হাসানের একদিন
হাসান। বেকারদের নামটি নিতেও সমস্যা, এলাকায় তো বলাই যাবে না, আর যদি কখনো নাম উচ্চারিত হয় তবে আওয়াজ আসবে কোন হাসান, ওই যে কোন কাম কাজ নাই সারাদিন ঘুরে। হাসান হয়তো প্রতিবাদ করে বলতে পারতো কাজের জন্যই তো ঘুরে। কিন্তু, এই কথা বলার সামর্থ্য নেই। কারণ, তার পর তার কাছে বলার মত কোন উত্তর নেই।
যা হোক, সেই হাসানের নিয়মিত কাজ ১১ টায় বাহিরে যাবে কাজ খুঁজবে বলে। কিন্তু কি কাজ খুঁজবে সেটি সে এখনো ভাবছে। একবার স্কুলের সামনে দিয়ে যখন যায় তখন ভাবে যাই স্কুলে গিয়ে কথা বলে আসি তাৎক্ষণিক মাথায় চিন্তা আসে স্কুল কেন ? আমি কি এই বয়সে বাচ্চা ছেলে পেলে সামলাব নাকি?
কাল রাতে ঘুমাতে যাবার আগে পকেট চেক করতে গিয়ে দেখেছে সেখানে কিছু নেই। বাবার কাছ থেকে ২ দিন আগেই ২০০ টাকা নিয়েছে তা দুইদিনেই শেষ। এখন চাইতে গেলে একশ একটা কথা শুনিয়ে বলবে তোকে রিক্সা কিনে দেই চালা তাও কিছু টাকা আনতে পারবি ফেরত। হাসান চিন্তা করবে কিন্তু বলবে না গ্রেজুয়েটরা এসব কাজ করে না। কিন্তু, কিছু একটা তো করতে হবে ? কি করবে?
আজ শুক্রবার, হাসান ভাবল আজ কি বাইরে যাবে ?
শেষ পর্যন্ত সে বের হল, আজ কি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাবে কিনা ভাবতে ভাবতে রাস্তায় মোড়ে পৌঁছাল; সেখানে এক রিক্সা চালক তার ভাড়া নিয়ে ঝগড়া করছে, ১০ টাকা তাকে বেশি দিতে হবে আর যাত্রি তার সুবিধা মত নানা কারণ দেখাচ্ছে, দেখতে দেখতে যাত্রী মেজাজ হারিয়ে রিক্সা চালাককে লাগিয়ে দিল ঘুষি। রিক্সা চালক গেল উল্টে পড়ে , চালক রাস্তা থেকে উঠে যাত্রিকে কিছু না করে , তার সিট উঠাতে লাগলো কিছুক্ষণের ভেতর সিটের নিচ থেকে বেরিয়ে এল আধ হাত সাইজের একটা চাপাতি, চাপাতি দেখে যাত্রি, ‘এই এই ‘ বলে দিল হাসানের দিকে দৌড়। হাসান ও লোকটাকে তার দিকে দৌড়াতে দেখে সেও কি করবে না বুঝে দৌড় লাগাল, কিন্তু সামনের ইটে হোঁচট খেয়ে গেল পড়ে। তার হাতে থাকা মোবাইলটি গিয়ে লাগলো দ্রুত গতিতে আসা একটি মটর সাইকেলের চালাকের গায়ে। চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেলো রোড সাইড গাছে । হাসান ও গেল রাস্তায় পড়ে। রাস্তায় বসে থেকে সে খেয়াল করল মটর সাইকেলটি একা ছিল না তার পিছে ছিল, পুলিশের গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে পুলিশের ৫-৬ জন সদস্য তার দিকে আসছে, হাসান ভাবল একটা দৌড় দিবে কিনা! ভাবতে ভাবতে পুলিশের একজন অফিসার তার কাছে এসে তার হাত ধরে উঠিয়ে বলল, আপনাকে ধন্যবাদ, আপনি এমন একজনকে ধরেছেন, ভাবতে পারবেন না আপনি কি করেছেন। পুলিশ অফিসার হাসান কে তাদের সাথে থানায় যেতে বলল, হাসান তাদের সাথে থানায় গেল। সেখানে হাসানের খাতিরের জন্য হরেক রকম আয়োজন, অফিসার তো নিজের সিটই ছেড়ে দিলেন হাসানকে বসার জন্য। হাসানের সব কেমন এলোমেলো লাগছে, সে পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞাসা করল, ছিনতাইকারি কে ছিল যে আমার এত খাতির করা হচ্ছে? পুলিশ অফিসার সমাদর করে বলল, আপনি জানেন না আপনি কি করেছেন? আপনি ইন্টারন্যাশনাল একজন স্মাগলার যে বিভিন্ন দেশ ঘুরে এখন বাংলাদেশে এসেছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ গুলো যেখানে তাকে ধরতে ব্যর্থ সেখানে বাংলাদেশে এসে সে ধরা খেলো। কথা বলতে বলতে অফিসারের মোবাইলে কল এল, অফিসার খুবই গম্ভীর ভাবে কথা