন।
একদিন চম্পায়াত শহরের অদূরে ফানগড় নামের গ্রামে প্রানকা দেবী নামের এক কিশোরীকে শিকার করে নিয়ে যায় বাঘিনীটি। জিম করবেট রক্তের চিহ্ন দেখে বাঘিনীকে অনুসরণ করতে থাকেন। অবশেষে তিনি একটি জলাশয়ের কাছে খাঁজে মেয়েটির আধা খাওয়া মরদেহ দেখতে পান।
তিনি লাশটি পরীক্ষা করে দেখছেন- এমন সময় অতর্কিত ক্ষিপ্রতায় মানুষখেকো পিশাচ তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। তিনি কোনোমতে রাইফেল থেকে দুই রাউন্ড গুলি করে বাঘিনীকে কিছুটা ভয় পাইয়ে দিতে সমর্থ হন।
সে যাত্রায় তিনি এটিকে শিকারের আশা ছেড়ে পালিয়ে আসেন। তিনি বুঝতে পারলেন এটি কোনো সাধারণ মানুষখেকো নয়। দীর্ঘ শিকারি অভিজ্ঞতা ও শতশত প্রানের স্বাদ তাকে ভয়ানক পিশাচে পরিণত করেছে।
পরদিন তিনি বাঘিনীকে হত্যায় সাহায্যের জন্য এলাকার তহসিলদারকে কামনা করেন। অবশেষে তিনশো জন গ্রামবাসীর একটি দল গঠন করা হয়। চম্পা নদীর পাড়ে এই নরঘাতককে ঘেরাও করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
অবশেষে দুপুরের দিকে আবার এই বাঘিনীর দেখা মেলে। করবেট তার রাইফেল থেকে নির্ভুল নিশানায় গুলি করেন। প্রথম গুলিটি বাঘিনীর বাহু ও বুকের মাঝ বরাবর লাগে। দ্বিতীয় গুলিটি করা হয়েছিল তহসিলদারের রাইফেল থেকে।
ট্রিগার চাপার সময় বাঘিনী করবেটকে হত্যার জন্য লাফ দেয়। নির্ভুল নিশানা ও শক্তিশালী রাইফেলের গুলিতে মাত্র ছয় মিটার দূরে এই পিশাচ বাঘিনীর পতন হয়।
জিম করবেট তার কুমায়ুনের মানুষখেকো শীর্ষক বইয়ে চম্পায়াতের এই বাঘিনী হত্যার অভিজ্ঞতা লিখেছেন। তার কাছে এটি ছিল তার দীর্ঘ জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শিকারি অভিজ্ঞতা। এই শিকার জিম করবেটকে সবচেয়ে সেরা মানুষখেকো বাঘ শিকারীর মর্যাদা উপহার দেয়।
হত্যার পর মানুষখেকো বাঘিনীর মৃতদেহের পোস্টমর্টেম করা হয়। এর বয়স হয়েছিল দশ থেকে বারো বছর। বাঘিনীর একপাশের বড় শিকারি দাঁত দুটোই ভাঙ্গা ছিল।
একই পাশের চোয়ালের হাড়ও ছিল ভাঙ্গা, যা সম্ভবত কোনো শিকারীর গুলির কারনে হয়েছিল। এই দুর্বলতার কারণে এটি স্বাভাবিক খাদ্যতালিকা থেকে বেরিয়ে এসে মানুষ মারা শুরু করে।
চম্পায়াতের এই পিশাচ বাঘিনী তার জীবদ্দশায় মোট ৪৩৬ জন মানুষকে হত্যা করে। গিনেস ওয়ার্ল্ড বুকে এই বাঘিনী সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ হত্যার কুখ্যাত রেকর্ড নিয়ে এখনো শীর্ষ স্থান দখল করে আছে।