বই রিভিউ

বাংলাদেশের কালচার বই রিভিউ – আবু তালহা

  • বইঃ বাংলাদেশের কালচার
  • লেখকঃ আবুল মনসুর আহমদ
  • প্রকাশনীঃ আহমদ প্রকাশনী হাউস
  • পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১৬৬
  • মুদ্রিত মূল্যঃ ১৮০ টাকা

 

লেখক পরিচিতিঃ

আবুল মনসুর আহমদ একজন বাংলাদেশী সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিক। তিনি ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার ধানিখােলা গ্রামে ১৮৯৮ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ইত্তেহাদ এর সম্পাদক হিসেবে তিনি ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখেন। পরবর্তীতে রাজনীতে যােগদান করেন। পাশাপাশি সাহিত্যিক হিসেবে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৭৯ সালের ১৮ই মার্চ ঢাকায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

 

বই সংক্ষেপঃ

 

যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যে সকল জ্ঞানী মানুষ নতুন বাংলাদেশ কাঠামাে গঠনে মহান ভূমিকা রাখেন তাদের মধ্যে কথা সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ অন্যতম। ১৯৬৬ সালে পাক-বাংলা কালচার নামে একটি বই রচনা করেন তিনি। এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে আরাে দুইটি প্রবন্ধ যােগ করে বইটির নাম রাখেন বাংলাদেশ কালচার।

 

বই পর্যালােচনাঃ

 

বাংলাদেশের কালচার বইটিকে মােট ১০টি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। বইটিতে মূলত আমাদের জাতিসত্ত্বা, নিজস্ব পরিচয়, আচার-আচরণ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলােকপাত করা হয়েছে। যেমনঃ বাংলাদেশের কালচারঃ কালচারের উপর নির্ভর করেই মূলত রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠে। আর এর উপর ভিত্তি করেই মূলত শহর ও গ্রামের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। লেখকযেমনটা কালচারের উদাহরণ দিয়েছেন গাছের মত। আর জাতীয় কালচারের ইমারত বলেছেন সাহিত্যকে। সেই সাথে লেখক এ অধ্যায়ে তুলে এনেছেন কালচার ও সিভিলিয়েশনের পার্থক্য, সীমারেখা এবং কালচারের ব্যাপকতা ও উৎস। আমাদের কালচার ও সভ্যতা নিয়েই বিচ্ছুরিত আলােচনা করা হয়েছে। এছাড়াও মুসলিম সমাজের শিল্প, সভ্যতা, সংস্কৃতির আবির্ভাব নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে।

সাহিত্যের প্রাণ, রূপ ও আংগিকঃ বিশাল রূপে ভাষায় প্রকাশিত মানবমনের গােটাটাই সাহিত্য। আর সংকীর্ণ রূপে সাহিত্য একটা আর্ট। লেখক এই অধ্যায়ে এই ব্যাপারটাই বুঝাতে চেয়েছেন। সেই সাথে সাহিত্য পরিবর্তনের সীমাবদ্ধতা স্থান, কাল, ব্যক্তির কি ধরনের প্রভাব লক্ষ্যণীয় তার ব্যাখ্যা করেছেন।

READ MORE:  নকশী কাঁথার মাঠ - বই রিভিউ

ভাষা আন্দোলনের মর্মকথাঃ প্রতিটি জাতির কালচারই জাতির ব্যক্তিত্ব বহন করে। আর ব্যক্তিত্ব হচ্ছে প্রত্যেকের নিজস্ব স্বকীয়তা। এই স্বকীয়তার মূলমন্ত্র হলাে মাতৃভাষা। লেখক এ অধ্যায়ে আমাদের পরিচয়, আমাদের ব্যর্থতার স্বরূপ তুলে ধরেছেন। এছাড়া বাংলা সাহিত্যের আদিযুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ সম্পর্কে আলােচনা করেছেন। সবশেষে ভাষা আন্দোলনের মর্মবাণী, অনুকরণ নয় স্বকীয়তাই যে আমাদের অধিকার ও দায়িত্ব এই সত্যতা তুলে ধরেছেন।

পাক বাংলার রেনেসাঁঃ লেখকের মতে, জাতির মরা হাড়ে জীবনের বিদ্যুৎ চমকানােকেই আমরা এক কথায় রেনেসাঁ বলে থাকি। রাষ্ট্রে-সমাজে, শিল্প- সাহিত্যে, ব্যবসা-বানিজ্যে এক কথায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে সাফল্য আনার নামই রেনেসাঁ। এই অধ্যায়ে ইউরােপীয় রেনেসাঁ থেকে পাক বাংলা রেনেসাঁর চিত্র তুলে এনেছেন। সেই সাথে বের করে এনেছেন থেকে মুক্তির পথ।

শিক্ষার মিডিয়ামঃ নিজস্ব সাহিত্যে স্বকীয়তা লাভের জন্যে শিক্ষা লাভ প্রয়ােজনীয়। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছু বাধ্যবাধকতার ফলে শিক্ষার মান আজো প্রশ্নাতীত। লেখক সেই বিষয়গুলােই চিহ্নিত করেছেন এই অধ্যায়ে। তাছাড়া পরিভাষার ব্যাপকতাসহ বিদেশি ভাষা শেখার প্রয়ােজনীয়তার কথা বলেছেন। সেক্ষেত্রে লেখক বলেই দিয়েছেন, বিদেশী ভাষা আমরা শিখিব তবে মাতৃভাষায় শিক্ষিত হইবার পর আগে নয়।আনন্দের জোয়ার ঈদুল-ফিতরঃ বাঙালি মুসলিম জীবনে ঈদুল ফিতরের দিন হলাে সবচেয়ে আনন্দদায়ক দিন। আর দিনটির উপলক্ষ্য হচ্ছে রামাদান মাস, ইবাদতের মাস। লেখক এই অধ্যায়ে এই কথা বােঝাতে চেয়েছেন যে, এবাদাত ও উৎসব একত্রে চলতে পারেনা। এছাড়াও ঈদের দিনের আবশ্যকতা, তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে এ অধ্যায়ে।

আমাদের স্বপ্নের শহীদ মিনারঃ আমাদের জাতীয় জীবনে একটি গৌরবময় দিন মাতৃভাষা দিবস । এটি শুধু স্মৃতির দিন নয়, প্রতীকের ও দিন। লেখক এই অধ্যায়ে শহীদ মিনারের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। তাছাড়া লেখকের মতে শহীদ মিনার কেমন হওয়া উচিত ছিলাে, তাও ব্যাখ্যা করেছেন।

আমাদের ভাষাঃ প্রত্যেক জাতির নিজস্ব কালচার ও নিজস্ব সাহিত্য সৃষ্টির জন্য আলাদা আলাদা ভাষা রয়েছে। সে হিসেবে আমাদের নিজস্ব ভাষা বাংলা, আমাদের মায়ের ভাষা। ভাষা সর্বদা পরিবর্তনশীল। লেখক এই অধ্যায়ে আমাদের ভাষার পরিবর্তনশীলতা, আমাদের ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব, এবং অঞ্চলভেদে ভাষার ব্যবহার বিধি সম্পর্কে আলােচনা করেছেন।

READ MORE:  চোখের বালি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (বই রিভিউ)

বাংলাদেশের কৃষ্টিক পটভূমিঃ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নতুন হলেও এর কৃষ্টিক পটভূমির ইতিহাস অনেক পুরনাে। বাংলাদেশ একটি মুসলিম অধ্যুষিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। শুধু রাজনীতিক দিক নয়, কালচারের দিক হতেও এদেশের জনগণের মাঝে ধর্মীয় গণতন্ত্র লক্ষ্যণীয়। লেখক এই অধ্যায়ে কিভাবে বাংলার অতি প্রাচীন কালচার নব নব রূপ লাভ করে আজকের কালচারে পরিণত হয়েছে। সেবিষয়ে আলােকপাত করেছেন। এছাড়াও আমাদের ভাষাগত নিজস্বতা, কৃষ্টিক স্বকীয়তাও তুলে ধরেছেন এ অধ্যায়ে।