বলে ফোন রাখল। হাসান জিজ্ঞাসা করল কোন সমস্যা ? অফিসার আরও বিনয়ী হয়ে বলল, না স্যার, কি যে বলেন? হাসান চমকিত হল, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো বেকার হটাত স্যার! অফিসার বলল, আপনাকে জাতীয় সম্মাননা দেবেন প্রধানমন্ত্রী। স্যার আপনাকে আজ ৪ টায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যেতে হবে। হাসানকে বিকেল ৪ টার আগেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে বড় বড় মন্ত্রী-সচিবরা , হাসান আগে কখনো এমন দেখেনি।
প্রধান মন্ত্রী বেরিয়েছিলেন বিশ্ব ভ্রমনে কিন্তু হাসানের বীরত্বের কথা শুনে আবার দেশে ফিরে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী হাসানকে সম্মাননা দিয়ে হাসানের বীরত্বের জন্য বড় একটি বক্তব্য দিলেন। ফেরার পথে হাসানের কাছে একজন মন্ত্রী দৌড়িয়ে এসে বলল, হাসান তোমার বীরত্বে আজ আমরা গর্বিত। তুমি কি আমার মেয়েকে বিয়ে করবে? হাসান কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না , সে বলল “আ” কিন্তু আশে পাশের কোলাহলে তা শোনা গেল “হ্যাঁ”। মন্ত্রী বেজায় খুশি হল, সে তাৎক্ষনিক বিয়ের আয়োজনে তোরজোড় শুরু করলেন। প্রথমেই গাড়িতে হাসানকে পাঠানো হল মন্ত্রীর বাসায় সেখানে বিয়ের সাজে সাজিয়ে তাকে কমিউনিটি সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হল।
কিছুখন পর সেখানে আনা হল মন্ত্রীর মেয়েকে। অপূর্ব সুন্দরী মেয়েটি প্রথমেই জাতীয় বীর হাসানকে সালাম করল। তার পর তার পাশে এসে দাঁড়ালো। হাসান দেখল সে বসে আর মেয়েটি দাড়িয়ে তাই সে ও দাঁড়াল।
রাতের ভেতর বিয়ে সম্পন্ন হল। বিয়ে শেষ হলে এবার হাসানের মাথায় চিন্তা এল সে কথায় নিয়ে যাবে বউকে। তার বাড়িতে যে রুমে সে থাকে সেটি বস্তি না বললে বেশি বলা হবে। একটা সিঙ্গেল চৌকি তাও আবার একটা পা ভাঙ্গা। ঘরে একজন মানুষ কোন রকম দাঁড়াতে পারে সেখানে সে কিভাবে বউকে নিয়ে যাবে? সে ফোন বের করে মাকে ফোন দিল কিন্তু ধরল বাবা, ধরেই গালাগালি শুরু করে দিল, এত রাতেও বাইরে তোর আর আসতে হবে না বাইরেই থাক। হাসান কিছু বলবার আগেই ফোন কেটে গেল। হাসান পড়ে গেল মহা বিপদে। হটাত, মন্ত্রী সাহেব তার শশুর মশাই আরকি এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার একমাত্র মেয়ে বাবা তোমার হাতে তুলে দিলাম। আমার তেমন কিছু উপহার দেবার মত নেই , তোমাকে উত্তরায় দুই বিঘা জমি আর ধানমণ্ডিতে ২ টা বাড়ি দিলাম। আমার মেয়েকে ভাল রেখো। তারপর এমন কান্না শুরু করল তা আর থামতেই চায় না ।
হাসান কিছুক্ষণ পর তার নব বিবাহিত স্ত্রী নিয়ে রওনা দিল ধানমণ্ডির দিকে, গাড়িতে হাসান আর তার বউ। এই প্রথম বার হাসান একটু চাপ মুক্ত হল একদিনেই সে ফকির থেকে কোটিপতি। সে তার বউ এর দিকে তাকায় মেয়েটি শুধু মুচকি মুচকি হাসছে। হাসুক তাতে তার কি!
সারাদিনের চাপে এখন হাসান ক্লান্ত হয়ে ঝিমুনি ভাব ধরল। সে এখন ঘুমাবে। হটাত, তার বউ পাশ থেকে বলে উঠল, কিরে ব্যাডা উঠ। সারারাত কি এইখানেই পইড়া থাকবি ?
হাসান চোখ খুলো কিসের বউ কিসের গাড়ি, সে ফুটপাতে আর তার মাথার উপর ঝুকে আছে দারোয়ান। হাসান বলল, আমি কোথায় ? দুনিয়াডা শেষ, ভদ্র ঘরের পুলাপান নেশা কইরা রাস্তায় মরার মত পইরা থাকে। বলতে বলতে দারোয়ান চলে গেল।
দারুয়ান চলে গেলে হাসান এদিক সেদিক তাকাল । পিছনে “জোনাকি সিনামা হল “।