ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ, করণীয় এবং প্রতিরোধ
ডেঙ্গু জ্বর
ডেঙ্গু কি:
আমরা প্রায়শই নানা রকম ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকি। বিভিন্ন পন্থায় ভাইরাসগুলো আমাদের দেহে প্রবেশ করে। ডেঙ্গু এমন একটি মারাত্মক ভাইরাস যা এডিস এজিপ্টি মশার মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং ১ সপ্তাহের মাঝেই আমাদের শরীরে উপসর্গ দেখা দেয়। ডেঙ্গুর প্রধান উপসর্গ হলো ডেঙ্গু ভাইরাস দেহে প্রবেশ করলে আমরা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ি। ডেঙ্গু ভাইরাস ফ্ল্যাভিভাইরিডি পরিবার এবং ফ্ল্যাভিভাইরাস গণের অন্তর্ভুক্ত। এটি একটি এক সূত্রক আরএনএ (RNA) ভাইরাস। এই ভাইরাসের চার ধরনের স্ট্রেইন রয়েছে। স্ট্রেইন হলো ভাইরাসের সেই অংশ যা দ্বারা সে রোগাক্রান্ত করতে পারে। ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪ টি স্ট্রেইন হলো DEN 1, DEN 2, DEN 3, DEN 4। গবেষণায় দেখা গেছে DEN 1 এবং DEN 2 এর কারণেই মূলত ডেঙ্গু জ্বর হয়।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ :
ডেঙ্গু জ্বর ২ প্রকার।
১. ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভার।
২. হেমোরেজিক ডেঙ্গু ফিভার।
ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ-
তীব্র জ্বর হয়। একইসাথে সারা শরীরে ব্যথা অনুভব হয়। ব্যথা সাধারণত মাথা, হাড়, অস্থিসন্ধি, পিঠ ও চোখের ভেতরের দিক অনুভূত হয়। প্রায় ১০৫° ফারেনহাইট পর্যন্ত জ্বর হয়। জ্বর হওয়ার সাধারণত ৫ দিন পর আরও কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। এসময় আক্রান্ত ব্যক্তি প্রচন্ড ক্লান্তি অনুভব করে। আক্রান্ত ব্যক্তি কিছুই ঠিকমতো খেতে পারে না কারণ রুচি কমে যায়। রোগীর বমি বমি ভাব অনুভূত হয় এবং অনেক বমি হয়।
হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ-
এই জ্বর হলে পায়খানার সাথে তাজা রক্ত আসে। মেয়েদের এই জ্বরটি হলে আরও বেশি সমস্যা দেখা দেয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে অসময়ে ঋতুস্রাব দেখা দেয় এবং পেটে ও বুকে পানি আসে। এছাড়া নারী পুরুষ উভয়েরই তীব্র জ্বর অনুভূত হয়। ফুসফুসে পানি জমে।
ডেঙ্গু জ্বরের পরীক্ষা :
একটানা ৫ দিন জ্বর কিংবা ৩ দিন পরপর জ্বর আসলে এবং ডেঙ্গু এর লক্ষণ সমূহ দেখা দিলে দ্রুত ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে কি না তা জানার জন্য পরীক্ষা করা উচিত। জ্বরের ৫ দিন পর ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। এর আগে করলে ডেঙ্গু সনাক্ত নাও হতে পারে। সিবিসি এবং প্লাটিলেট পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। সাধারণত প্লাটিলেট কাউন্ট ১ লাখের কম হলে ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। আমাদের দেহে যেকোনো ভাইরাস প্রবেশ করলে শরীরে এন্টিবডি তৈরি হয়, যা আমাদের দেহের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ডেঙ্গু জ্বরে ২ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু এনএস-১ অ্যান্টিজেন এবং ৪ দিন পর এন্টি ডেঙ্গু এন্টিবডি তৈরি হয়। তাই এন্টিবডি পরীক্ষা করার মাধ্যমেও ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।
ডেঙ্গু হলে করণীয়:
আমাদের দেশে সাধারণত বর্ষাকালে প্রচুর মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়। কারণ এসময় মশার বংশবিস্তার বেশি হয়। জুন, জলাই, সেপ্টেম্বর মাসে অনেক মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। ডেঙ্গু যদিও মারাত্মক, তবুও বর্তমানে ভয় পাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ডেঙ্গু হলে কিছু বিষয় মেনে রোগীর যত্ন নিলে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করলে জ্বর ভালো হয়ে যাবে। ডেঙ্গু হলে যা যা করণীয়-
-পুরোপুরি সেরে উঠার আগ পর্যন্ত বিশ্রাম নিতে হবে।
-জ্বর কমানোর জন্য নাপাই যথেষ্ট। অন্য কোনো ওষুধ খেয়ে ঝুঁকি বাড়ানোর দরকার নেই।
-প্রচুর পরিমাণে তরল জাতীয় খাবার, স্যালাইন, ডাবের পানি, শরবত এসব খেতে হবে।
– জ্বর বেড়ে গেলে মাথায় জলপট্টি দিতে হবে, ভেজা কাপড় দিয়ে গা মুছতে হবে। তাহলে আরাম পাওয়া যাবে।
– চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ সেবন করতে হবে।
– আক্রান্ত ব্যক্তিকে যেন মশা না কামড় দেয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ এতে অন্য জনও আক্রান্ত হতে পারে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়:
ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য যে ব্যাপারটিতে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে তা হলো এডিস মশার বংশবিস্তার রোধ। এডিস মশাই হলো ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক। কোনো ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড় দেওয়ার পর মশা অন্য কাউকে কামড় দিলে সেও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই এডিস মশার বংশ বিস্তার রোধ করতে হবে। এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে। বর্ষাকালে রাস্তার গর্তে, ডাবের খোসায়, চিপসের প্যাকেটে, অ্যাকুরিয়ামে, ফুলের টবে পানি জমে থাকে। এসব জায়গায় এডিস মশা ডিম পাড়ে। তাই এসব জায়গায় পানি জমতে দেয়া যাবে না। কোনো ক্রমেই ৫ দিনের বেশি যেন পানি না জমে থাকে সে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া ড্রেনে গাপ্পী মাছের পোনা ছাড়া যেতে পারে। গাপ্পী মাছ মশার লার্ভা খেয়ে ফেলে। গাপ্পী মাছ মশা প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। বাড়ির আশে পাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল পরিষ্কার রাখতে হবে।
বিছানায় ঘুমানোর সময় মশারী দিতে হবে। ঘরে ২০ মিনিট কর্পূর জ্বালিয়ে রাখলে মশা প্রবেশ করে না। জানালায় নেট ব্যবহার করতে হবে। কয়েল কম ব্যবহার করাই উত্তম কারণ এতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। মশা নিধনের জন্য পরিবেশে মশা নিধনকারী স্প্রে করতে হবে। ডেঙ্গু বাহক এডিস মশা সাধারণত সকাল এবং সন্ধ্যায় কামড় দেয়। এই ২ সময় সাবধানে থাকতে হবে।
সর্বোপরি ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রচন্ড জনসচেতনতা জাগ্রত করতে হবে এবং মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করতে হবে।