বাংলাদেশের জাতীয়তাঃ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রত্যেক জাতির আলাদা ব্যক্তিত্ব ও সত্তা থাকাটা দরকারি। লেখক এই অধ্যায়ে আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিচয়, দৈহিক বর্ণনা, বস্তুগত পরিচিতি ছাড়াও আমাদের যে একটা স্পিরিচুয়াল জগত আছে সে সম্পর্কে আলােকপাত করেছেন। তাছাড়াও পাঠান, মােগল, ইংরেজ আমলে বাঙ্গালা ভূখন্ডের বৈশিষ্ট্য ও বৈশিষ্ট্যের কারন তুলে ধরা হয়েছে। রবীন্দ্র বিশালতার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে যে জাতীয় বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাও ফুটিয়ে তুলেছেন। এবং সবশেষে লেখক শের এ বাংলা ফজলুল হককে বাংলার জাতীয় স্যার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

 

নির্বাচিত উক্তিঃ

  • মেধা মানুষকে অন্যান্য জীব জন্তু হইতে পৃথক করিয়াছে। সেই মনের বিকাশের নাম কালচার।
  • নিষ্ঠুরতারই আরেক নাম বীরত্ব। আহাম্মকির সাধু নাম সরলতা।
  • মসজিদ, মন্দির ও গির্জার বাইরে যে উৎসব যতটা প্রসারিত হয়, জাতীয় রূপ পাওয়ার সম্ভাবনা হয় ততাে বেশী।
  • শহর যা সৃষ্টি করে, পল তাহা করে ধারন ও লালন।
  • মুসলমান হওয়াটাই সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা নয়। পূর্ব বাঙ্গালী হওয়াটাই সংকীর্ণ আঞ্চলিকতা
  • নয়।

 

বইটি যে কারনে সবার পড়া উচিতঃ

 

সামাজিক জীব হিসেবে প্রতিটি মানুষের উচিত তার নিজস্ব জাতিসত্ত্বা, নিজস্ব পরিচয় সম্পর্কে জানা। সেই সাথে নিজস্ব কৃষ্টি, কালচার, শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে জানাটাও দরকারি। কারন এসবের মাঝেই প্রতিটি জাতির স্বকীয়তা বহন করে। বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের ও রয়েছে কৃষ্টি কালচারের বিশাল ভান্ডার। আর সেই বিষয়ে জানতে হলে আপনাকে অবশ্যই পড়তে হবে বাংলাদেশের কালচার বইটি।

READ MORE:  বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসি এবং রিসালায়ে নুর - বই রিভিউ

 

সমালােচনাঃ

 

বইটির মাঝে ধর্মীয় ব্যাপারে বেশ মনগড়া আলােচনা লক্ষ্য করা গেছে। ধর্মীয় পারে পরিপূর্ণ জ্ঞান না রেখে যেসব ব্যাপারে আলােচনা কোন ভাবেই কাম্য নয়। তাছাড়া বেশ কয়েক জায়গায় বিদ্বেষপূর্ণ অসুস্থ ইঙ্গিতে লক্ষ্য করা গেছে।

 

পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ

 

আমাদের নিজস্ব জাতিসত্ত্বা, আচার-আচরন সম্পর্কে জানার পরিপ্রেক্ষিতেই বইটি আমি পড়েছি। অনেক তথ্য বহুল একটি বই। অনেক অজানা বিষয় জানতে পেরেছি। বিশেষ করে নিজের শিকড়ের অনেক অজানা তথ্য। সর্বোপরি বইটি আমার কাছে অনেক ভালাে লেগেছে। আপনিও পড়তে পারেন।

পারসােনাল রেটিংঃ ৪/৫

লেখক

নামঃ আবু তালহা

ঠিকানাঃদেওয়ানগঞ্জ, জামালপুর

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানঃ উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *