শিকওয়া ও জবাব-ই- শিকওয়া (বই রিভিউ)
লেখক : আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল
প্রথম প্রকাশ :১৯০৯( শিকওয়া) ..১৯১৩( জবাব-ই-শিকওয়া)
ধরন : কাব্য ( ধর্মীয়)
অনুবাদ : গোলাম মোস্তফা
প্রকাশক : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
সম্পাদনা : আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ
পৃষ্ঠা : ৩৬
মূল্য : ৫৪/-
এটি উপমহাদেশের একটি বহুল আলোচিত বই। আল্লামা ইকবালের শ্রেষ্ঠ কাব্য গুলোর একটি। শিকওয়া শব্দের অর্থ হল অভিযোগ। আর জবাব-ই-শিকওয়া অর্থ হলো অভিযোগের উত্তর।
বইটিতে আল্লামা ইকবাল মুসলমানদের বর্তমান দুঃখ এবং দুর্দশার জন্য আল্লাহ কে দায়ী করেছেন।এককালে শক্তিশালী মুসলিম জাতির বর্তমান বেহাল দশার জন্য খোদাকে অভিযোগ করেছেন। আর জবাব ই শিকওয়া তে এই অভিযোগ গুলোর কাল্পনিক উত্তর দিয়েছেন এবং দেখিয়েছেন যে মুসলমানদের বর্তমান দুঃখ-দুর্দশার জন্য খোদা তায়ালা কোন অংশে দায়ী নয় বরং মুসলমানরা নিজ কর্মকাণ্ডের জন্যই বর্তমান বেহাল দশায় নিমজ্জিত।
শিকওয়া কাব্য টি তে ছয় লাইন ছয় লাইন করে মোট ৩১ স্তবক কবিতা রয়েছে। আর জবাব- ই- শিকওয়াতে ছয় লাইন ছয় লাইন করে মোট ৩৬ স্তবক কবিতা আছে।
শিকওয়া:
এই পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি যখন ঘোর অমানিশায় আচ্ছন্ন ছিল। মুসলমানরা সে অমানিশায় আলো জ্বালিয়েছে। মরু, সাগর পাড়ি দিয়ে খোদার নাম উচ্চকিত করেছে। রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে। তবু খোদার পথ থেকে বিচ্যুত হয় নি। শুধুমাত্র খোদাকে পাওয়ার জন্য।তাঁর সন্তুষ্টির জন্যে। অন্যান্য জাতি যখন ভোগ বিলাসের অন্ধকারে নিমজ্জিত। মুসলমানরা তখন সাম্য আর ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করার জন্য দিগবিদিগ ছুটে বেড়িয়েছে। আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছে। সে সময়ে মুসলমানেরা ছিল পৃথিবীর শাসনকর্তা। মুসলমানদের হাতে ছিল অফুরন্ত সম্পদ।
কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় মুসলমানরা তাদের রাজ্য হারিয়েছে। সম্পদ হারিয়ে হয়েছে সর্বহারা। অথচ যে সকল জাতি প্রতিনিয়ত খোদার নাফরমানি করছে,তাঁর সাথে বিদ্রোহ করছে, তারা হয়েছে সম্পদের মালিক। তারা হয়েছে পৃথিবীর শাসনকর্তা। তাদের হাতেই মুসলমানরা হচ্ছে নির্যাতিত। কিন্তু কেন এমন টি হল? একথাই তিনি একজন সাধারন মুসলমানের কল্পনাতে জানতে চেয়েছেন খোদার কাছে।
কবি বলেনঃ
কোন জাতি সে তোমায় ছাড়া অন্য কারো চাইনি আর
যুদ্ধ দেছে তোমার তরে করেছে তারা জান নিসার?…..
আফসোস আজ আগের মতন নওকো তুমি মেহেরবান
ব্যাপারটা কি!এখন কেন দাওনা মোদের তেমন দান?….
সইছি মোরা জিল্লতি আর দুশমনদের টিটকারি
তোমার তরে জান দিয়েছি বদলা দিলে এই তারি?
জবাব ই শিকওয়া:
এ খন্ডে কাল্পনিক এক আরশের আওয়াজ উক্ত কথাগুলোর জবাব দিয়েছেন। উত্তর দিয়েছে প্রতিটি অভিযোগের।কি ছিল সে জবাব? যে অভিযোগের জন্য আল্লামা ইকবালকে অনেকে কাফের পর্যন্ত বলেছিল। তিনি কি দিতে পেরেছিলেন সে অভিযোগ গুলোর উত্তর? জানতে হলে পড়তে হবে বইটি।
তবে একটি জবাব তুলে ধরলাম:
ভোগবিলাসেতে তন্ময় তুমি অসার এখন তোমার প্রাণ
তুমি মুসলিম? মুসলমানের এই আদর্শ? এই বিধান?
নাইকো আলীর ত্যাগ সাধনা নাইকো সম্পদ ওসমানের
কেমন করিয়া আশা করো তবে তাদের রুহানি সংযোগের
মুসলমানের তরেই তখন সে যুগ করিত গর্ববোধ
কুরআন ছাড়িয়া এখন হয়েছ যুগ কলঙ্ক হায় অবোধ।
কবি পরিচিতি:
আল্লামা ইকবাল উপমহাদেশের বিখ্যাত ব্যক্তিদের একজন। ১৮৭৭ সালে পাঞ্জাবে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, ব্যারিস্টার। লন্ডনে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। জার্মানি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি পেশায় একজন আইনজীবী হলেও উর্দু, আরবি ও ফার্সি সাহিত্যে তাঁর ছিল অসামান্য দক্ষতা। মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ছিলেন পাঞ্জাব মুসলিম লীগের সভাপতি ও।
নাইট উপাধি : আসরার -ই-খুদি পুস্তকের জন্য তিনি নাইট উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।
ভাবগুরু : রুমি, মেথিউ আর্ণল্ড, শিবলী নোমানী।
ভাব শিষ্য : মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, তারিক রমাদান, আলা মওদুদী,ড. আলি শরীয়তী।
অবদান: দ্বিজাতি তত্ত্ব, খুদি তত্ত্ব।
তিনি পাকিস্তানের জাতীয় কবি এবং তার জন্মদিনটি পাকিস্তানের সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালন করা হয়।
বই :
১আসরার-ই- খুদি( The secret of self)
২.The reconstruction of religious thought in islam.
৩. যুবুর ই আজম
৪.মুসাফির
৫.তারানায়ে মিল্লি
৬.শিকওয়া ও জওয়াব-ই- শিকওয়া
তিনি ১৯৩৮ সালে লাহোরে মৃত্যুবরণ করেন।
#নিজের মতামত :
বইটি যদিও একটি ধর্মীয় কাব্য কিন্তু এতে রয়েছে উচ্চমাত্রার সাহিত্যবোধ। কাব্যের মধ্যে এমন ধর্মীয় আবেগ কিছুটা অনুভব করেছি জীবনানন্দ দাশের “রূপসী বাংলা” কাব্যে। এই কাব্যে কবি বাংলার রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে অনেক উদাহরণ টেনেছেন তার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। যেমন : একটি কবিতায় তিনি বাংলা কে বলেছেন “বল্লাল সেনের বাংলা”। এছাড়াও বিভিন্ন কবিতায় তিনি “দেবী লক্ষ্মী” সহ বিভিন্ন দেবদেবীর কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছেন। তারপরও এটি সকল ধর্মের পাঠক সমাজে সমাদৃত এর অসাধারণ সাহিত্য রসের জন্য।
ঠিক তেমনি শিকওয়া ও জবাব-ই- শিকওয়া কাব্যটি যদিও মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে লিখিত হয়েছে। তারপরেও এটি পাঠকসমাজে অধিক সমাদৃত কাব্যটির উচ্চ সাহিত্য রসের জন্য। এ কারণেই বোধহয় কাব্যটিকে অনেক বিখ্যত মনীষী বাংলায় অনুবাদ করেছেন। যেমন: ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ফররুখ আহমেদ, সৈয়দ আলী আহসান, গোলাম মোস্তফা সহ আরো অনেকে। তবে গোলাম মোস্তফার কাব্যানুবাদ ই সবচেয়ে সুন্দর হয়েছে বলে মনে করা হয়। এছাড়াও কাব্যটিকে খুশবন্ত সিং ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সম্পাদনায় বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র কাব্যটি কে প্রকাশ করায় এটি পাঠকের নিকট আরো বেশি গুরুত্বের দাবিদার।
সবমিলিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে যেহেতু এটি উর্দুতে লেখা তাই উর্দু ভাষাতেই এটি বুঝার চেষ্টা করলে প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যাবে। কিন্তু গোলাম মোস্তফার যে অনুবাদ আমি পড়েছি তাতেও সাধের কমতি হয়েছে বলে মনে হয় না।
বইটি পড়ে একটি মেসেজ পেয়েছি সেটি হলো সৃষ্টি কর্তা কারো উপর জুলুম করেন না। তিনি যোগ্যদেরই সব সময়, সকল যুগে মূল্যায়ন করেন,পুরস্কৃত করেন।তার কাছে যোগ্যতাই হলো উত্থান ও পতনের মানদন্ড।
লেখক,
জোনাইদ হোসেন
শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়