ছোট গল্প

একাদশে বৃহস্পতি

গগনচুম্বী আমগাছটার শত বাধা উপেক্ষা করেও জানালা গলে আবছা জোছনা ঢুকছে। দ্বিতীয়ার ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ একটু পরেই ডুবে যাবে। তবুও প্রাণপণে তার সবটুকু আলো দেওয়ার চেষ্টা করছে। জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়ানো পঞ্চাশোর্ধ্ব রহিমা বেগমের মনে হয়, ‘দূরদেশের ওই চাঁদটা বুঝি সবচেয়ে সুখী! কখনো সে বুড়ি হয় না। আর পাশের ওই সন্ধ্যাতারা দাঁড়ানো, বুঝি ওর ছেলে। ওরা বুঝি গল্প করছে মা-ছেলে মিলে! রহিমা বেগমের খুব ইচ্ছা হয় ওদের গল্প শুনতে। ইচ্ছা হয় ক্ষণিকের জন্য চাঁদ হতে। 
কাজের মেয়ে ফুলি এসে খাবারের তারা দিয়ে যায়, ‘আম্মা ভাত খাইতে চলেন। রাত অনেক হইছে।’
‘তুই খা গিয়ে যা। সব খাইস! আর না পারলে ভুলু আর পুষুরে দিস’__রহিমা বেগমের রাগ ঝরে কথায়। 
‘ভাতের উপর রাগ কইরা লাভ নেই আম্মা। তাতে নিজেরই কষ্ট। বিয়া অইলে পোলা-মাইয়া পর অইয়া যায়। আর ভাইজান তো কইছে, আপনার নাতির পরীক্ষা, হের লাইগা নাও আইতে পারে এবার ঈদে। আহেন আম্মা, ভাত খাই’__ফুলি বলে। 
‘তুই সামন থেকে যা ফুলি।’ 
ফুলিকে বিদায় করে রহিমা বেগমের মনে হলো সত্যিই কি বিয়ের পর ছেলে-মেয়ে পর হয়ে যায়? স্কুল মাস্টারের ঘরনি হয়ে সারা জীবন কোন স্বাদ-আহ্লাদ ছিল না তাঁর। স্বামী যতদিন বেঁচে ছিলেন, শত অভাবেও তাঁর কোন দুঃখ হয়নি। তিন ছেলেমেয়ে আর স্বামী-স্ত্রী মিলে পাঁচজনের অভাবের সংসার। 
ঈদের কাপড় বলতে তাঁতের একটা শাড়ি। কম দামি তবুও ওইটুকু উপহার পেয়ে তিনি চোখের পানি আটকাতে পারতেন না। আজ আবার খুব করে স্বামীর কথা মনে পড়ছে রহিমা বেগমের। 
সুখের দিন দেখে যেতে পারেননি তাঁর স্বামী। ছেলেমেয়েরা আজ প্রতিষ্ঠিত। অবস্থাও ফিরেছে তাদের। রহিমা বেগমকে বলে সবাই ঢাকা গিয়ে থাকতে। কিন্তু তাঁর ঢাকায় মন টেকে না। এই ঘর, স্বামীর কবর ছেড়ে কীভাবে থাকবেন তিনি! ওদিকে নাতি সায়েদের জন্যও পরানডা পোড়ে।
দুই. 
আজ ঈদের দিন। নাতি সায়েদের পরীক্ষা, তাই এবার কেউ বাড়িতে আসবে না। তবুও রহিমা বেগমের আশা, ছেলেরা ঠিকই সকালবেলা এসে হাজির হবে। 
সকাল থেকেই ছেলে কী পছন্দ করে, ছেলের বউ কী ভালো খায়, নাতি সায়েদ যা পছন্দ করে সবই সকাল থেকে রান্না করছেন তিনি। দম ফেলার সময়টুকুও পাননি। একটু রান্না করেন আর পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বাড়ির কাছেই রেলষ্টেশন। এরই মধ্যে তিনবার ফুলিকে বাড়ির কাছে রেলষ্টেশনে পাঠিয়েছেন। তাদের খোঁজ নেওয়ার জন্য।
দিন গড়িয়ে সন্ধা। এখন রাত হতে চলল। তাঁর আশা একটু একটু করে ক্ষীণ হতে থাকে। সারা দিন একটা কিছুই খাননি তিনি। ষ্টেশন থেকে শেষ ট্রেন আসার শব্দ এসেছে অনেক্ষণ হলো। এবার বুঝি সত্যিই আর ওরা কেউ আসবে না। বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে তাঁর। কইলজ্যার মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। 
দূরের চাঁদটা আর পরিষ্কার দেখা যায় না; ঝাপসা মনে হয়।
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বসে আছেন রহিমা বেগম। নানা ভাবনা এসে ঘুর-পাক খাচ্ছে মনে। সবকিছু মূল্যহীন লাগছে তাঁর কাছে। এমন সময় আওয়াজ আসছে-
ক্রিং ক্রিং ক্রিং..
ক্রিং ক্রিং…
ফোনটা বেজেই চলছে। রহিমা বেগম ইচ্ছা করেই ফোনটা ধরছে না। 
ধরে আর কী হবে? ছেলে এক’শটা কারণ দেখিয়ে দুঃখ প্রকাশ করবে আসতে না পারার জন্য। ওসব করুনার বাণী শুনতে ইচ্ছা করছে না এখন। 
ক্রিং ক্রিং… 
নাহ্, এবার ফোনটা ধরতেই হয়। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে যথাসম্ভব স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে রহিমা বেগম বললেন, ‘হ্যালো…’
‘হ্যা মা, ফোনটা ধরো না কেন?’ __ছেলের প্রশ্ন। 
‘কি বলবা বলো, ঘুম পাইছে।’ __রহিমা বেগমের কথায় অভিমান ঝরে। 
‘ঘুম পেয়েছে ভালো কথা আমরা কি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব?’ __ছেলের প্রশ্ন। 
‘মানে কী?’ __রহিমা বেগমের কৌতুহল। 
এর মধ্যে দরজার ওপাশে নাতি সায়েদের গলা, ‘দাদি, দরজা খোলো। কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি!’
মুহূর্তেই মন ভলো হয়ে যায় রহিমা বেগমের। চিৎকার করতে থাকেন, ‘ফুলি, ও ফুলি দরজা খোল। কইছিলাম না, ওরা না আইয়া পারবে না। এহন দেখছস…।’
এতক্ষণ যে ঘরে চরম দুঃখ বিরাজ করছিল, এখন তাতে উৎসবের ঢেউ লেগেছে। ঘরকন্নায় ব্যস্থ হয়ে পড়েন তিনি। সারা দিনের না-খাওয়া, গ্লানি, কষ্ট সব নিমেষেই কোথায় হারিয়ে গেল রহিমা বেগম টেরই পেলেন না। 
এত আনন্দের মাঝে এক সময় জানালার কাছে আসেন রহিমা বেগম। তৃতীয়ার চাঁদ ডুবে গেছে, অন্ধকার গ্রাস করছে চারদিক। কিন্তু রহিমা বেগম বিন্দু মাত্র বিচলিত নয়! তাঁর ঘরে যে আজ পূর্ণিমা। জোছনায় ভেসে যাচ্ছে পুরো ঘর…!
লেখক,
মোঃ আনারুল ইসলাম রানা
ইসলাম শিক্ষা বিভাগ, 
কারমাইকেল কলেজ, রংপুর।
READ MORE:  স্বাধীন আবাস (১ম অংশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *