জীবন গল্প

১৯ শতকের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েল

জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ১৮৩১ সালে স্কটল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। ম্যাক্সওয়েলের জন্মের একটু পূর্বেই মাইকেল ফ্যারাডে তড়িৎ চৌম্বকীয় আবেশ আবিষ্কার করেছিলেন। ১৯ বছর বয়সে ম্যাক্সওয়েল কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন পদার্থবিদ্যা এবং গণিত বিষয়ে অধ্যায়ন করার জন্য। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায়ই তিনি বিশ্লেষণ করেছেন রঙ দৃষ্টির পদার্থবিদ্যা

এবং পরে তার ধারণাগুলিও ব্যবহার করেছিলেন। ম্যাক্সওয়েলের ধারণার ওপর ভিত্তি করেই প্রথম রঙিন ছবি তৈরি করা হয়। ম্যাক্সওয়েল বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলের মধ্যে প্রথম পরিচিত হন, যখন তার বয়স কেবল 

২৪ বছর। এই বয়সে ম্যাক্সওয়েল প্রমাণ করেন যে শনি গ্রহের বলয়গুলি কঠিন বা তরল হতে পারে না বরঞ্চ এই বলয়গুলো পৃথক পৃথক ছোট বস্তু দ্বারা গঠিত হতে হবে। এই প্রমাণের মাধ্যমে মাত্র ২৪ বছর বয়সেই বিজ্ঞান জগতে ম্যাক্সওয়েল সাড়া ফেলে দেন। প্রায় একই সময়ে ম্যাক্সওয়েল বিদ্যুৎ এবং চুম্বকত্বের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ম্যাক্সওয়েল আবিষ্কার করেন যে ফ্যারাডে যে তড়িৎ চৌম্বকীয় আবেশের কথা বলেছেন সেটি কোনো বিচ্ছিন্ন প্রভাব ছিল না। বরং কিছু ধরনের একটি অন্তর্নিহিত ঐক্য ছিল। এটিকে ম্যাক্সওয়েল তড়িৎ চৌম্বকীয় বলরেখা নামকরণ করেন। ম্যাক্সওয়েল এরপর ১৮৫৬ সালে “ফ্যারাডে’স লাইন অফ ফোর্সে” নামে একটি পেপার প্রকাশ করেন যেখানে তিনি বৈদ্যুতিক এবং চৌম্বক ক্ষেত্রের গাণিতিক বিবরণ প্রকাশ করেছেন। 

ম্যাক্সওয়েল ১৮৫৬ সালে স্কটল্যান্ডেরএকটি কলেজে পড়াতে যান এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। স্কটল্যান্ডের কলেজ ছেড়ে পরে তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে যোগদান করেন। এই সময়কালে, তিনি তড়িৎ এবং চুম্বকত্বের উপর আরও গবেষণা করেন এবং তার ধারণাগুলি প্রসারিত করেছিলেন। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিকের ওপর দারুণ  একটি একক ব্যাপক তত্ত্ব তিনি তৈরি করছিলেন এসময়, যা থেকে  তিনি যে মৌলিক সমীকরণে পৌঁছেছিলেন তা আজ আধুনিক আলোকবিদ্যার ভিত্তি। এই সমীকরণ থেকে

ম্যাক্সওয়েল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে যেসব তরঙ্গ আলোর বেগে ভ্রমণ করে তারাই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য হলো আলোর গতিেত ভ্রমণ। ম্যাক্সওয়েলের ধারণা অনুসারে আলো হলো এক প্রকার তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ। পরবর্তীতে  জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী হেনরিক হার্টজ তার পরীক্ষার মাধ্যমে ম্যাক্সওয়েলের এসব থিওরির সত্যতা নিশ্চিত করেন। দুঃখের বিষয়, ম্যাক্সওয়েল এটা দেখার জন্য বেঁচে ছিলেন না।

ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তত্ত্বের পিছনে যেমন অবদান রেখেছিলেন ম্যাক্সওয়েল তেমনি গতিতত্ত্ব এবং পরিসংখ্যানেও ম্যাক্সওয়েলের অবদান ছিল অপরিসীম। ম্যাক্সওয়েল মত প্রকাশ করেন যে, একটি গ্যাসের সান্দ্রতা স্বাধীন হওয়া উচিত। অর্থাৎ গ্যাসের সান্দ্রতা তার চাপের ওপর নির্ভর করবে না। পরবর্তীতে  ম্যাক্সওয়েল তার স্ত্রীর সাহায্যে পরীক্ষাগারে এই আশ্চর্যজনক ফলাফল সম্পর্কে নিশ্চিত হোন। তিনি আবিষ্কার করেন যে, গ্যাসের সান্দ্রতা ছিল পরম তাপমাত্রার সমানুপাতিক। ম্যাক্সওয়েলের এই থিওরির ওপর ভিত্তি করে অণুর আকার এবং ভর অনুমান করার একটি পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়, যা এতদিন পর্যন্ত শুধু অনুমান করা যেত। ফলশ্রুতিতে ম্যাক্সওয়েল ও বোল্টজম্যান দুই জন মিলে গ্যাসের আণবিক শক্তির একটি সমীকরণ দাঁড় করান। 

১৮৬৫ সালে, ম্যাক্সওয়েল তার পরিবারের কাছে স্কটল্যান্ডে বাড়িতে ফিরে আসেন। সেখানেও তিনি তার গবেষণা চালিয়ে যান।

ম্যাক্সওয়েল ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজমের উপর একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যা বহু দশক ধরে এই বিষয়ের উপর আদর্শ পাঠ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এটা এক শতাব্দী পরেও মুদ্রিত ছিল। ১৮৭১ সালে, ম্যাক্সওয়েল ক্যাভেন্ডিশ গবেষণাগার  প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করতে কেমব্রিজে ফিরে যান। এই গবেষণাগারটি হেনরি ক্যাভেন্ডিশ নামে অগ্রগামী একজন পদার্থবিজ্ঞানীর সম্মানে নামকরণ করা হয়েছে।

দুঃখজনক ব্যাপার, মহান বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েল ১৮৭৯ সালে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ঠিক এই একই বছরে আরেক মহান বিজ্ঞানী স্যার  আলবার্ট আইনস্টাইন জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

ম্যাক্সওয়েল ছিলেন ১৯ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী। আর ২০ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন আইনস্টাইন। ম্যাক্সওয়েলকে বিজ্ঞানীরা আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link